সংবিধান সংকট ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা by লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান (অব.)

স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। স্বাধীনতার জন্য এখানে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছে_মুক্তিযুদ্ধ। গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় এমনটি আর কোথাও হয়নি। এটা আমাদের অহংকার। যে অদম্য স্পৃহা, যে দুর্দমনীয় চেতনা গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, মুক্তিযুদ্ধে ঠেলে দিয়েছিল, তা ছিল সত্যিকারের গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, এক স্বাধীন দেশের নির্মাণ, যেখানে সবার থাকবে সমান অধিকার, সমান সুযোগ, থাকবে না কোনো বৈষম্য, শোষণ ও বঞ্চনা।


দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের! ৪০ বছরেও গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হলো না, প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করতে পারল না। গণতন্ত্র এখানে পৌনঃপুনিকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রচিত ১৯৭২ সালের সংবিধান মাত্র তিন বছরের মাথায় লঙ্ঘিত হলো। চতুর্থ সংশোধনীর খৰ তার স্কন্ধে নেমে এলো। বহুদলীয় গণতন্ত্র পরিবর্তিত হয়ে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হলো। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মন্তুদ ঘটনা আমাদের জাতিসত্তার নির্মাতা পর্বতপ্রমাণ মহান নেতা বঙ্গবন্ধুকে আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিল। শোকবিহ্বল হতবাক জাতি, অবাক বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করল বঙ্গবন্ধুরই এক বিশ্বস্ত সহচর ব্রুটাসের ভূমিকায় মঞ্চে অবতীর্ণ। গোটা দেশে তখন চরম অনিশ্চয়তা, ভয়ংকর অস্থিরতা। এর মধ্যেই সংঘটিত হলো ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার বিপ্লব। আর সেই স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থানের উত্তুঙ্গ তরঙ্গমালায় জাতীয় মহাশূন্যতায় রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের পাদপ্রদীপে উঠে এলেন সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান। তিনি বলিষ্ঠ হস্তে সংকটাপন্ন জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করলেন, উত্তরণ ঘটালেন। তিনি চতুর্থ সংশোধনী বাতিল করে সংবিধানে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করলেন, বাকশালের একদলীয় শাসন রহিত করলেন।
উচ্চ আদালত পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ রায় দিয়েছেন। কিন্তু জিয়ার পঞ্চম সংশোধনীর ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তগুলো, যেমন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, বহুদলীয় গণতন্ত্র, বিসমিল্লাহ সংযোজন_প্রভৃতি বহাল রেখেছেন। আদালত কেবল পঞ্চম সংশোধনীর সামরিক ফরমানগুলোকে অবৈধ বলেছেন। আর এর সঙ্গে জিয়ার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। কারণ জিয়া এ দেশে সামরিক আইন জারি করেননি। সামরিক আইন জারি করেছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা মোশতাক আহমেদ। এটাই ঐতিহাসিক সত্য। উচ্চ আদালতকে আমি শ্রদ্ধা জানাই। আইনের চেয়ে বড় কিছু নেই বিশ্বাস করি। জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক_সব নাগরিকের এটাই একান্ত কামনা।
এটা অনস্বীকার্য যে উচ্চ আদালত বিবেচনায় নিয়েছেন গণতন্ত্রকে বাংলাদেশে নিশ্চিত করতে হবে, সংবিধানকে চির সমুন্নত রাখতে হবে, সামরিক শাসনকে চিরদিনের জন্য তার দ্বার রুদ্ধ করে দিতে হবে।
এটা মহতি উদ্যোগ, দৃশ্যত একটা ভালো দিক। বাংলাদেশের মানুষ এক সাগর রক্তে অবগাহিত হয়ে দেশ স্বাধীন করেছে। সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমরা সবাই গণতন্ত্রের ধারাকে অব্যাহত দেখতে চাই। পবিত্র সংবিধান সমুন্নত দেখতে চাই। কোনো স্বৈর বা সামরিক শাসক গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করুক, আমরা চাই না। সংসদ জাতীয় সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকুক তা আমরা চাই। আমরা মহাশক্তিধর সার্বভৌম সংসদ চাই, মহাকার্যকর যুক্তিসমৃদ্ধ বিতর্কমুখর প্রাণবন্ত সংসদ দেখতে