একটি ভয়াবহ বর্ণবাদী দাঙ্গা : এক দশক পর বাঙালির অবস্থান by ফারুক যোশী

এক দশক আগে একটা ভয়াবহ সময় অতিক্রম করেছিল সারা ওল্ডহ্যাম শহর। সে এক ছোট্ট ঘটনা, দুটি বালকের মধ্যে তর্কাতর্কি। এর পরের ইতিহাস জন্ম দিয়েছিল দীর্ঘ ট্র্যাজেডির। পৃথিবীর লাখ লাখ মানুষ জেনেছিল এক বর্ণবাদী দাঙ্গার আগুন জ্বলছে ওল্ডহ্যামে। এশিয়ান পরিবারের দরজা ভেঙেছে সাদা যুবকরা। এশিয়ান পরিবার হয় আগুনবোমার শিকার।


আগুনে পোড়ে সাদাদের মদের দোকানগুলো। আজ থেকে ১০ বছর আগের ২৬ মে থেকে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ওল্ডহ্যাম শহরটি হয়ে ওঠে পুলিশের শহর। এশিয়ানরা তাদের জাত্যভিমানে একটি এরিয়াকে 'নো গো' এলাকা করেছে সে সময়। এই 'প্রবেশ নিষেধ' এলাকায় ঢোকার অপরাধে (!) ৭৬ বছরের চ্যাম্বারলিনের রক্তভেজা মুখমণ্ডল দেখে বিশ্ব। বিস্মিত হয় মানুষ। সেই আগুন ছড়িয়ে যায় ওল্ডহ্যাম থেকে বার্নলি, বার্নলি থেকে লিডস, নর্থ-ওয়েস্ট ইংল্যান্ডের শহরে শহরে। জুন মাসব্যাপী। হিংস্রতা থামাতে শত শত পুলিশ নামে শহরটিতে। বিক্ষুব্ধ মানুষের পাশাপাশি অন্তত ৮২ পুলিশ আহত হয় এ দাঙ্গায়। বাঙালি-পাকিস্তানি শ্বেতাঙ্গ মিলে শত শত মানুষ গ্রেপ্তার হয় সে সময়। উত্তেজনা প্রশমন, আইনি খরচসহ সব মিলিয়ে সরকারকে ব্যয় করতে হয় ২ দশমিক ২ বিলিয়ন পাউন্ড।
২. আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে ব্রিস্টল শহরের সেন্টপোলস এলাকায় কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে শ্বেতাঙ্গ মানুষের দাঙ্গা বাধে। রূপ নেয় কালো-সাদা বর্ণবাদী দাঙ্গা। একপর্যায়ে এই দাঙ্গাকে কালোরা তাদের বিদ্রোহ হিসেবেই নেয়। ছড়িয়ে পড়ে লন্ডন-ম্যানচেস্টারসহ ইংল্যান্ডের বিভিন্ন জায়গায়। সরকারকে তখন বেশ বেগ পেতে হয়েছিল এ বিদ্রোহ দমাতে। সত্যি কথা বলতে কী, কালোরা তাদের অস্তিত্ব জানান দেয় বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে। ঠিক সেভাবেই লন্ডনেও আলতাব আলীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাঙালিরা নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। এখনকার ইতিহাস তো সবার জানা। আর ঠিক সেভাবেই ওল্ডহ্যামের বর্ণবাদী এ দাঙ্গা এশিয়ানদের নড়েচড়ে বসায়। এশিয়ানদের অনেকেই মনে করে, এই দাঙ্গা তাদের এ দেশে টিকে থাকার অস্তিত্বের সংগ্রাম ছিল। আদালত-জেল-গ্রেপ্তার কিংবা মিডিয়ার নেতিবাচক প্রচারণা_এত কিছু থাকা সত্ত্বেও এশিয়ানরা নর্থ-ওয়েস্ট ইংল্যান্ডে তাদের অবস্থান করেছে সুসংহত। ১০ বছর আগে সংঘটিত সেই বর্ণবাদী দাঙ্গার পর বর্ণবৈষম্য