বাংলা ও বাঙালি-আমাদের অহেতুক বিদেশপ্রীতি by আবদুল মান্নান

বাঙালির বিদেশপ্রীতি ঐতিহাসিক। এর কারণ সম্পর্কে কোনো গবেষণা আছে বলে মনে হয় না। যদিও উপমহাদেশে কয়েক শ বছর আগে বিদেশিদের আগমন, তথাপি সে আমলে বিশ্বে উন্নত দেশ বলতে দুটি দেশকে বোঝানো হতো। একটি চীন আর অন্যটি ভারতবর্ষ। শুরুতে আরবরা এসেছিল।


তাদের পথ ধরে পর্তুগিজ, ইংরেজ, আরমেনীয়, ফরাসি, ডোমিনিকান, ওলন্দাজ প্রমুখ। সবাই এসেছিল বণিক হিসেবে, বাণিজ্যের খোঁজে। এই বাণিজ্য ছিল একমুখী। ভারতবর্ষ থেকে পশ্চিমমুখী। আরব বা ইউরোপ থেকে এই উপমহাদেশে আনার মতো কিছুই ছিল না। পর্যায়ক্রমে পুরো উপমহাদেশটাই তো দখল করে নিল ইংরেজ বণিকেরা। তাদের ২০০ বছরের শাসনকালে উপমহাদেশের সব উৎপাদনক্ষমতাকে ধ্বংস করে দিয়ে পুরো ভারতবর্ষকেই তারা তাদের উৎপাদিত পণ্যের বাজারে পরিণত করে ফেলে। এরই মধ্যে দেশে তৈরি হলো একশ্রেণীর সাহেব, যাদের গায়ের রং বাদামি কিন্তু মনেপ্রাণে ইংরেজ হওয়ার আকুল চেষ্টা। ইংরেজরা নিজ দেশে ফেরত গেছে প্রায় ৬৪ বছর আগে। তাদের এখন পড়ন্ত বেলা। তার পরও আমাদের দেশের একশ্রেণীর মানুষ আছে যারা এখনো শুধু ইংরেজপ্রীতিই লালন করে না, উপরন্তু কারণে-অকারণে যা কিছু বিদেশি তার প্রেমে পড়ে যায়। সে বিদেশটা পাশের দেশ ভারতও হতে পারে অথবা দূরের যুক্তরাষ্ট্র বা জাপান। অবশ্য বিশ্বায়নের এই যুগে এটি হওয়াটা বিচিত্র নয়। তবে যেটি শঙ্কার বিষয় সেটি হচ্ছে কারণে-অকারণে বিদেশি পণ্য, ব্যক্তি বা অন্য কিছুর ওপর মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি।
প্রথমে একটি মজার কিন্তু সত্য ঘটনা বলি যেটি আমি আগেও বলেছি। ঢাকার উপকণ্ঠে একটি বাড়ির সামনে ছোট সাইনবোর্ডে লেখা ‘এই বাড়ীটি বিদেশী কুকুর দ্বারা পাহাড়া দেওয়া হয়’। অবস্থা এমন হয়েছে যে আমরা আমাদের কুকুরের পাহারা দেওয়ার সক্ষমতার ওপরও আস্থা হারিয়ে ফেলেছি। বাংলাদেশে এখন ভারতের আইপিএল আদলে বিপিএল নামের একটি টি টুয়েন্টি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চলছে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে এটি কী অবদান রাখবে তা আমার মতো এখনো অনেকের কাছে বোধগম্য নয়। চিন্তা করলাম, দেখি না উদ্বোধনটা কেমন হয়! হাজার হলেও মহামান্য রাষ্ট্রপতি উদ্বোধন করবেন। রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান আমার একজন প্রিয় ব্যক্তি। উদ্বোধনটা আবার ভ্যালেন্টাইনস ডেতে। ওটা ইউরোপ-আমেরিকায় দীর্ঘদিন ধরে ভালোবাসা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বিশ্বায়নের এই যুগে তা আমাদের দেশেও জায়গা করে নিয়েছে। এটি পালন করা উচিত নাকি উচিত নয় তা নিয়ে অনেককে তর্ক করতে দেখেছি। তবে ভালোবাসা খারাপ কিছু নয়। এই দিবসের আবার একটা অর্থনীতি আছে। কয়েক কোটি টাকার নাকি শুধু ফুল বিক্রি হয়। আবার আমাদের ভালোবাসা দিবস আর পয়লা ফাল্গুন পাশাপাশি দিনে। পশ্চিমবঙ্গে তা একই দিনে। দিনটি নিয়ে সেখানে তেমন একটা হইচই চোখে পড়েনি। বাংলাদেশের বাঙালিরা ওপারের বাঙালিদের চেয়ে অনেক কিছুতে এগিয়ে আছে। ওই ভালোবাসা দিবসেই বিপিএলের উদ্বোধন। টিভির সামনে জুত হয়ে বসি। পর্দায় ভেসে আসে আমাদের শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়াম। