মূল্যস্ফীতির যাঁতাকলে পিষ্ট সাধারণ মানুষ by ইফতেখার আহমেদ টিপু

মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষ দৈনন্দিন খরচ চালাতে গিয়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। এই একটি মাত্র সমস্যা সরকারের সব সুকীর্তিকে গ্রাস করার বিপদও সৃষ্টি করেছে। জনজীবনের এ সমস্যা নিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বও যথেষ্ট দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারছে না। দেশে মূল্যস্ফীতির যে বিপদ সাধারণ মানুষের ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে এ জন্য রাজনৈতিক


অস্থিরতাও কম-বেশি দায়ী। সরকার এটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে সেটি তাদের জন্য সুকীর্তি বলে বিবেচিত হতো। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো সম্প্রতি মূল্যস্ফীতির সূচক ঊর্ধ্বমুখী বলে জানিয়েছে। ব্যুরোর হিসাবে দেশের গ্রামাঞ্চলে জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ১৫ শতাংশ, যা গত ডিসেম্বর মাসে ছিল ১০ দশমিক ২৫ শতাংশ। জানুয়ারি মাসে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতির হার ছিল যথাক্রমে ১০ দশমিক ১৮ এবং ১৩ দশমিক ২৬ শতাংশ। গত ডিসেম্বর মাসে এ হার ছিল যথাক্রমে ৯ দশমিক ৬০ ও ১১ দশমিক ৬২ শতাংশ। অন্যদিকে দেশে শহরাঞ্চলে জানুয়ারি মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৭৩ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্যপণ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল যথাক্রমে ১২ দশমিক ৫৬ ও ১২ দশমিক ৯৭ শতাংশ।
পরিসংখ্যান ব্যুরো মনে করে, জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে জানুয়ারি মাসে মূল্যস্তরের ওপর। জানুয়ারি মাসে চাল, ডাল, মাছ, মাংস, ডিম, ফল, ভোজ্য তেল ও প্যাকেটজাত দুধের দাম বেড়েছে। অন্যদিকে পরিধেয় বস্ত্র, বাড়িভাড়া ও জ্বালানি তেল, চিকিৎসা সেবার খরচ, পরিবহন খাত, আসবাবপত্র ও গৃহস্থালি এবং লন্ড্রি সামগ্রীর দাম বৃদ্ধিতে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি আরেক দফা বেড়েছে। ডিসেম্বরে গড় জাতীয় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক ৬৩ শতাংশ। জানুয়ারিতে তা বেড়ে ১১ দশমিক ৫৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে এক মাসের ব্যবধানে জাতীয় মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে শূন্য দশমিক ৯৬ শতাংশ। এ ছাড়া ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরকে ভিত্তি বছর ধরার পর থেকে জানুয়ারিতে গড় খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির হারে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে জানুয়ারিতে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির হার ১৩ দশমিক ১৬ শতাংশে পেঁৗছেছে। গত ডিসেম্বরে এ হার ছিল সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। সাধারণভাবে ভর্তুকি মেটাতে সরকার ঋণ করছে বলা হচ্ছে। কিন্তু এত অল্প সময়ে এত টাকা কেবল ভর্তুকি খাতে ব্যয় করা নিয়ে তাদের মধ্যেই সংশয় রয়েছে। বড় অঙ্কের ধার দিয়েই চলতি অর্থবছরটি শুরু করেছিল সরকার। দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে নতুন অর্থবছরের মাত্র ১০০ দিনে ব্যাংক খাতে সরকারের নিট ঋণ হয় প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা। আর সর্বশেষ ১৬২ দিনে হয়েছে ১৮ হাজার ৮৫৯ কোটি ৮৮ লাখ টাকা, যার মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেওয়া হয়েছে ১০ হাজার ৭৪২ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।
উল্লেখ্য, জাতীয় বাজেটে সরকার গোটা অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে ১৮ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকার ঋণ পরিকল্পনা রয়েছে। এর আগে গেল বছরে ব্যাংকব্যবস্থায় সরকারের নিট ঋণ সব পরিকল্পনা ছাপিয়ে যায়। সে সময় ব্যাংক খাত থেকে সরকার ঋণ করে প্রায় ২০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যা ওই অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা ও সংশোধিত বাজেট লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দুই হাজার কোটি টাকা বেশি ছিল। গেল বছর সরকারের এই ঋণের প্রায় অর্ধেকটা নেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। তফসিলি ব্যাংক থেকে সরকার বেশি ঋণ করলে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রাপ্তির সুযোগ কমে আসে। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যেই সরকারকে এ বিষয়ে সতর্ক করেছে যে, বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে আর ঋণ দেওয়া যাবে না। মূল্যস্ফীতির জন্য সরকারের নীতি অবস্থানই মূলত দায়ী। দেশে কৃষি উৎপাদন গত তিন বছর ঈর্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। সার্বিক উৎপাদনও সন্তোষজনক। তার পরও মূল্যস্ফীতির কারণ ঘটছে মুদ্রানীতি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ায়। গত ডিসেম্বরে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ১৩ দশমিক ১৬ শতাংশে উন্নীত হয়। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি খরচ বেড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় সৃষ্টি হয় এ বিড়ম্বনা। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও পরিবহন চাঁদাবাজি এবং মূল্যস্ফীতিতে মদদ জুগিয়েছে। বর্তমান সরকারের সাফল্য হলো, তারা বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার সময়ও প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পেরেছে। রপ্তানি প্রবৃদ্ধি সর্বকালের রেকর্ড অতিক্রম করেছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষ সে সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সমাজের সম্পন্ন মানুষ সার্বিক উন্নয়নের সুফল ভোগ করলেও সাধারণ মানুষ তা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় তাদের কাছে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থেই সরকারকে এ বিষয়ে যত্নবান হতে হবে। নিজেদের স্বার্থেই মূল্যস্ফীতির মোকাবিলাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হবে।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক দৈনিক নবরাজ এবং চেয়ারম্যান ইফাদ গ্রুপ
chairman@ifadgroup.com

No comments

Powered by Blogger.