বেড়েছিল। অস্থিরতাও ছিল দীর্ঘদিন। বাঙালি ব্যবসায়ীরা সাদানির্ভর এলাকায় ব্যবসা হারায়। পুরো এলাকাটি এতই অরক্ষিত হয়ে যায় যে ঘর-দুয়ারের মূল্য কমে যায়, বাড়ে ইন্স্যুরেন্স। এ এলাকার ইন্স্যুরেন্স এখনো চড়া। দিন গড়ায়। ওল্ডহ্যামজুড়েই বাড়তে থাকে অস্থিরতা। বর্ণবৈষম্য যেন বাড়তেই থাকে। সেই অস্থিরতার খেসারত দিতে হচ্ছে এখনো ওল্ডহ্যামের মানুষকে। ক্রমেই সময় বয়ে যায়। স্বাভাবিক জীবনের স্পন্দন এসেছে ওল্ডহ্যামে। কিন্তু এশিয়ান কিংবা নন-এশিয়ান মানুষগুলো কি ফিরে পেয়েছে তাদের সেই পুরনো সৌহার্দ্য? স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে এশিয়ান জনগোষ্ঠীর সম্পর্ক কতটুকুইবা স্বাভাবিক! তারা কি কখনো প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে শিকার হচ্ছে শ্রেণীবৈষম্যের! অন্যদিকে এশিয়ান নয়, এমন মানুষদের সঙ্গে আমাদের কমিউনিটির সম্পর্কইবা কতটুকু প্রসারিত হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন করে অনেকেই। এ প্রশ্ন আমাদেরও। এ প্রশ্নগুলো আছে বিধায়ই আমরা আজ উত্তরের সন্ধান করছি। ওল্ডহ্যাম দাঙ্গার পর ডেভিড রিচিকে চেয়ারম্যান করে সরকারের সহযোগিতায় যে রিপোর্ট বেরিয়েছিল, তাতে উল্লেখ ছিল দানা বাঁধা ক্ষোভের কথা। বিভিন্ন কমিউনিটি বিশেষত এশিয়ান আর সাদা কমিউনিটির পারস্পরিক ঘৃণাবোধ কিভাবে একটি মাল্টিকালচারাল কমিউনিটির মধ্যে তিক্ততার জন্ম দিয়েছে, কিভাবেই বা বেড়ে উঠেছে তা দিনের পর দিন। রিচি কমিশন অন্তত ২০০টি গ্রুপ মিটিংয়ের মাধ্যমে ৯১৫ জন মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছে আর তারই মধ্য দিয়ে বেরিয়েছিল ১০২ পৃষ্ঠার রিপোর্ট। পাঁচ বছর পর প্রফেসর কেন্টলের নেতৃত্বে বেরিয়েছিল আরেকটি রিপোর্ট। সেখানেও সেই একই চিত্র। পাঁচ বছরে কোনোই পরিবর্তন আসেনি। আসেনি কমিউনিটির ঐক্য। বরং বিচ্ছিন্নতা বেড়েছে। যদিও কেন্টল তাঁর রিপোর্টে মুসলিম উগ্রপন্থীদের উত্থান ঘটতে পারে বলে ভেবেছিলেন, তা কিন্তু হয়নি। অবশ্য তিনি বর্ণবাদী ইংলিশ ডিফেন্স লিগের উগ্রতার কথাও তুলে এনেছিলেন। কিন্তু বলতে গেলে মৌলবাদী মুসলিম কিংবা উগ্র বর্ণবাদী ইডিএল_কোনোটাই এখানে কল্কে পায়নি। ১০ বছরের মাথায় এসেও সমস্যা একই রয়ে গেছে। এশিয়ান কিংবা সাদারা যেন একই স্রোতে মিলিত হতে পারছে না। অথচ অন্তত এক দশক পর আজ এই কমিউনিটিতে কমিউনিটির সহাবস্থান খুবই প্রয়োজন। যে কথাগুলো উচ্চারণ করেছেন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী যেমন পাকিস্তানি এবং বাঙালি কমিউনিটির জনপ্রতিনিধি ও মূলধারার স্থানীয় রাজনীতিবিদরা। তাঁরা একবাক্যে স্বীকার করছেন, কমিউনিটি কোহেশন কিংবা ঐক্যটা এখনো আসেনি। যা এসেছে তা হলো এক ধরনের ভাসা ভাসা ঐক্য।