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট জগতে ‘হোম অব ক্রিকেট’ হিসেবে পরিচিত। শুরুতেই হোঁচট খেলাম। ওমাঃ পুরো স্টেডিয়ামই তো দেখি ফাঁকা! বন্ধুকে ফোন করি। তার সোজাসাপ্টা উত্তর। আরে ভাই, এসব বিপিএল, মেসিকে এনে ফুটবল খেলা তামাশা বা শাহরুখ খান শো—সবই হচ্ছে কালো টাকা সাদা করার ফন্দি। চিন্তায় পড়ে গেলাম। তবে অবাক হওয়ার বাকি ছিল। একটু পরে টেলিভিশনে এক অপরিচিত সুন্দরী মহিলার চেহারা ভেসে এল। প্রথমে বেশ উৎফুল্ল হই। তাহলে আমাদের দেশের মহিলারাও এখন ক্রিকেটে মনোযোগী হয়েছে। বেশ ভালো। একটু পরে একটু খটকা লাগল। মহিলা বিপিএল আর ক্রিকেট নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করছিল। আবার বন্ধুকে প্রশ্ন, মেয়েটা কে? জানাল, ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছে। আমাদের এত সব সুন্দরী মডেলদের কী হলো? বুঝলাম, আমাদের মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী কর্মকর্তারাও এখনো বিদেশপ্রীতি প্রদর্শন করতে পিছপা হতে রাজি নয়। শুধু কি বিপিএল? রাস্তায় বের হলেই তো সব বহুজাতিক কোম্পানির প্রসাধনীর বিজ্ঞাপনে ঐশ্বরিয়া রায় আর শাহরুখ খান। আমাদের এত জয়া আহসান বা নোবেলরা কোথায় গেল?
মধ্য পঞ্চাশের দশকে যখন স্কুলে যাওয়া শুরু করি তখন বছরে দুইবার, দুই ঈদে ‘বিলাতি সাবান’ ব্যবহার করার সুযোগ মিলত। বর্তমান প্রজন্মকে বোঝানো যাবে না ‘বিলাতি সাবান‘ বলতে কী বোঝানো হতো। সেটি আসলে সুগন্ধী সাবান। ধরুন আজকের লাক্স বা রেক্সোনা, তবে আমদানি হতো সত্যি সত্যি বিলাত থেকে। এখন আর আমদানি করতে হয় না। বিলাতি কোম্পানিরাই এ দেশে সে সাবান তৈরি করে আর দেশে তৈরি সাবানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হিমশিম খায়। আর আমাদের দেশি কোম্পানির এই সুগন্ধী সাবান বিদেশেও রপ্তানি হয়। তার পরও আমাদের দেশের একশ্রেণীর ভোক্তার কাছে বিদেশ থেকে আমদানি করা সাবানের কদর বেশি। ছোটকালে দেখেছি, আমাদের টমেটোকেও বিলাতি বেগুন বলত। সম্ভবত বীজটা বিদেশ থেকে এসেছিল, সে জন্যই বিলাতি বেগুন। তবে এটি নিশ্চিত যে তা বিলাত থেকে আসেনি। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অবস্থা নাকি বেশ নাজুক। বুঝতে পারি না, তার পরও কেন আমদানি করতে হবে বিদেশ থেকে বিস্কুট, পরোটা আর নুডল্স, আমের জুস বা বাচ্চা কমলা লেবু। কারণ এগুলোর ক্রেতার অভাব নেই। এদের কাছে দেশি জিনিস মানেই নিম্নমানের আর নিম্নবিত্তের ব্যবহার্য।
বাঙালির বিদেশপ্রীতি ঐতিহাসিক, যা আগেই বলেছি। আমাদের মধুকবি মধুসূদন দত্তের খুব বিলাতপ্রীতি ছিল। বিশ্বাস করতেন, ভালো কবি হতে হলে বিলাত যেতে হবে। নামের আগে মাইকেল পদবি লাগিয়ে ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিষ্টান হয়েছিলেন। বিলাত গিয়েছিলেন বটে, যশ-খ্যাতিও হয়েছিল। শেষ বয়সে অনেকটা কপর্দক শূন্য অবস্থায় কলকাতাতেই মৃত্যুবরণ করেন। একসময় বাঙালির কাছে বিদেশি বউ বা স্বামীর কদর ছিল বেশ। এখন তাতে ভিন্নমাত্রা যোগ হয়েছে। বিদেশি বর বা কনের চেয়ে দেশি ছেলে বা মেয়ের বিদেশি গ্রিনকার্ড থাকলে তার বাজার দর অনেক গুণ বেড়ে যায়। সুরিখানাগুলোয় তো বিদেশি সুরা না থাকলে আসরই গুলজার হয় না। শিশুবয়সে যে স্কুলটাতে ভর্তি হয়েছিলাম সেটি ছিল একটি বিদেশি ধর্মযাজক প্রতিষ্ঠান পরিচালিত, মানে মিশনারি স্কুল। বেশ কয়েক বছর সপ্তাহে এক দিন ওই দেশের জাতীয় সংগীত গাইতে হতো। বলতে দ্বিধা নেই, সে বয়সে একবারও মনে হয়নি কাজটা ঠিক হচ্ছে না। একদিন প্রশাসন থেকে এক নির্দেশ এল বন্ধ করতে। অতঃপর বন্ধ হলো স্বদেশি বালকদের বিদেশি জাতীয় সংগীত গাওয়া।
