কালের পুরাণ-হাসিনা-খালেদা: কেউ কথা রাখেননি by সোহরাব হাসান

নবদূতের আশা ও আশঙ্কা বিকল্প গণমাধ্যম হিসেবে পরিচিত উইকিলিকস যখন বাংলাদেশের রাজনীতির অন্দরমহলের খবর জনসমক্ষে ফাঁস করে দিচ্ছে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও মিশন কর্মকর্তাদের বরাতে, তখন অপেক্ষমাণ রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মোজেনা সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটিতে যা বলেছেন, তা কম তা ৎপর্যপূর্ণ নয়।


এই অভিজ্ঞ মার্কিন কূটনীতিক শুনানিকালে বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর আশাবাদের পাশাপাশি আশঙ্কার কথাও ব্যক্ত করেছেন। সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, মাতৃমৃত্যুর হার কমানো এবং বহির্বিশ্বে উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের সাফল্যের প্রশংসা করেছেন তিনি। এর পরই মোজেনা বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ হিসেবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা, দুর্নীতি, বৈরী ও সংঘাতময় রাজনীতি এবং নাগরিক সমাজের প্রতি সরকারের অস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির কথা উল্লেখ করেছেন।
মোজেনা ১৯৯৮-২০০১ সালে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাউন্সিলর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর ধারণা ও পর্যবেক্ষণ নিছক পুঁথিগত নয়, নিজের অভিজ্ঞতার আলোকেই তিনি তাঁর নতুন কর্মস্থলসম্পর্কিত পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন তুলে ধরেছেন।
উইকিলিকসের মাধ্যমে আমরা যেসব তথ্য-উপাত্ত পাচ্ছি, তাতে স্পষ্ট, তাঁর পূর্বসূরি জেমস এফ মরিয়ার্টি, প্যাট্রিসিয়া এ বিউটেনিস, হ্যারি কে টমাসও বাংলাদেশের রাজনীতির এই ব্যাধিগুলো চিহ্নিত করেছিলেন। যে বৈরী রাজনীতি ১/১১-এর অঘটনের জন্ম দিয়েছিল, নেতা-নেত্রীদের ওপর যে ঝড় বইয়ে দিয়েছিল, আশা করা গিয়েছিল, সেসব থেকে তাঁরা শিক্ষা নেবেন। কিন্তু বৈরী রাজনীতির অবসান দূরের কথা, এখন এক পক্ষ অন্য পক্ষের ধ্বংসের মধ্যে নিজের বিজয়কেতন ওড়াতে চাইছে। তারা গণতন্ত্র বলতে বোঝে সবকিছু নিজের মতো করে চলা। যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় যাওয়া অথবা থাকা।
মোজেনা দ্বিতীয় যে চ্যালেঞ্জের কথা বলেছেন, সেটি হলো দুর্নীতি। সেনাসমর্থিত সরকার দুর্নীতি দমনের নামে রাজনীতি দমনের যে পথ বেছে নিয়েছিল, তা আমরা সমর্থন করিনি, তার উদ্দেশ্য স ৎ ছিল না। কিন্তু দেশের রাজনীতি যে দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও কালোটাকার দ্বারা কলুষিত হচ্ছে, সে কথা অস্বীকার করা যাবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভুল ছিল, তারা এক দল রাজনীতিকদের গায়ে কালিমা লেপন করে আরেক দলকে দিয়ে ‘কিংস পার্টি’ গঠন করতে চেয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চেয়েও এ ব্যাপারে উ ৎসাহ ছিল গোয়েন্দা সংস্থার কর্তাব্যক্তিদের; যাঁরা শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং হবে, সে খবর মার্কিন দূতাবাসে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তাঁরা দুর্নীতির অবসান চাননি। রাজনীতির অবসান চেয়েছিলেন। কিন্তু সে সময়ে রাজনীতিক, আমলা, ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির অভিযোগের সবটাই যে মনগড়া ছিল না, তা সরকারই স্বীকার করে নিয়েছে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো জীবিত রেখে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের সব নেতার মামলা প্রত্যাহারের যুক্তি কী? তাঁরা কি সবাই ধোয়া তুলসী পাতা? শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভা গঠনকালে কেবল সংস্কারবাদীদেরই বাদ দেননি, বাদ দিয়েছেন আগের আমলে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত অনেক নেতাকেও, যাঁদের কেউ কেউ তত্ত্বাবধায়ক আমলে নির্যাতিত হয়েছিলেন। দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় অনেকে দলীয় মনোনয়নও পাননি। কারও নামে মামলা দিলেই যেমন দুর্নীতিবাজ হয়ে যায় না, তেমনি কারও দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহার হলেও সে সাধু হয় না।
মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর রাজনৈতিক নেতৃত্ব যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিল, তার পরিণাম আমরা দেখলাম স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনের হাত-পা বেঁধে ফেলে তাকে নখদন্তহীন এক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে। মাঝেমধ্যে বিরোধী দলের কোনো নেতা বা পুঁচকে আমলার বিরুদ্ধে মামলা জারি রেখে নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করলেও দুদক জনগণের আস্থা লাভে ব্যর্থ হয়েছে।
নতুন রাষ্ট্রদূত তৃতীয় যে চ্যালেঞ্জের কথা বলেছেন, তা হলো সুশাসন। সুশাসনের অর্থ কী? যে শাসন নাগরিকদের মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা দেয়, যে শাসন রাগ-অনুরাগের বাইরে জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করে। কিন্তু আমাদের কথিত গণতান্ত্রিক সরকারগুলো সুশাসনের প্রাথমিক শর্তটুকু পূরণেও বরাবর অনীহা দেখিয়ে আসছে। এমনকি এর বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজ প্রতিবাদ করলেও সরকার একহাত নিতে দ্বিধা করে না। গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের কণ্ঠরোধ করে কোনো দেশে গণতান্ত্রিক শাসন চলতে পারে না।
বন্দুকযুদ্ধে মানুষ খুন কিংবা বিচার বিভাগের ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ—যা-ই বলি না কেন, সরকারের নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে বলা হয়, এসব বিএনপির আমলেও হয়েছে। অর্থা ৎ বিএনপি সরকার খারাপ করে থাকলে আওয়ামী লীগ সরকারেরও তা করার অধিকার আছে। ভবিষ্যতে বিএনপি ক্ষমতায় এলেও অনুরূপ উদাহরণ দেবে, বলবে, আওয়ামী লীগের আমলেও এসব ছিল। এই আত্মঘাতী ও দেশঘাতী রাজনীতিই পালাক্রমে দুই দল চালিয়ে আসছে।
ক্ষমতাসীনেরা যদি মনেই করে বিএনপি দুর্নীতি, সন্ত্রাস, দলীয়করণ করে খারাপ করেছে, তাহলে আওয়ামী লীগের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হওয়া উচিত ছিল সেসব পরিহার করা। একইভাবে বিএনপিও বলতে পারত, বিরোধী দলে থাকতে আওয়ামী লীগ উপর্যুপরি হরতাল পালন করে দেশের অনেক ক্ষতি করেছে, তারা সেই ধ্বংসাত্মক রাজনীতি করবে না। কিন্তু সরকার যেমন আগের সরকারের খারাপ দৃষ্টান্তগুলো বেছে নিচ্ছে, তেমনি বিরোধী দলও আগের বিরোধী দলকে অন্ধভাবে অনুসরণ করছে। বিষয়টি অনেকটা চোর-পুলিশ খেলার মতো, যার খেসারত দিতে হচ্ছে দেশবাসীকে।

কেউ কথা রাখেননি
উইকিলিকসের মাধ্যমে পাওয়া সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টির কয়েকটি বার্তা আমাদের রাজনীতির হাঁড়ির খবর ফাঁস করে দিয়েছে। এসব বার্তা পাঠানো হয়েছিল ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে, পরে এবং ২০১০ সালের জানুয়ারিতে, অর্থা ৎ তখন আওয়ামী লীগ সরকারের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। সেসব তারবার্তায় আশাবাদের চেয়ে হতাশাই বেশি ফুটে উঠেছে।
২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ১৩ অক্টোবর খালেদা জিয়ার সঙ্গে গুলশানে তাঁর নতুন অফিসে (তখন আর হাওয়া ভবন নেই) দেখা করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টি। শেখ হাসিনার সঙ্গে মরিয়ার্টির সাক্ষা ৎ হয় নির্বাচনের দুই সপ্তাহ আগে।
খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকের কথা উল্লেখ করে মরিয়ার্টি লিখেছিলেন, বিএনপি যদি আগামী নির্বাচনে হেরেও যায়, তাহলে বিরোধী দল হিসেবে তারা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। খালেদা জিয়া সে রকম আশ্বাসই তাঁকে দিয়েছেন। একই সঙ্গে সংঘাতের রাজনীতিরও নিন্দা করেন তিনি।
মরিয়ার্টির বার্তা থেকে আমরা আরও জানতে পারি, সে সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টারা রাজনৈতিক আচরণবিধি এবং নির্বাচন-পরবর্তী সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দুই শীর্ষ নেত্রীর বৈঠকের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। উপদেষ্টারা চেয়েছিলেন, বাংলাদেশে ঐতিহ্যগতভাবে বিজয়ীরা যে সব কিছু দখল করে নেয়—এই ধারার অবসান ঘটাতে।
