বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৩২৮ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মিজানুর রহমান, বীর প্রতীক অসীম সাহসী এক মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দলে বিভক্ত। তাঁরা অবস্থান নিচ্ছেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের কাছে। একটি দলে আছেন মিজানুর রহমান। তিনি একটি উপদলের (প্লাটুন) দলনেতা।
তাঁদের সবার মধ্যে টানটান উত্তেজনা। হঠাৎ পাকিস্তান সেনাবাহিনী আক্রমণ করল। বিপুল বিক্রমে তাঁরাও পাল্টা আক্রমণ চালালেন। শুরু হয়ে গেল তুমুল যুদ্ধ। গোলাগুলিতে গোটা এলাকা প্রকম্পিত। রক্তক্ষয়ী সম্মুখযুদ্ধে তাঁর চোখের সামনে হতাহত হলেন কয়েকজন সহযোদ্ধা। মিজানুর রহমান দমে গেলেন না। সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকলেন। একটানা কয়েক দিন চলা যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত তাঁরাই জয়ী হলেন। এ ঘটনা আখাউড়ায়। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেটের মধ্যে রেল যোগাযোগের জন্য আখাউড়া ছিল গুরুত্বপূর্ণ এক স্টেশন। আখাউড়ার কাছেই ভারতের গুরুত্বপূণ সীমান্তবর্তী শহর আগরতলা। ১৯৭১ সালে আখাউড়ায় ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্তিশালী এক প্রতিরক্ষা অবস্থান।
মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে আখাউড়া দখলের জন্য মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী সেখানে সমাবেত হয়। যৌথ বাহিনীর পরিকল্পনা ছিল মুক্তিবাহিনীর এস ফোর্স ও মিত্রবাহিনীর মাউন্টেন ডিভিশন তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে স্বল্প সময়ের মধ্যে আখাউড়া দখলের। মুক্তিবাহিনীর এস ফোর্স ও ৩ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা উত্তর দিক থেকে আখাউড়ার দিকে অগ্রসর হন। এস ফোর্সের বি (ব্রাভো) কোম্পানির একটি প্লাটুনের নেতৃত্বে ছিলেন মিজানুর রহমান।
মুক্তিযোদ্ধারা ১ ডিসেম্বর আখাউড়ার কাছে সমবেত হওয়া মাত্র পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁদের ওপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু করে; বিমান হামলাও চালায়। এতে মুক্তিযোদ্ধারা দমে যাননি। তাঁরা নিজ নিজ অবস্থানে মাটি কামড়ে পড়ে থাকেন।
৩ ডিসেম্বর সকাল থেকে মিজানুর রহমানেরা পাল্টা অভিযান শুরু করেন। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর তাঁরা আখাউড়ার বিরাট এলাকা দখল করতে সক্ষম হন। আখাউড়ায় ৫ ডিসেম্বর সকাল পর্যন্ত যুদ্ধ হয়। এরপর গোটা আখাউড়া এলাকা মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আসে। আখাউড়ার যুদ্ধে মিজানুর রহমান যথেষ্ট সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন।
৩ ডিসেম্বরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মিজানুর রহমানের দলনেতা (কোম্পানি অধিনায়ক) লেফটেন্যান্ট বদিউজ্জামানসহ আট-নয়জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ২০ জন গুরুতর আহত হন। পাকিস্তানিদের মধ্যে ১৯-২০ জন নিহত ও অসংখ্য আহত হয়। অনেকে আত্মসমর্পণ করে।
মিজানুর রহমান চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘বি’ কোম্পানিতে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধ যুদ্ধকালে চট্টগ্রামের হাটহাজারী এলাকায় যুদ্ধ করেন। পরে ৩ নম্বর সেক্টর (আশ্রমবাড়ী-বাঘাইছড়ি সাবসেক্টর) ও এস ফোর্সের অধীনে।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মিজানুর রহমানকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১০৪।
মিজানুর রহমানের পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার রতনপুর ইউনিয়নের বাউচাইল গ্রামে। অনারারি ক্যাপ্টেন হিসেবে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি এখানেই বসবাস শুরু করেন। তাঁর বাবার নাম মো. আবদুল খালেক খান। মা মাহফুজা খানম। স্ত্রী নূরজাহান খানম। তাঁর দুই ছেলে, তিন মেয়ে।
মিজানুর রহমান দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘যুদ্ধ করে দেশটা আমরা স্বাধীন করেছি। সরকার আমাদের রাষ্ট্রীয় খেতাব দিয়েছে। কিন্তু আজকাল বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসের সরকারি অনুষ্ঠানে দাওয়াতটুকু পর্যন্ত পাই না।’
সূত্র: প্রথম আলোর নবীনগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি গৌরাঙ্গ দেবনাথ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.