অসন্তোষ-লন্ডনের আগুন কে জ্বালাল? by তারিক আলী

কারণটা যা-ই হোক, কেন এসব এলাকা থেকেই সব সময় বিক্ষোভ ছড়ায়? এর সঙ্গে কি জাতি-পরিচয়, শ্রেণী, দারিদ্র্য সৃষ্টির ব্যবস্থা এবং প্রতিদিনের বিপন্নতার কোনো সম্পর্ক আছে? ব্রিটেনের রক্ষণশীল ও লেবার পার্টির কোয়ালিশন সরকার (যার মধ্যে রয়েছে লেবার পার্টি ভাঙা নিউ লেবারও, অর্থনৈতিক মন্দা চলতে থাকলে তারা সবাই মিলে হয়তো একটি


জাতীয় সরকারও গঠন করবে) তাদের নিষ্প্রাণ মতাদর্শ দিয়ে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না। কারণ, এই তিন দল আজকের সংকট সৃষ্টির জন্য সমানভাবে দায়ী। এই বিপর্যয় তাদের হাতে তৈরি।
তারা ধনীদের বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। তারা ঘোষণা দিয়েছে, বিচারক ও ম্যাজিস্ট্রেটদের উচিত গুলালসহ ধরা পড়া যেকোনো বিক্ষোভকারীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া। কখনোই তারা সত্যিকারভাবে প্রশ্ন তোলেনি, ১৯৯০ সালের পর পুলিশ হেফাজতে শতাধিক মানুষ নিহত হওয়ার জন্য কখনোই কেন কোনো পুলিশকে শাস্তি পেতে হয়নি। যে দলই হোক, সাংসদেরা কালো কি সাদা, যা-ই হোন, সবাই একই ভুয়ামি করে যাবে। হ্যাঁ, আমরা জানি যে লন্ডনের রাস্তায় সহিংসতা ভালো নয়। আমরা জানি, দোকানপাটে লুটপাট করা ঠিক না। কিন্তু একবারও প্রশ্ন করা হয়েছে, কেন এই মুহূর্তেই এসব ঘটছে? কেন গত বছর এই বিক্ষোভ ঘটেনি? কারণ, বঞ্চনার অনুভূতি দানা বাঁধতে সময় নেয়। কারণ, ব্যবস্থা যখন বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর এক কালো যুবকের মৃত্যু চায়, তখন তাদের এই চাওয়া প্রতিবাদও ডেকে আনে। অচেতনভাবে হলেও এই প্রতিবাদ তারাই সৃষ্টি করেছে।
রাজনীতিবিদ ও এলিট ব্যবসায়ীরা যদি তাঁদের হাতে থাকা রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন এবং রুপার্ট মারডকের নেটওয়ার্ককে সঙ্গে নিয়েও অর্থনৈতিক দুরবস্থা মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হন, তাঁরা যদি কেবলই গরিব ও অসচ্ছলদের শাস্তি দিতে থাকেন, তিন দশক ধরে বাস্তবায়ন করা সরকারিভাবে নীতির গলদ বুঝতে যদি তাঁরা অক্ষম হন, তাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে গড়াবে। দেশে বা বিদেশে ‘শত্রু’দের শয়তান হিসেবে চিত্রিত করে, ভয় দেখিয়ে এবং বিনা বিচারে কারাগারে বন্দী রেখে তাঁরা বেশি দিন পার পাবেন না।
এ দেশে যদি সত্যিকার কোনো বিরোধী দল থাকত, তাহলে এই পুঁজিবাদী নিউ লিবারেল ব্যবস্থা মানুষের আরও ক্ষতি করে, তাদের ওপর ভেঙে পড়ার আগেই সেটাকে অপসারণের দাবি তারা তুলত। ইউরোপজুড়ে মধ্যডান আর মধ্যবামের মধ্যে, রক্ষণশীল আর সমাজগণতন্ত্রীদের মধ্যে আগেকার সব পার্থক্যই লোপ পেয়েছে। সরকারি নীতির সঙ্গে একাকার হয়ে এরা সবাই সুবিধাবঞ্চিত সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারদের পরিত্যাগ করেছে।
টটেনহাম, হকনি, এনফিল্ড ও ব্রিকসটনের বেকার তরুণ বা অর্ধবেকার কালো তরুণেরা বুঝে গেছে, ব্যবস্থা তাদের বিরুদ্ধে। রাজনীতিবিদদের বিকট চিৎকার যেখানে বেশির ভাগ মানুষের মনে কোনো দাগই কাটে না, সেখানে যারা আজ রাস্তায় আগুন জ্বালাচ্ছে, তারা তা শুনবে কেন? আগুন নিভে যাবে। কেন মার্ক দুগ্যাল নামের কৃষ্ণাঙ্গ যুবককে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছিল, তা নিয়েও হয়তো শোচনীয় কোনো তদন্ত হবে। সরকার হয়তো অনুতাপও প্রকাশ করবে, দুগ্যালের শেষকৃত্যে হয়তো ফুলও ছিটাবে পুলিশ। কিন্তু গ্রেপ্তার হওয়া প্রতিবাদীদের ঠিকই শাস্তি দেওয়া হবে। তারপর সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। জীবন বয়ে চলবে আবার এ রকম কোনো বিদ্রোহ ঘটার আগ পর্যন্ত।
লন্ডন রিভিউ অব বুকস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ
তারিক আলী: পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ সাংবাদিক ও লেখক।

No comments

Powered by Blogger.