খালেদা জিয়া মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে বলেছিলেন, এ ধরনের বৈঠকে তাঁর আপত্তি নেই। অন্যদিকে শেখ হাসিনা এ ধারণাকে খোলামন নিয়ে বলেছিলেন, দলীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপ না করে তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।
এরপর মরিয়ার্টি আরেক বার্তায় লিখেছেন, শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ মহল নির্বাচনের আগে দুই নেত্রীর বৈঠকের বিরোধী। এরপর আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় প্রধান নেতা মরিয়ার্টিকে বলেছিলেন, নির্বাচনের আগে তাঁদের বসতে আপত্তি নেই। কিন্তু প্রথমে দুই দলের মধ্যে সমঝোতার বিষয়গুলো চিহ্নিত করা প্রয়োজন। তিনি আরও বলেছিলেন, গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনই রাজনৈতিক সংস্কারের সুযোগ সৃষ্টি করবে। আওয়ামী লীগের ওই নেতা সমঝোতার লক্ষ্যে সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করা এবং সংসদ কার্যকর করার লক্ষ্যে দলীয় অবস্থানের পক্ষে সাংসদদের ভোট দেওয়ার বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়ার পদক্ষেপ সমর্থন করেন বলে জানিয়েছিলেন।
নবম সংসদ নির্বাচনের দুই সপ্তাহ আগে শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের কথা উল্লেখ করে মরিয়ার্টি জানান, বিএনপির উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহ রেখেও শেখ হাসিনার দৃঢ় আস্থা ছিল, বিএনপি নির্বাচনে যাবে এবং সংসদীয় কার্যক্রমেও অংশ নেবে। তিনি এও বিশ্বাস করতেন, ভোটাররা তাঁকেই ক্ষমতায় আনবেন এবং বিরোধী দলকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় শরিক করতেও তিনি সক্ষম হবেন।
এরপর মরিয়ার্টির মন্তব্য হলো, যেভাবে আশা করা গিয়েছিল এবং রাজনীতিকেরা ওয়াদা করেছিলেন, সেভাবে পরবর্তী ঘটনা অগ্রসর হয়নি। নির্বাচনে হারের পর বিএনপি বছরের অধিকাংশ সময় সংসদের বাইরে ছিল। প্রথমে তারা সংসদের আসন বণ্টনের অজুহাত দিয়েছিল, পরবর্তীকালে ১০ দফা দাবি পেশ করে।
অন্যদিকে সরকারি দল স্থানীয় সরকারসহ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনেক সংস্কার কর্মসূচি বাতিল করে দেয়। যদিও তখন সংসদীয় কমিটিগুলো গঠিত হয়েছে এবং সক্রিয় আছে, তার পরও সামগ্রিক বিচারে সংসদের ভূমিকা হতাশাব্যঞ্জক।
মরিয়ার্টির বার্তা থেকে আরও জানা যায়, বিরোধী দলের ক্ষমতায়নেরও একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তাদের ডেপুটি স্পিকারের পদ এবং গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সংসদীয় কমিটির সভাপতির পদ দেওয়ারও কথা ছিল।
গণতান্ত্রিক দেশে সরকারি হিসাব কমিটিসহ গুরুত্বপূর্ণ কমিটিগুলোর প্রধান করা হয় বিরোধী দল থেকে। কিন্তু বাংলাদেশে বিরোধী দলকে সে সুযোগ দেওয়া হয়নি। প্রতিশ্রুতিমতো ডেপুটি স্পিকারের পদটিও তারা পায়নি। দুটি কম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভাপতির পদ দেওয়া হয়েছে।
২০১০ সালের ১০ জানুয়ারি পাঠানো বার্তায় মরিয়ার্টির মন্তব্য হলো: সংসদকে কার্যকর করা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দুই দলের যে নির্বাচনী ওয়াদা ছিল, তা থেকে তারা সরে গেছে। পুরো সংসদই এখন হতাশাজনক। দুই দলের বিরোধের প্রধান কারণও দুই নেত্রী।
মরিয়ার্টি আরও বলেন, দুই প্রধান দলের সংঘাত ২০০৬ সালের শেষ দিকে দেশকে গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল এবং সর্বস্তরের মানুষ রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনের পক্ষে সোচ্চার হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। নির্বাচনী ইশতেহারে দুই দলই সংসদকে কার্যকর এবং সংসদ বর্জনের সংস্কৃতি পরিহার করার কথা বলেছিল। সংঘাতময় রাজনৈতিক সংস্কৃতি অবসানের লক্ষ্যে তারা একটি নীতিমালা তৈরির ওয়াদাও করেছিল। অদ্যাবধি সেই নীতিমালা প্রণীত হয়নি এবং ২৪১ দিনের অধিবেশনের মধ্যে বিএনপি ১৯০ দিনই সংসদ বর্জন করে। অর্থা ৎ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার ভাষায়, ‘কেউ কথা রাখেনি’।
সোহরাব হাসান: সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.