গোধূলির ছায়াপথে-উত্তম বাঙালি হওয়ার চর্চা by মুস্তাফা জামান আব্বাসী

শহরে নেই গোধূলি। সূর্যদেব প্রতিদিন উদীত হন তাঁর নির্ধারিত সময়ে, বিদায়ও নেন, নেই তাঁর খবর। চিনি না ভোর, চিনি না কীভাবে জেগে ওঠে পৃথিবী, কেমন করে নানা বর্ণের সমাবেশ ঘটিয়ে একটি দিনের সমাপ্তি আসে। গোধূলি নেই, সেই সঙ্গে নেই সে গানের অনুভূতি: ‘কে গো আমার সাঁঝ বেলাতে গোধূলির রং ছড়ালে’।


অভিনয় শেষে হুমায়ুন ফরীদি নায়ক আলমগীরের হাউসফুল-এ ডায়ালগ দিলেন: ‘কাট’ অ্যান্ড ‘প্যাকআপ’। এটাই ছিল আমার শোনা তাঁর শেষ ডায়ালগ। প্রথম ডায়ালগ ৩০ বছর আগে পুরানা পল্টনের একটি দোকানে, যখন শুভেচ্ছা কার্ডের দোকানের ম্যানেজার হুমায়ুন ফরীদি। বললেন, আব্বাসী ভাইয়ের কার্ডগুলো সুন্দর করে গুছিয়ে দাও। বললেন, ‘ভালো আছি। চাকরিটি নামমাত্র, সারা দিন চুটিয়ে অভিনয় করি। ওটিই পারি আর কিছু পারি না।’
অনেকেই কিছুই পারি না। সব পারির দরজায় গিয়ে টোকা দিয়ে গোধূলির সময় যখন আসে, টেলিভিশনের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাই। কত গাইয়ে, বাজিয়ে, নাচিয়ে বিদায় নিল টেলিভিশন, রেডিও, সংবাদপত্র কাউকে না জানিয়ে। কদিন আগে শুনলাম, খুরশীদ খান নেই, পরাক্রান্ত সেতার বাজিয়েদের একজন। এমনই চান মিয়া, ফেলু শেখ, নমরুদ্দিন, আলী হোসেন, ফটিক দত্ত, বেদারউদ্দিন—এঁদের নাম কাগজে বেরোয়নি।
চান মিয়া সারা জীবন দোতারা বাজিয়েছেন, গান গেয়েছেন। যন্ত্রটি বাজানো তত সহজ নয়। ওটি না বাজলে আবার ভাটিয়ালি হবে না, ভাওয়াইয়া হবে না। প্রতি সপ্তাহে রেডিওর চাকরি শেষ করে চলে আসতেন পুরানা পল্টনের বাসায়। নতুন গান শেখাতেন, দোতারাও। ওকে একবার আফগানিস্তান পাঠিয়েছিলাম, সারা জীবন ছিল তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। রেডিওর চাকরি শেষ হয়ে গেলে বললেন, সারা জীবন সংগীতের সেবা করলাম, সরকারের কাছে কিছুই পেলাম না। ক্যাজুয়েল চাকরিতে নেই পেনশন, বাসস্থান, গাড়িভাড়া, নেই অন্য কোনো সুবিধা। শিল্পীদের গোধূলিলগ্নের জন্য আপনারা কী করলেন?