গিয়েছিলাম বাংলা একাডেমীর বইমেলায়। সঙ্গে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত কন্যা আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আমর ভ্রাতুষ্পুত্রী। কয়েকটি বইয়ের দোকানে দেখলাম কিছু অভিভাবক হন্যে হয়ে খুঁজছে ডরিমন। বুঝতে পারি না এটা আবার কোন বই। এক পরিচিত প্রকাশক বললেন, ওটা একটা জাপানি কার্টুন সিরিজ, বাংলাদেশে কোনো এক কার্টুন নেটওয়ার্কে দেখা যায় এবং তাও হিন্দিতে। এবার আমার ভিরমি খাওয়ার অবস্থা। একে তো জাপানি কার্টুন, তাও আবার হিন্দি ভাষায়। বাচ্চাদের ভাষা শেখার ক্ষেত্রে সর্বনাশের আর বাকি রইল কী? না, হিন্দি ভাষার প্রতি আমার কোনো বিদ্বেষ নেই। কোনো ভাষার প্রতিই নেই। তবে জীবনের শুরুতে বাচ্চা যদি মাতৃভাষাটাকে রপ্ত না করে তাহলে পরবর্তীকালে তা করাটা সহজ হবে না। পরিচয় হলো একজন অভিভাবকের সঙ্গে। হন্যে হয়ে ডরিমন খুঁজছেন। জানতে চাই, কেন তিনি ডরিমন খুঁজছেন। তাঁর স্কুলপড়ুয়া শিশুপুত্রের খুব পছন্দ। কার্টুন নিয়মিত দেখে, এখন তার এটা চাই। বলি, মুহাম্মদ জাফর ইকবালের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বা ঠাকুরমার ঝুলি কি বাড়িতে আছে? এখলাস উদ্দিন আহমেদ, শাহরিয়ার কবির বা আলী ইমাম বাচ্চাদের জন্য তো অনেক মজার মজার গল্পের বই লিখেছেন। আছে কি বাড়িতে তদের দু-একটা বই? ভদ্রলোক কিছুটা বিরক্ত হয়ে কোনো জবাব না দিয়ে অন্য দোকানে ডরিমন খুঁজতে যান। মেলা থেকে বের হয়ে রাস্তায় এক ভ্যানগাড়িতে দেখি সব ডরিমন। ১১০ টাকা দিয়ে কিনে নিই একটা। আমাদের বাচ্চারা নাকি ওটা না দেখলে রাতে ঘুমায় না। অনুবাদক তাঁর উৎসর্গপত্রে তাই লিখেছেন। উল্টেপাল্টে দেখি বাংলাদেশে এর চেয়ে বাচ্চাদের কত ভালো ভালো গল্পের বই আছে! আক্ষেপ করে কন্যাকে বলি, ক্ষমতা থাকলে আজই বন্ধ করে দিতাম এসব চ্যানেল যারা আমাদের বাচ্চাদের সর্বনাশ করছে। আফসোস, সে ক্ষমতা আমার নেই। আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা ও সংস্কৃতিতে এমন আগ্রাসন কি চলতেই থাকবে? প্রশ্ন পাঠকদের কাছে।
সবশেষে দুজন প্রতিথযশা পণ্ডিত, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের সম্প্রতি দুটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর দুটি মন্তব্য প্রতিবেদনের মন্তব্য উল্লেখ করতে চাই। কারণে-অকারণে এখন কোনো কোনো পণ্ডিতের এটি অভ্যাস হয়ে গেছে, ঢালাওভাবে সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি তোপ দাগা। তাদের বক্তব্য, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সার্টিফিকেট বাণিজ্য করছে (কিছু অবশ্যই তা করছে)। সুতরাং সেগুলোকে শায়েস্তা করার জন্য বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা খুলতে দেওয়া হোক। একজন বললেন, কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়ে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়কে এখানে আসার সুযোগ দেওয়া হোক। কেউ কিন্তু বলেন না আইন ভঙ্গকারী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সব ক্ষমতা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এ সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে দেওয়া আছে। তারা কখনো এই প্রশ্ন করেন না, কেন সেই আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হয় না । আসলে এই যে বাঙালির বিদেশপ্রীতি তা মূলত একধরনের হীনম্মন্যতার কারণেই আমাদের মধ্যে বাসা বেঁধেছে। এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া না গেলে জাতি হিসেবে আমাদের বেশি দূর যাওয়া সম্ভব নয়।
মধুসূদন দত্ত ইউরোপ থেকে ফিরে লিখেছিলেন, ‘হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন/তা সবে, (অবোধ আমি) অবহেলা করি/পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ/পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।’ হবে কি আমাদেরও কবির মতো এমন বোধোদয়?
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; বর্তমানে শিক্ষক, ইউল্যাব, ঢাকা।

No comments

Powered by Blogger.