৩. শুধু ওল্ডহ্যামেই প্রায় ২২ হাজার বাঙালির বাস। বলতে গেলে পূর্ব লন্ডনের পর ওল্ডহ্যামই বাঙালিদের আরেক ভিত্তি। আর তাই এই দাঙ্গার সঙ্গে বাঙালিদেরও জড়িয়েছিল টিকে থাকার সম্পর্ক। এখানকার প্রশাসনিক ক্ষমতায় বাঙালিদের অবস্থান উল্লেখ করার মতো হলেও সংখ্যা আরো বেড়ে যাওয়া উচিত ছিল। মাত্র তিনজন বাঙালি কাউন্সিলর। অথচ এখানে সম্ভাবনা আছে প্রচুর। পূর্ব লন্ডনের মতো এখানে মেধাবী নতুন প্রজন্ম রাজনীতিতে আসছে না। পুরনোরা নতুনদের উদ্বুদ্ধও করছেন না। শুধু ক্ষমতাকে এক বিন্দুতে ধরে রাখার প্রয়োজনে রাজনীতির দাবার ঘুঁটি এখানে প্রতিনিয়ত হারিয়ে দিচ্ছে বাঙালিদের। আর এটা হচ্ছে কিছু বাঙালি নেতার কারণেই। পাকিস্তানিরা এ শহরে ঠিকই উঠে আসছে। তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি বাড়ছে প্রতিনিয়ত এবং বাঙালিদের পূর্ব লন্ডনের মতো এখানে মেধাবী পাকিস্তানিরা জায়গা করে নিচ্ছে। ব্রিটেনের প্রতিযোগিতামূলক জায়গায় খুব স্বাভাবিকভাবেই গ্রাম্য মানসিকতা মার খাওয়ার কথা। কিন্তু ওল্ডহ্যামের বাঙালিরা গ্রাম্য ফ্যাসাদকে পুঁজি করে এখনো মূলধারার রাজনীতিতে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের হিসাব-নিকাশ করছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। লেবার, টোরি কিংবা লিব ডেমের বাঙালি নেতাদের তা ভাবনায় নিতেই হবে। মনে রাখতে হবে, নেতৃত্ব সৃষ্টি না হলে একসময় তাঁরাও একা হয়ে যাবেন। তখন আর ক্ষমতা আঁকড়ে রাখা যাবে না। কারণ মূলধারার রাজনীতি মানে শুধু তো কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়া নয়। পার্টির ভেতরে শুধু একটা ভোটের কারণে গত উপনির্বাচনে বাঙালি এমপি প্রার্থী হতে পারেননি। একটা ভোট পেলে মাত্র দুই মাস আগের উপনির্বাচনে লেবার পার্টির প্রার্থী হতেন বাঙালি। আর পরের ইতিহাস ওল্ডহ্যামের বাঙালিরা জানেন। কারণ গত উপনির্বাচনে ওই প্রার্থীই জিতেছেন। গ্রাম্য মানসিকতা এখানে কাজ না করলে, পার্টিতে কর্মী কিংবা গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে পারলে একটা ভোট কোনো ইস্যুই হয়তো ছিল না। আর তাই আমরা চাই, আমাদের কমিউনিটির ঐক্য। এই ওল্ডহ্যাম শহর বিভিন্ন জাতি আর গোষ্ঠীর মিলিত কণ্ঠস্বরে জেগে ওঠে প্রতিদিন। এই কণ্ঠস্বরকে আমাদের জাগরূক
রাখতে হবে।
লেখক : লন্ডনপ্রবাসী সাংবাদিক
Faruk.joshi@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.