চাই। জাতীয় সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনায় একটি আলোকিত সংসদ দেখতে চাই। আমরা সুশাসন দেখতে চাই, সরকারের সব কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা ও পূর্ণ জবাবদিহিতা দেখতে চাই। আমরা চলমান সাংঘর্ষিক রাজনীতির বিষচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ, হত্যার রাজনীতির অবসান চাই। চরম নৈতিকতাহীনতার ভ্রষ্টাচারিত, দুর্বৃত্তায়িত, দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতির পরিসমাপ্তি দেখতে চাই। দূর-অতীতের হারিয়ে যাওয়া সুস্থ রাজনীতির ঐতিহ্য আর কৃষ্টির শুভ সূত্রপাত দেখতে চাই। অসহিষ্ণুতা অশ্রদ্ধার বিপরীতে পরমতসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক সহযোগিতা ও শ্রদ্ধাবোধ দেখতে চাই। winners to grab all and losers to spoil all_এই মানসিকতা থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যাবর্তন দেখতে চাই। জাতীয় স্বার্থে, জনগণের কল্যাণে, মানুষের মঙ্গলে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে সহযোগিতা ও ঐকমত্যের একটা bottom line দেখতে চাই।
আমি এতক্ষণ জনগণের প্রত্যাশার কথা বললাম। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত বাংলাদেশের মানুষ আর তার নতুন প্রজন্ম এতটুকু প্রত্যাশা তো করতেই পারে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের আপামর জনগণ মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত প্রাঙ্গণে রোপিত গণতন্ত্রের চারা গাছটি শাখা-প্রশাখায় বিস্তারিত হবে, লতায়-পাতায় পল্লবিত হবে, ফুলে ফুলে সুশোভিত হবে, পরিণত হবে একটি বিশাল মহীরুহে_এটাই তো কামনা করবে। এটাই তো স্বাভাবিক। আজ চারদিকে প্রশ্ন উঠছে, আদালতের রায় জারি করে, সংবিধানে নিষেধাজ্ঞা এনে সামরিক শাসন রোধ করা কি সম্ভব? সামরিক শাসকরা সংবিধান পড়ে, আদালতের রায় মুখস্থ রেখে সামরিক শাসনের ঘোষণা দেয় না। রাজনীতির দৈন্য নৈতিকতার দেউলিয়াপনা, সুশাসনের শূন্যতা, দুর্নীতি আর দুর্বৃত্তায়নের বিস্তৃতি সরকারকে গণমানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। স্তাবকরা চারপাশে মাছির মতো ভিড় করে, জমা হয়, এক দুর্লঙ্ঘ প্রাচীর গড়ে তোলে। অসহায় সরকার বাস করে এক দুর্ভেদ্য make belief world-এ, এক সম্পূর্ণ বাস্তবতাবিবর্জিত অলীক জগতে। সরকারের গণবিরোধী নীতি-কর্মকাণ্ড, অত্যাচার ও নিপীড়ন অনাকাঙ্ক্ষিত তৃতীয় শক্তিকে উৎসাহী করে, পরিবেশ সৃষ্টি করে গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের গভীর অনীহার জন্ম দিতে। আর তখনই সংবিধানের বাইরে doctrine of necessity-র নামে ত্রাণকর্তা হিসেবে দেশ রক্ষা করতে সামরিক শাসনের আবির্ভাব ঘটে।
এই অনাকাঙ্ক্ষিত, অনভিপ্রেত বাস্তবতার আলোকেই বাংলাদেশের আগামী দিনের রাজনীতির ধারা নির্ভর করছে। উচ্চ আদালতের সংবিধান সংশোধনের চরম নিষেধাজ্ঞার অমোঘ রায়ের ওপরে নয়। সম্পূর্ণভাবেই নির্ভর করছে বাংলাদেশের রাজনীতিকদের ও রাজনৈতিক দলগুলোর আচার-আচরণ এবং তাঁদের চিন্তাচেতনা, মানসিকতা, গণতন্ত্রের প্রতি তাঁদের সত্যিকারের আনুগত্য ও বিশ্বাসের ওপর। তাঁদের বাস্তব কর্মকাণ্ডের ওপর। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আজ intra party democracy চর্চার চরম অভাব, party to party relation-এ আজ চরম বৈরিতা ও সীমাহীন অসহিষ্ণুতা। যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের মানুষ এমনই দেখে আসছে। এর কোনো ব্যত্যয় কখনো ঘটতে দেখেনি। স্বাধীনতার ঊষালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত একই ধারাবাহিকতা, একই কৃষ্টি, একই সংস্কৃতি, একই কালচার বহমান।
১৯৯০ সালে এক গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়েছিল। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সংসদীয় গণতন্ত্র। ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিন তিনটি সরকার দেশ শাসন করেছে। