ঢাকা শহরে ১০০টি স্কুলে বাস নয়, প্রয়োজন উন্নয়ন by এ এন রাশেদা

ঢাকা শহরে যানজট একটি বিভীষিকাময় সমস্যা। এখানে ১৫ মিনিটের রাস্তা পার হতে এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লেগে যায়। তবে সবসময় এবং সব রাস্তায় এক সময়ে হয় না। হয় কোনো কোনো স্কুল-কলেজের শুরু বা ছুটির সময়। আবার সিগন্যাল বাতি ছাড়া ট্রাফিক দ্বারা নিয়ন্ত্রণের সময়। রাস্তার বামে সিগন্যাল ছাড়া যাওয়ার রীতি থাকলেও কোনো কোনো


বাহন যখন পেছনের বাহনের গতিকে থামিয়ে রাখে- ইত্যাকার নানা কারণে রাস্তায় যানজট হয়। উপরের শিরোনাম দেখে মনে হতে পারে ধান ভানতে শিবের গীত কেন? আসলে একটি সমস্যার সঙ্গে আরো অনেক সমস্যা জড়িয়ে যায়। কিছুদিন আগে যোগাযোগমন্ত্রী কোনো একটি ইস্যুতে ঢাকা শহরে ১০০টি স্কুলে বাস দেওয়ার কথা ঘোষণা দিয়েছিলেন। সম্ভবত স্কুলের সামনে ছাত্রীর বাসচাপায় মৃত্যুর কারণে। ১৪ ফেব্রুয়ারি টিভি সংবাদে এক হতভাগ্য মা ক্রন্দনরত অবস্থায় বলছিলেন, 'এলাকার বাচ্চারা যেন এলাকার ভালো স্কুলে ভর্তির সুযোগ পায়'। যে কথাটি প্রায় সময় জোর দিয়ে বলার এবং লেখারও সুযোগ পেয়েছিলাম-ক্রন্দনরত মায়ের কান্না আবারও জোর দিয়ে কথাটি বলার জন্য আমাকে তাড়িত করছে। শিক্ষাবিষয়ক এক আলোচনা সভায় এলাকাভিত্তিক স্কুল সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষামন্ত্রী সম্ভবপর নয় বলে জানিয়েছিলেন। আবার সম্প্রতি 'গণসাক্ষরতা' আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় শিক্ষামন্ত্রী এলাকাভিত্তিক স্কুলের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করলেও এর বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন এবং এখনই সম্ভবপর নয় বলে উল্লেখ করলেন। আমরা মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের কথা বলি। সেই স্বপ্নের দেশের কথা বলি কিন্তু স্বপ্ন বাস্তবায়নে সঠিক পথে আমরা হাঁটতে পারি না। শুরু না করলে তো গন্তব্যে যাওয়া যাবে না। তাই এলাকাভিত্তিতে স্কুলের যাত্রা আমাদের প্রয়োজন। আমাদের দেশে জ্ঞানী-গুণী, বুদ্ধিজীবীরা কথায় কথায় ইউরোপ-আমেরিকা ভ্রমণ করেন। ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে আমাদের যে স্বাধীনতা, তার ফলেই যে তা সম্ভবপর হয়েছে-তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তারা সেসব দেশের গণতন্ত্রের কথা বলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিসহ নানা উদাহরণ হাজির করেন। কিন্তু স্কুলিং সিস্টেমের কথা বলেন না। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা সর্বত্রই এলাকার শিশুরা এলাকায়ই স্কুলে ভর্তি হয়। খুব ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে দেখা যায়, দু-একজন অভিভাবক তাঁর সন্তানকে দূরে কোথাও পড়াতে চান। যেহেতু গণতান্ত্রিক দেশ তাই তাঁদের পারমিশন নিয়ে সে ব্যবস্থা করতে হয় যা খুবই ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য। তাই প্রায় সবাই এলাকার স্কুলেই ভর্তি হয়। মোটামুটি একই মানসম্পন্ন স্কুল। শিক্ষকদের মধ্যে প্রাইমারি সেকেন্ডারির বিভাজন নেই। যে শিক্ষক প্রাইমারিতে ক্লাস নিচ্ছেন তাঁকে সেকেন্ডারিতেও