তথ্যমন্ত্রীরা সবাই বন্ধু ও সজ্জন। এখন যিনি হাসিমুখ বিস্তার করেই চলেছেন, তিনিও। তাঁরা সবাই বড় বড় মালা নিলেন শিল্পীদের কাছ থেকে, সংবর্ধনা নিলেন, তাঁদের মালা নেওয়া ছবি এখনো রেডিও অফিসে অফিসে শোভা পাচ্ছে। সারা জীবন থাকবে। অথচ কিছুই করেননি তাঁরা। অ্যাবসলিউটলি নাথিং। রেডিওর ২০০ স্টাফ আর্টিস্টের দিকে তাকিয়ে নিজের প্রতি ধিক্কার হয়। কত ভালো আছি আমি, গোধূলিলগ্নে তাঁরা শেষ সাহায্যটুকু জাতির কাছ থেকে পেলেন না।
চান মিয়া মানিকগঞ্জে শেষ জীবনে একাডেমি খুলেছিলেন। বলেছিলেন, আপনার বাবার নামে করলে আপনার কোনো আপত্তি হবে? আমি বললাম, কোনোমতেই নয়। আমার বাবার নামটি আপনাদের সম্পত্তি। সরকার কিছুই করবে না, কোনো দিনও নয়। সেটা আমি একটি সাদা কাগজে লিখে দিচ্ছি। চান মিয়ার বাসায় গিয়েছিলাম সারা দিনের জন্য। তাঁর বাইরের বসার ঘরটিই আব্বাসউদ্দীন একাডেমি। দু-তিনটি দোতারা, একজোড়া তবলা, একটি হারমোনিয়াম, আমার আব্বার একটি পুরোনো ছবি। যেন আমাদের দিকে তাকিয়ে উনি হাসছেন। বলছেন, আমি বড়লোকদের নই, আমার জন্য কোনো ভবন কোনো দিন হবে না, না ধানমন্ডি, না গুলশান, না বারিধারায়। কারণ, আমি সারা জীবন কুঁড়েঘরেই জায়গা পেয়েছি। অর্থাৎ মানুষের মনের মন্দিরে। যাঁরা বড় মানুষদের কবি, তাঁদের জায়গা হবে বড় মঞ্জিলে, আমার কথা সত্যি কি না ভেবে দেখো। ঘরে জনাপঞ্চাশেক ছেলেমেয়ে গান গেয়ে উঠল, আমার পিতার ফেলে যাওয়া গান: ‘ঐ না মাধবী বনেতে ছিল সইল বন্ধু আমার কোন বনে লুকাইল’। চান মিয়া ওই ঘরে বসেই সামনের পুকুরে সবুজ পানিতে দেখতেন তাঁর ছাড়া মাছগুলো কীভাবে দিনে দিনে বড় হয়ে উঠছে। দুপুরবেলা সেই পুকুরের শিং মাছের সুরুয়া দিয়ে ভাত খেলাম, সঙ্গে আলু ভর্তা। স্বর্গীয় খাবার। না বলে চান মিয়া চলে গেলেন একদিন। এঁদের নাম কোনো দিন কাগজে ওঠেনি, উঠবে না। কারণ, এঁরা দোতারা বাজান। এঁদের কথা বলেছি জীবন নদীর উজানে গ্রন্থে।
ফেলু শেখ ফেলনা নন। আমার গাওয়া শ্রেষ্ঠ গানগুলো, বিশেষ করে বিচ্ছেদী, মারফতি, মুর্শিদী তাঁর কাছে শিখেছি, দোতারাও। তাঁর বাড়িও ছিল মানিকগঞ্জ। তাঁর ছেলেরা ভালো বেহালা বাজায়, রেডিওতে চাকরি করে, তাতে সংসারের সাশ্রয় হয়েছে। তবু ফেলু শেখের নাম একমাত্র আমার গ্রন্থ ছাড়া কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেমনটি জসীমউদ্দীনের মুর্শিদী গান ও জারি গান বই দুটি ছাড়া কোথাও তাঁর সময়ের অপরিচিত গায়কদের নাম খুঁজে পাওয়া যাবে না। সবাই ব্যস্ত তাৎক্ষণিকতার মহার্ঘ্য সুধা পানে। তবু ভালো লাগে যখন সুজেয় শ্যাম পুরস্কার পান, যখন অজিত রায় রেডিওর কাজের শেষে খবরের কাগজে ভালো জায়গা পান, যখন ঢুলিরা এসে টেলিভিশনের সামনে বাজনা বাজান।
কদিন আগে আইইউবি ক্যাম্পাসে আমাদের ছেলেমেয়েরা কাটাল বসন্ত সমাগম। হই-হট্টগোল সবই ছিল, ছিল না রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, আব্বাসউদ্দীন। ঢুলিরা কিছু পয়সা পেয়েছে, তাতেই আমি খুশি। ছেলেমেয়েরা দোতারা চিনল না, চিনল না সারেঙ্গি, তবলা, বেহালা। তাতে কী। সহজেই প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মহৎ সংগীতের পাঠ দিতে পারতাম। এতে লাভ দুটো, পড়ন্ত বিকেলের শিল্পীরা পেত একটি জীবিকা, ছেলেমেয়েরা চিনে নিত বাঙালি সংস্কৃতিকে, যেখানে থাকবে প্রমিত বাংলার উচ্চারণ, বাঙালি পোশাক। চেনা যাবে ওই ছেলেটি বা মেয়েটি বাঙালি।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.