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে, বিএনপিও সরকার গঠন করেছে। ১৫টি বছর সংসদীয় গণতান্ত্রিকব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্নভাবে কার্যকর থেকেছে। দেশে তখনো সমস্যার বাহুল্যতা কমেনি। আইনশৃঙ্খলার অনেক সময় চরম অবনতিও হয়েছে। নৈরাজ্য-অস্থিরতা-অনিশ্চয়তা নেমে এসেছে। দেশবাসী অনেক হরতাল, অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াওয়ের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশে সেনাবাহিনী এই সংকটময় সময়গুলোতে under extreme provocation-এর মধ্যেও সংযত থেকেছে। সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করেছে, গণতন্ত্রকে শ্রদ্ধা জানিয়েছে, সংবিধান সমুন্নত রেখেছে। সরকারের প্রতি অনুগত থেকে পেশাগত দায়িত্ব পালনে অবিচল থেকেছে। কখনো ক্ষমতা হাতে তুলে নেয়নি। চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত, ২০০৯ সালের ২৫ থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় সংঘটিত মর্মন্তুদ চরম বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড। ৫৭ জন বুদ্ধিদীপ্ত, পেশাদক্ষ, চৌকস সেনা কর্মকর্তার হত্যা, তাঁদের স্ত্রী-কন্যাদের ওপর চরম নির্যাতন। তার পরও সেনাবাহিনী চরম সহিষ্ণুতা, সীমাহীন ধৈর্য ও গণতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেছে। দীর্ঘ ৩৬ ঘণ্টা ধরে সেনাবাহিনী, তার পরিবারের আপন সদস্যদের, কমরেড ইন আর্মসদের নারকীয় প্রতিটি হত্যার খবর জেনেছে, মুমূর্ষু আর্তনাদ, আকুল-আকুতির এসওএস শুনেছে। ট্যাংক-কামান সজ্জিত সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রসমৃদ্ধ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, কমান্ডো ও ঝটিকা বাহিনীর (storm troopers) পূর্ণাঙ্গ অপারেশনের প্রস্তুতি সত্ত্বেও ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকেছে। এক চুলও অগ্রসর হয়নি। অপরিহার্য অভিযান থেকে নিবৃত্ত থেকেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলগুলোই নির্ধারণ করবে। quo vadis আমরা কোন দিকে যাচ্ছি? একদিকে গণতন্ত্রের পথ, সত্য-সুন্দর-ন্যায়ের পথ, নৈতিকতার পথ, a thing wrong in morality cannot be right in politics-এ কথায় অবিচল বিশ্বাসের পথ। অন্যদিকে অগণতান্ত্রিক অন্যায়, অসত্য, অসুন্দর, নৈতিকতাবিবর্জিত ক্ষমতা দখলের পথ, ends justify means-এ বিশ্বাস ও অবলম্বনের পথ। সামরিক শাসনের অনুপ্রবেশ তাই আমার মনে হয় কোনো আদালতের রায়ের ওপর নির্ভর করে না, এটা রাজনীতিবিদদের ও রাজনৈতিক দলগুলোর কন্ডাক্ট, তাঁদের আচরণের বিষয়, তাঁদের চলার পথ বেছে নেওয়ার বিষয়।
অতীতে জনগণ দেখেছে মাননীয় অনেক বিচারপতি, নিজেরাই সামরিক শাসনের ঘোষণা দিয়েছেন অথবা সামরিক শাসকদের সামরিক শাসনের ঘোষণা দিতে সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন। জনগণ দেখেছে, মাননীয় অনেক প্রধান বিচারপতি পবিত্র সংবিধানকে ভূলুণ্ঠিত করে তার ওপর দিয়ে জুতা পায়ে হেঁটে বঙ্গভবনে প্রবেশ করেছেন। সামরিক শাসকদের শপথবাক্য পাঠ করিয়ে ধন্য হয়েছেন। কী বিচিত্র এ দেশ সেলুকাস!
বর্তমানে দেশে সংবিধান-সংকট বিরাজমান। সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে সরকার সংবিধান সংশোধন বিশেষ কমিশন গঠন করেছে। অবাক হওয়ার বিষয়, জাতীয় সংবিধানের মতো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ধর্মগ্রন্থের পরই পবিত্রতম দলিল সংশোধনের বিশেষ কমিশনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেই। নেই সংবিধানবিশেষজ্ঞ বিজ্ঞজনরা। নেই জাতির প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, দার্শনিক, চিন্তাবিদ ও মিডিয়া জগতের বিদগ্ধ সুধীরা। সংবিধান সংশোধন কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জনগণের অনুমোদন নিতে জাতীয় রেফারেন্ডামের জন্য উপস্থাপন করতে হবে। ডেমোক্র্যাসিওয়াচাররা মনে করেন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে সংসদকে শৃঙ্খলমুক্ত করার প্রয়োজন পড়েছে। আরো মনে করে, সশস্ত্রবাহিনী জাতির সবচেয়ে বড় সম্পদ, জাতীয় আমানত, আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের মূর্ত প্রতীক। এই মহান প্রতিষ্ঠানকে কোনোভাবেই কখনো বিতর্কিত হতে দেওয়া যাবে না। তার ঐতিহ্য ও গৌরবের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে দেওয়া যাবে না। তাকে তার আপন স্রোতধারায়, আপন গতিতে, আপন রীতিনীতি, নিয়মশৃঙ্খলা ও চেইন অব কমান্ডে চলতে দিতে হবে, বাধাহীন-প্রভাবহীন। Professionalism-ই হবে তার একমাত্র বৈশিষ্ট্য, একমাত্র পরিচিতি। বিষয়টি সংবিধানে স্থান পেতে হবে।

লেখক : সাবেক সেনাপ্রধান

No comments

Powered by Blogger.