বাণিজ্য মন্ত্রণালয়-বেশি খেলে বাড়ে মেদ অনাহারে নাহি খেদ by শওকত হোসেন

সত্যজিৎ রায় যে হীরক রাজার দেশে চলচ্চিত্রটা সত্য ঘটনা অবলম্বনে বানিয়েছিলেন, তা বুঝতে পারলাম এত দিন পর। পড়ে গেল সেই মন্ত্রটার কথা। বেশি খেলে বাড়ে মেদ/ অনাহারে নাহি খেদ/ যায় যদি যায় প্রাণ/ হীরকের রাজা ভগবান। এখন তো রাজা নেই। বরং, যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন, তাঁরা নিজেদের রাজাই ভাবেন, রাজমন্ত্রটাও মনেপ্রাণে মেনে চলেন।


রাজকবি অনাহারের সমস্যা সমাধান করতে এই মন্ত্র লিখে দিয়েছিলেন। আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খানও একইভাবে সমস্যার সমাধান করে দিলেন।
ফারুক খান ব্যস্ত মানুষ। অনেক দেশে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে দুই ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়ে কাজ করে একটি মন্ত্রণালয়। যেমন—মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির কার্যালয়। আরেক মন্ত্রণালয়ের কাজ দেশের মধ্যের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে। কিন্তু ফারুক খানকে দুটোই দেখতে হয়। এত ব্যস্ততায় হয়তো সব ধরনের তথ্য তাঁর জানা হয় না। যেমন—ধরেন, বাংলাদেশে ন্যূনতম খাদ্যশক্তির চেয়ে কম পরিমাণে গ্রহণকারী জনসংখ্যার হার সাড়ে ১৯ শতাংশ। অর্থাৎ দেশের প্রায় তিন কোটি মানুষ দৈনিক এক হাজার ৮০৫ কিলো ক্যালরির কম খাদ্য গ্রহণ করে। মেদ বাড়ছে বলে নয়, খাবার কেনার ক্ষমতা নেই বলে এঁরা কম খান। বাণিজ্যমন্ত্রী হয়তো অত্যন্ত সহজলভ্য এ তথ্যটা জানেন না। তাঁর হয়তো ধারণা, বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এতটাই বেড়েছে যে খেয়ে খেয়ে সবাই মেদ বানিয়ে ফেলছেন।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) ২০০৯ সালে বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। তাতে বলা হয়েছে, একজন মানুষকে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে দুই হাজার ২২২ ক্যালরি গ্রহণ করতে হয়। এর চেয়ে কম ক্যালরি গ্রহণ করে এমন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দেশে ছয় কোটি এক লাখ। এক হাজার ৮০০-এর কম ক্যালরি গ্রহণ করে এমন জনগোষ্ঠীকে বলা হয় হতদরিদ্র বা ‘আলট্রা পুওর’। এদের সংখ্যা এক কোটি ২০ লাখ। এক হাজার ৬০০-এর কম ক্যালরি গ্রহণ করে এমন মানুষ চরম দরিদ্র বা ‘হার্ডকোর পুওর’। এদের সংখ্যা তিন কোটি ১০ লাখ। আশা করছি, অতি ব্যস্ততার মধ্যেই বাণিজ্যমন্ত্রী এসব পরিসংখ্যান সংগ্রহে রাখবেন।
একই দিন অর্থাৎ গত বৃহস্পতিবার ফারুক খান আরও একটি বৈঠক করেছেন নিজ মন্ত্রণালয়ে, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। সেখানে বাণিজ্যমন্ত্রী চিনি ব্যবসায়ীদের বেশ ধমকও দিলেন। টেলিভিশনে দেখে অনেকেই ভাববেন হয়তো, কতটা কঠোর হতে পারেন তিনি। রমজানের ঠিক আগ থেকে চিনির পরিশোধন কারখানাগুলো কেন বন্ধ, তা জানতে চাইলেন বেশ রাগ করেই। আর সদুত্তর না দিতে দেখলাম ব্যবসায়ীদেরও।
দেখে অবশ্য ভালো লাগল। অবশেষে বাণিজ্যমন্ত্রী জানতে পারলেন। আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম বেড়েছে, দেশের সরকারি মিলগুলো সামান্য চিনি উৎপাদন করছে, পরিশোধন মিলগুলো বন্ধ—এ রকম এক পরিস্থিতিতে চিনির সংকট হওয়াই তো স্বাভাবিক। আর এই হচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্যমন্ত্রীর বাজার তদারকির নমুনা! চিনির দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার পর চার দিন বাজার থেকে চিনি উধাও হয়ে গেল। তারপর বৈঠক করলেন প্রধানমন্ত্রী, বাজারে কিছু চিনি ফিরে এল। তারপর আবার শুরু হলো খানিকটা সংকট। এর মধ্যে চলে গেছে ১০ দিনের বেশি সময়। এরপর দৃশ্যপটে উদয় হলেন বাণিজ্যমন্ত্রী। বৈঠক করে জানতে চাইলেন কেন মিলগুলো বন্ধ ছিল।
সরকারি মালিকানায় দেশে আছে ১৫টি চিনিকল। এসব চিনিকলের উৎপাদন-ক্ষমতা মাত্র দুই লাখ ১০ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ২০১০-১১ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে এক লাখের কিছু বেশি মেট্রিক টন চিনি। অথচ বাংলাদেশে প্রতিবছর চিনির চাহিদা ১৪ লাখ টন। সুতরাং ভরসা এখন সাতটি চিনি পরিশোধন মিল। এ সাতটি মিলের উৎপাদন-ক্ষমতা ২৪ লাখ টন। এসব পরিশোধন মিল উৎপাদন শুরু করেছে ২০০৬ সাল থেকে। আমাদের ব্যস্ত বাণিজ্যমন্ত্রী সম্ভবত পুরোনো এই তথ্যের ওপর ভরসা রেখেই তাঁর সবচেয়ে বড় কাজ সভা-সেমিনারে বক্তৃতা দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
