বৃত্তের ভেতর বৃত্ত-পাহাড় নিয়ে পাহাড়-ষড়যন্ত্র by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

শান্তিচুক্তির যুগপূর্তি হলেও যে লক্ষ্যে এই চুক্তিটি বহু কাঠখড় পুড়িয়ে সম্পাদিত হয়েছিল, এর সুফল আজও মেলেনি। এ অভিযোগ ক্রমেই পুষ্ট হচ্ছে যে মহলবিশেষ পাহাড়ের শান্তি বিনষ্ট করার জন্য নানা রকম ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। উসকে দিচ্ছে বিদ্বেষ। ষড়যন্ত্রের বিষয়টি কোনোভাবেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না এ কারণে, পাহাড়ে একের পর এক দ্বন্দ্ব-সংঘাত,


অপহরণসহ নানা ধরনের মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের ধরন ও প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে যা কিছু পরিলক্ষিত হয়, এর সবই মনে হয় বিস্তৃত পরিকল্পনার ফল। ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্ন বলার অবকাশ খুব কম। সম্প্রতি রাঙামাটি শহরের বনরূপা সমতাঘাট এলাকা থেকে যে ১০ নারীনেত্রীকে অপহরণ করা হয়, তাঁরা সবাই শান্তিচুক্তিবিরোধী ইউপিডিএফ সমর্থক উইমেনস ফেডারেশনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেত্রী। ১৯৯৬ সালে পাহাড়ের আরেক অপহৃত নারীনেত্রী কল্পনা চাকমার অপহরণ দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ওই ১০ জন রাঙামাটি থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন। ইউপিডিএফ প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় এ জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিকে দায়ী করলেও জনসংহতি সমিতি জোরালোভাবে ওই অভিযোগ অস্বীকার করে। এ রকম অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ কিংবা অভিযোগ অস্বীকারের প্রবণতা ঘটে যাওয়া প্রায় প্রতিটি ঘটনার পরই পরিলক্ষিত হচ্ছে। পার্বত্য অঞ্চলকে অস্থিতিশীল ও হিংসা উসকে দেওয়ার পেছনে দেশি-বিদেশি যেসব ষড়যন্ত্র কাজ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে, তা আমলে নিয়ে সত্যাসত্য অনুসন্ধানের পদক্ষেপ সরকারি তরফে কেন নেওয়া হচ্ছে না_এটি বিদ্যমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
পাহাড়ি-বাঙালি সমাজে নানা ধরনের অসন্তোষ তো আছেই, সেই সঙ্গে পাহাড়ি-পাহাড়ি দ্বন্দ্ব-সংঘাতের চিত্রও ক্রমেই পুষ্ট হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিবিরোধের অধ্যায় বেশ জটিল। ইতিমধ্যে রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা, বৈঠক, সিদ্ধান্ত গ্রহণ_কোনো কিছুই কম হয়নি কিন্তু এর পরও অনেক কিছুই থেকে গেছে অনিষ্পন্ন। পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানিও ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত দলগুলো অস্ত্র ব্যবহারের কথা বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। সব মিলিয়ে পাহাড়ি জনপদের শান্তিসন্ধানী মানুষের মনে আবার শঙ্কার দানা পোক্ত হয়ে উঠছে। গত বছরের ১৯, ২০ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে যে সহিংস ঘটনা ঘটেছিল, তা এখনো সাম্প্রতিক সময়ের পাহাড়ি জনপদের ভয়াবহ স্মৃতি। যখন ওই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল তখন পার্বত্য রাজনীতির সংকটময় চেহারাটাও পুনর্বার প্রকট হয়ে উঠেছিল। বিদ্যমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে প্রতীয়মান হয়, পার্বত্য এলাকায় বর্তমানে দৃশ্যত তিনটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল সক্রিয় থাকলেও উপদল রয়েছে আরো। আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব ও মতানৈক্য ক্রমেই বাড়ছে। আস্থার সংকটের পাশাপাশি বিদ্যমান পরিস্থিতি পার্বত্য জনগণের দীর্ঘদিনের সংঘাতময় জীবনকে আরো বিপন্ন করে তুলছে। একাধিক রাজনৈতিক দল থাকা কোনো সমস্যা নয়, কিন্তু সমস্যা হলো সশস্ত্র সংঘাত। এ সংঘাত পার্বত্য সমাজে এক দুষ্টক্ষত হিসেবে বিরাজ করছে; অকালে ঝরে যাচ্ছে প্রাণ। পার্বত্য চট্টগ্রামের এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত একটি রাজনৈতিক সমস্যা_এ ব্যাপারে দ্বিমত প্রকাশের অবকাশ নেই। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার জনসংহতি সমিতির সঙ্গে শান্তিচুক্তি করেছিল। এতে মানুষের মনে ব্যাপক আশার সঞ্চার ঘটেছিল যে পাহাড় এবার শান্ত হবে, রক্তপাত বন্ধ হবে এবং প্রকৃতির অপূর্ব লীলাভূমি হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে। না, তা হয়নি এবং পার্বত্য শান্তিচুক্তির যথাযথ বাস্তবায়নও সম্ভব হয়নি। তৎকালীন সরকার যে ঐতিহাসিক দূরদর্শিতার পরিচয় তখন দিয়েছিল, তা ক্রমেই আরো সুদূরপ্রসারী হবে_এ প্রত্যাশা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে কেন হোঁচট খেল_এটিও জরুরি প্রশ্ন। যে অবস্থা বিরাজ করছে এ প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন দাঁড়ায় পাহাড় নিয়ে পাহাড়ে পাহাড়-ষড়যন্ত্র হচ্ছে।
বিগত জাতীয় নির্বাচনে মহাজোট বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর সংগতভাবেই আশা করা হয়েছিল, পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে আর কোনো শৈথিল্য প্রদর্শন করা হবে না। বিএনপি পার্বত্য শান্তিচুক্তির বিরোধিতা শুরুতেই করেছিল বটে, কিন্তু তারা এরপর ক্ষমতায় এসে চুক্তিটি বাতিল করেনি। চুক্তির ন্যায়সংগত ভিত্তি ছিল বলেই তারা সে পথে যেতে পারেনি_এটি অত্যন্ত সহজ-সরল বিশ্লেষণ। কিন্তু তারা চুক্তি বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগও গ্রহণ করেনি। উপরন্তু এ ব্যাপারে নানা রকম নেতিবাচক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে, যা পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুলছে। তাই এই মেয়াদে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের উচিত ছিল এই চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়নের সুুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ। এ ব্যাপারে যেটুকু কার্যক্রম পরিলক্ষিত হচ্ছে, তাতে লক্ষণীয় অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়, এটাও স্পষ্ট করেই বলা যায়। সরকারের চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি গঠন ও ভূমি কমিশন আইন সংশোধন করে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে এবং চুক্তি অনুযায়ী শরণার্থী পুনর্বাসনের জন্য টাস্কফোর্স গঠন ইত্যাদি উদ্যোগের যোগফল আশাব্যঞ্জক নয়। ক্ষেত্রবিশেষে কোনো কোনো ঘটনা নতুন করে হতাশা এবং প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে পার্বত্য চট্টগ্রাম আবার সেই অস্থির অবস্থায় ফিরে যেতে পারে_এ আশঙ্কা একেবারেই অমূলক নয়। আগেই বলেছি, ইতিমধ্যে চুক্তিবিরোধী নানা দল-উপদল পরস্পরবিরোধী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। চাঁদাবাজি ও নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডও উঠছে মাথাচাড়া দিয়ে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নিরাপত্তাহীনতা ক্রমেই বাড়ছে। অথচ এই পার্বত্য চট্টগ্রাম শুধু পর্যটনের জন্যই বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় জোগানদার হতে পারত। পর্যটকদের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রাম অত্যন্ত আকর্ষণীয় স্থান হলেও নিরাপত্তাজনিত কারণে সেখানে পর্যটকের সংখ্যা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। কয়েকজন বিদেশি পর্যটক স্পষ্ট করেই জানিয়েছেন, বিদেশিদের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রাম আকর্ষণীয় বটে; কিন্তু নিরাপত্তাজনিত সমস্যা তাঁদের আগ্রহ দমিয়ে দিচ্ছে।