পড়াতে হতে পারে। শিক্ষকদের বেতন কাঠামো ভালো। আমাদের দেশের মতো শিক্ষকদের ১০০ টাকা বাসাভাড়া আর নিম্নপর্যায়ের বেতন দেওয়া হয় না। এত কথা বলার অর্থ হলো-বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিলে শহরের স্কুলগুলোকে একই মানের আনা সম্ভব। এভাবে শিশু-কিশোররা এলাকায়ই ভর্তির সুযোগ পেলে যেমন একদিকে মা-বাবার শিশুদের স্কুলে পেঁৗছানোর ঝামেলা কমবে, পরিবারে শান্তি আসবে, যানবাহনের খরচ বাঁচবে এবং রাস্তায় যানজটও কমবে।
আজকাল প্রাইভেট পাবলিক পার্টনারশিপে মিল-কলকারখানা গড়ার কথা বলা হচ্ছে। তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয় কেন? যদিও বহু ভালো ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যক্তি উদ্যোগ বা সমষ্টিগত উদ্যোগেই গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে ক্রিশ্চিয়ান মিশনারিদের যেমন অবদান আছে তেমন এ দেশের কিছু জমিদার শ্রেণী বা বিত্তবান শ্রেণীরও অবদান আছে। উদাহরণ অনেক আছে_যেমন বিএম স্কুল, জুবলী স্কুল, কৈলাশ রঞ্জন হাই স্কুল, ভারতেশ্বরী হোমস, বিএম কলেজ, বিএল কলেজ, মুরালীচাঁদ কলেজ, কারমাইকেল কলেজ, আনন্দমোহন কলেজ, সাদাত করটিয়া কলেজ_এমন অসংখ্য নাম বলা যায় যেগুলো ব্যক্তি বা সমষ্টির উদ্যোগে গড়ে উঠেছে। এখনো শহর-গ্রামগঞ্জে হচ্ছে। মিশনারি সব স্কুলই উন্নতমানের। এসব সরকারিভাবে হয়নি। তাই অসম্ভবের কিছু নেই। এলাকার শিক্ষানুরাগী শিক্ষাবিদ ও অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল পরিবার এগিয়ে এলে তা অবশ্যই সম্ভব। তবে বাদ দিতে হবে অসৎ রাজনীতিক হস্তক্ষেপ, সমাজের টাউট, মাস্তান, বাটপার প্রভৃতি ব্যক্তিদের। আর এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে ১০০টি স্কুলের ১০০টি বাস দেওয়ার যোগাযোগমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত অর্থ। স্কুলে বাস দান স্কুল শিক্ষার মানোন্নয়ন হবে না, সংযোজিত হবে যানজটের নতুন মাত্রা। তবে রাস্তায় পাবলিক ট্রান্সপোর্ট পর্যাপ্তভাবে সব রুটে বাড়ালে এবং প্রাইভেট গাড়িকে গ্যাস রেশনিং বা বন্ধ করলে যানজট ১০০ শতাংশই কমে যাবে মাত্র এক দিনের মধ্যেই। জাতীয় অপচয়ও কমবে। একা একা বাঁচা যাবে না। বাঁচতে হবে সম্মিলিতভাবে_একাত্তরের প্রতিজ্ঞা তো সে কথাই বলে।
তাই প্রয়োজন বিদ্যমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে উন্নতমানে নিয়ে যাওয়ার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা; স্কুলবাস নামিয়ে তা সম্ভবপর হবে না। শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির সঙ্গে দেশের সার্বিক উন্নতি জড়িত, মানুষের নৈতিকতা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সবই। শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষা ক্ষেত্রের অনেক সাফল্যের কথা বলেন; কিন্তু শিক্ষা খাতে জাতীয় আয়ের ২.২ শতাংশ বরাদ্দ দিয়ে কোনো সাফল্যই ধরে রাখা যাবে না। শিক্ষকের নিয়মিত সম্মানজনক বেতন, প্রকৃত বাসাভাড়া নিশ্চিত করতে হবে। নতুবা শিক্ষামন্ত্রীকে সংসদে নিজ দলের তোপের মুখ থেকে পড়তে হবে শিক্ষকসমাজের তোপের মুখে।
লেখক : শিক্ষা গবেষক

No comments

Powered by Blogger.