২০০৬ সালে পরিশোধন মিলগুলোর পক্ষে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে আর কখনো চিনির সংকট হবে না। বরং রপ্তানি করতে পারবে। কিছু চিনি রপ্তানিও হয়েছিল। কিন্তু দেশের চাহিদা পূরণ নিয়ে সংকট হতে পারে—এই আশঙ্কায় এক বছর আগে চিনি রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু তাতেও কাজ হলো না। তৈরি হলো চিনির সংকট।
এবারের চিনির সংকটের জন্য ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তদারকির অভাবও সমান দায়ী। বেশি লাভ হবে না বলে কয়েকটি বেসরকারি কোম্পানি সময়মতো চিনির জন্য ঋণপত্র খোলেনি। এ কারণে পরিশোধন মিলের চারটিই ছিল বন্ধ, দুটো অল্প উৎপাদন করেছে। কেবল একটি কারখানার উৎপাদন ছিল স্বাভাবিক। এলসি খোলার সব ধরনের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) থাকে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চাইলেই সব তথ্য এনে বিশ্লেষণ করে দেখতে পারত। বোঝাই যাচ্ছে যে এ কাজটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় করেনি। আমরা দেখলাম, বাণিজ্যমন্ত্রী চারটি চিনি পরিশোধন কারখানা বন্ধের তথ্য জানলেন মাত্র গত বৃহস্পতিবার।
বাজারে যাতে প্রতিযোগিতা থাকে, একচেটিয়া বাণিজ্য না হয়, অসাধুতা না থাকে, কৃত্রিম সংকট করলে শাস্তি দেওয়া যায়—এ জন্য একটি প্রতিযোগিতা আইন করার কথা আলোচনা হচ্ছে বহুদিন ধরে। ১৯৯৪ সালে প্রথম এ ধরনের একটি আইনের খসড়া তৈরি করেছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু ব্যবসায়ীদের চাপে তা আর আলোর মুখ দেখেনি। এরপর বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালে আবার প্রতিযোগিতা আইন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১০ সালের শুরুতেই আইনটির খসড়া তৈরি হয়েছিল। তার পর থেকে আর খবর নেই আইনটির। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এটিও লুকিয়ে রেখেছে। আবারও বলা যায়, ব্যবসায়ীদের স্বার্থটাই এখানে বেশি দেখছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
এবার আসা যাক টিসিবি প্রসঙ্গ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আরেক ব্যর্থতার নাম টিসিবি। টিসিবিকে শক্তিশালী করার গল্প বহুদিন ধরে আমরা শুনে আসছি। গত জোট সরকার টিসিবিকে শক্তিশালী করার কথা বলেছে, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারও বলেছে; এখনো বলা হচ্ছে। কিন্তু টিসিবি আর শক্তিশালী হয় না। টিসিবি নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কখনোই আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করেনি। টিসিবির সক্ষমতা সামান্যতম বাড়ানো হয়নি। অথচ বারবার সরকার থেকে বলা হয়, টিসিবি পণ্য আনবে, বাজার স্থিতিশীল থাকবে। এখন পর্যন্ত টিসিবির মাধ্যমে বাজারকে প্রভাবিত করার একটি নজিরও খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাজারে প্রভাব ফেলতে হলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পণ্য আমদানি করতে হয়। সেই যোগ্যতাও টিসিবির নেই। আবার ব্যবসায়ীদেরও একটি অংশ শক্তিশালী টিসিবিকে দেখতে চায় না। সরকার তাদেরই ইচ্ছাপূরণ করে আসছে। আর দলীয় লোকদের ডিলার বানিয়ে টিসিবির মাধ্যমে রাজনৈতিক স্বার্থটুকু ঠিকই আদায় করে নিয়েছে সরকার। অক্ষম টিসিবি বাজারে কার্যকর ভূমিকা রাখবে, ফলে বাজার স্থিতিশীল থাকবে বলে যাঁরা আশা করেন, তাঁরা স্বপ্ন দেখছেন। যাঁরা এসব প্রচার করেন তাঁরা যথেষ্ট পরিমাণ স্বপ্নবিলাসী কিংবা বিভ্রান্তকারী। ঠিক এ কাজটিই করে আসছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে অর্থনীতির যে সূচকটি দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে, সেটি হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত একটি সরকারের জনপ্রিয়তার বড় মাপকাঠি হয়ে আছে এই মূল্যস্ফীতি। এ বিষয়ে সবশেষে জার্মান অর্থনীতিবিদ রুডিগার ডরনবুশের তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, বিশ্বব্যাপী সরকারগুলোর শাসনামলে অর্থনৈতিক বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীরাই মন্ত্রিসভার রদবদলের শিকার হন সবচেয়ে বেশি এবং তাঁদের মন্ত্রিত্বের মেয়াদকালের সঙ্গে মূল্যস্ফীতির হারের নেতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশ সম্ভবত এই গবেষণার বাইরে রয়ে গেছে।
শওকত হোসেন: সাংবাদিক।
shawkat.masum@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.