শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার by শহীদুল ইসলাম

এক. মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়েই সিপাহি জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করেছিলেন। সংবিধানের পাতা থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাগুলোকে অবৈধভাবে উচ্ছেদ করেছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী আদর্শ দ্বারা পবিত্র সংবিধানকে কলঙ্কিত করেছিলেন। উচ্চতর আদালতের রায়ে তা আজ প্রমাণিত।

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান শত্রু জামায়াতে ইসলামী ও তার আমির গোলাম আযমকে তিনিই এ দেশে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামলে দেশবাসীর ওপর নেমে আসত দমন-পীড়ন-নির্যাতন। তাঁরই সার্থক উত্তরসূরি আরেকজন সিপাহি এরশাদ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংসের শেষ পেরেকটি ঠুকলেন অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বিলটি পাস করে। তাঁর বিরুদ্ধেও আন্দোলন সহজসাধ্য ছিল না। বহু মুক্তিযোদ্ধা এই দুই সিপাহির শাসনামলে শহীদ হয়েছেন। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনে এরশাদের পতন হয় এবং নির্বাচনের মাধ্যমে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার গঠন করে ১৯৯১ সালে। বিএনপির ক্ষমতারোহণে জামায়াতের শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং মুক্তিযুদ্ধকে অপমান করে ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামী তার নায়েব ঘোষণা করে। এতে আহত দেশবাসী গর্জে ওঠে। লক্ষ-কোটি মানুষ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় গঠিত হয় ১০১ সদস্যের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। গড়ে ওঠে এক নতুন আন্দোলন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সারা দেশ জ্বলন্ত চুলায় পরিণত হয়। সে আন্দোলন সামনে থেকে পরিচালনা করেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। মুক্তিযুদ্ধে তিনি তাঁর সন্তান রুমীকে হারিয়েছিলেন। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি কোটি কোটি মুক্তিযোদ্ধার মায়ে পরিণত হন_'শহীদ জননী'। আজ ২৬ জুন তাঁর ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। পুরো জাতি আজ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবনত। 'মা, তুমি বাংলাদেশের সালাম ও শ্রদ্ধা গ্রহণ করো।'
দুই. যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সে আন্দোলন কেবল ঢাকায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। অতি দ্রুত তা সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। রাজশাহীবাসীও সে আন্দোলনে পিছিয়ে থাকেনি। ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন শুরুর অল্পকাল পরে রাজশাহীবাসী রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের বড় বড় সমাবেশের আয়োজন করে এবং ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতারা সেসব সমাবেশে যোগ দেন ও বক্তৃতা করেন। জাহানারা ইমাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান নিয়ে সে আন্দোলন পরিচালনা করেন। ক্যাম্পাসে বসবাসরত বাংলার ড. আবদুল খালেকের বাসায় ছিলেন তিনি। ক্যাম্পাসের নারী-পুরুষ সব সময় তাঁকে ঘিরে থাকতেন। নবাবগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্থানে সমাবেশে যোগদানের জন্য যখন আমরা তাঁকে নিয়ে রওনা দিই, জানি না কেন, তিনি আমাকে তাঁর গাড়িতে তুলে নিলেন এবং সারাক্ষণ নানা রকম কথা বলেন। বিশেষ করে আন্দোলনের দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতার কথা। তাঁর সঙ্গে আন্দোলনরত অনেকের প্রতি তাঁর খুব একটা আস্থা ছিল না। তাদের সম্পর্কে সতর্ক ও সজাগ থাকার কথা বলেন। নবাবগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে আমরা তিনটি বড় সমাবেশ করেছিলাম। নবাবগঞ্জ কলেজের মাঠের সে সমাবেশ নাকি ছিল স্মরণকালের বৃহত্তম জনসমাবেশ। কিছুদিন পর অনেক সংগঠনের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি'। কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে শহীদ জননীকে তার আহ্বায়ক নির্বাচন করে। সেই কমিটির উদ্যোগে সম্ভবত তাঁর সর্বশেষ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় রমনা পার্কের গেটের সামনে। সে সমাবেশে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। সে সভায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক দল ও গ্রুপের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। যেমন_শেখ হাসিনা ও বদরুদ্দীন উমর উভয়েই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শহীদ জননীর সঙ্গে একই মঞ্চে উঠেছিলেন এবং বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তাই এ কথা জোরের সঙ্গেই বলা যায়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিকে রাজাকার ও আলবদর ছাড়া পুরো জাতি একই মঞ্চে দাঁড়াতে কুণ্ঠিত হয়নি।
তিন. সেই সমাবেশের পর তাঁর মুখের ক্যান্সারের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান চিকিৎসার জন্য। সেই তাঁর শেষ যাত্রা। সে সময় প্রতীকী বিচারে যুদ্ধাপরাধীদের যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, আজ সে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অত্যন্ত ঢিমেতালে চললেও দেশবাসী আশা করে, বর্তমান সরকারের আমলে সে বিচারকাজ সম্পন্ন হবে এবং শহীদ জননীর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু সে দিনের বিএনপি সরকারের ভূমিকা ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিপক্ষে। তাই তারা শহীদ জননী জাহানারা ইমামসহ ২৪ জন নেতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করে। সে মামলার বিরুদ্ধে সারা জাতি বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সেই রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা ঘাড়ে নিয়েই শহীদ জননী ঢাকায় ফিরে এসেছিলেন মৃত্যুর পর। যেদিন তাঁর মরদেহ ঢাকায় এসে পেঁৗছায়, সেদিন সারা ঢাকায় যান চলাচলে সাংঘাতিক ব্যাঘাত ঘটেছিল। সেই খালেদা জিয়ার রাষ্ট্রদ্রোহের মিথ্যাচারের মমলার অপবাদ ঘাড়ে নিয়ে তাঁকে কবরস্থ করা হয়। এটা পুরো বাঙালি জাতির জন্য এক লজ্জার ইতিহাস। কিন্তু হাস্যকর ব্যাপার ছিল এই যে রাষ্ট্রদ্রোহী শহীদ জননীকে গার্ড অব অনার দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া আর্মি পাঠিয়েছিলেন। তবে আটজন সেক্টর কমান্ডার শহীদ জননীকে গার্ড অব অনার জানিয়েছিলেন। দুই বছর পর বিচারপতি হাবিবুর রহমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হন। তিনি শহীদ জননীসহ ২৪ জনকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন।
তবে আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে। তাঁরা কাজ করে চলেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গণদাবি। মহাজোট সরকারের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারও এটি। বিলম্বে হলেও এই কলঙ্ক তিলক মোচনের যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছে, তা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। শুধু নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণের জন্যই নয়, দেশ ও জাতির বৃহৎ স্বার্থে এবং মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও চেতনা সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেও তা জরুরি। জাতি আশা করে, সত্বর সে বিচারকাজ সম্পন্ন হবে এবং যুদ্ধাপরাধীরা তাদের কৃতকর্মের জন্য যথোপযুক্ত শাস্তি পাবে। শহীদ জননীর ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকীতে দেশবাসী আজ জোরেশোরে সে দাবি উচ্চারণ করছে।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.