পার্বত্য শান্তিচুক্তির একটি অন্যতম বিষয় ছিল, পাহাড়ি শরণার্থী এবং অভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তু পরিবারগুলোর পুনর্বাসন। অসংখ্য পরিবারের অমানবিক জীবনযাপন মানবতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। যথাযথ যাচাইয়ের মাধ্যমে জায়গা-জমিসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি, পাহাড়িদের ভূমির মালিকানা চূড়ান্ত করে তাদের ভূমি রেকর্ডভুক্ত এবং ভূমির অধিকার নিশ্চিত করার কাজটি শান্তিচুক্তিতে প্রাধান্য পেলেও তা আজও অনিষ্পন্ন রয়ে গেছে। অসন্তোষ, ক্ষোভ ও হানাহানির পেছনে এর নেতিবাচক ভূমিকা রয়েছে যথেষ্ট। হাজার হাজার আদিবাসী পরিবার এখনো পুনর্বাসনের অপেক্ষায়। তারা যেন নিজ ভূমিতে পরবাসী। পার্বত্য শান্তিচুক্তি অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে সেনা ক্যাম্পগুলো গুটিয়ে ফেলার কথা ছিল। এ ব্যাপারে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখন তা বন্ধ রয়েছে। ফলে চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ বাড়ছে। গত বছরের ১০ অক্টোবর কালের কণ্ঠে 'দরিদ্রদের চেয়েও দরিদ্র পাহাড়িরা' শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তা পীড়াদায়ক। ওই প্রতিবেদনের প্রতিবেদক বন্ধু বিপ্লব রহমান জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) এক জরিপের ভিত্তিতে যে চিত্র প্রকাশ পেয়েছে তারই আলোকে দেখিয়েছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে দেশি-বিদেশি নানা উন্নয়ন কর্মসূচি কিভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ওই প্রতিবেদন থেকেই জানা গেল, সারা দেশে নিরঙ্কুশ দারিদ্র্যের হার ৪০ শতাংশ হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের ক্ষেত্রে এ হার ৬৫ শতাংশ। একই সঙ্গে যেখানে চরম দারিদ্র্যের হার সারা দেশে ১৮ শতাংশ, সেখানে আদিবাসীদের ক্ষেত্রে এ হার ৩৬ শতাংশ। নিরঙ্কুশ দারিদ্র্যের ক্ষেত্রে বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ের লুসাই, চাক, খেয়াং, পানখোয়া ও বম আদিবাসীদের মধ্যে এ হার ৮০ শতাংশেরও বেশি! ভূমিচ্যুত বা নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদের ঘটনা বিগত তিন দশকে ঘটেছে প্রায় ২২ শতাংশ। নিশ্চয়ই এই কয়েক মাসে বিবর্ণ চিত্র আরো পুষ্ট হয়েছে। এসব তথ্যচিত্র এ প্রশ্নও দাঁড় করায়_পার্বত্য অঞ্চল কি দেশের বিচ্ছিন্ন কোনো জনপদ?
এ সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই যে কোনো চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর সেটা কোনো সরকার বা দলের থাকে না, তা দেশের দলিলে পরিণত হয়। কিন্তু পার্বত্য শান্তিচুক্তির ক্ষেত্রে তা দেখা যাচ্ছে না। স্থানীয় সাধারণ পাহাড়ি ও বাঙালিরা মনে করেন, এ চুক্তি বাস্তবায়িত হবে না। তাঁদের এই সন্দেহের পেছনের কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, তাঁদের বিশ্বাস, এ ব্যাপারে রাজনীতিকদের মনোভাব স্বচ্ছ নয়। পার্বত্য শান্তিচুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন শান্তিপ্রিয় প্রত্যেক নাগরিকের কাছে বহুল প্রত্যাশিত ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হ্যাঁ, হতে পারে এই চুক্তিতে অসামঞ্জস্য রয়ে গেছে; কিন্তু তা কি সব পক্ষের আন্তরিক প্রয়াসে দূর করা দুরূহ? পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে জাতীয় রাজনীতিতে যে টালবাহানা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা কোনো বিবেচনা বা বিশ্লেষণেই শুভ নয়। অভিন্ন সিদ্ধান্ত এবং চুক্তি বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ ভিন্ন পার্বত্য অঞ্চলে শান্তির আশা করা দুরাশারই নামান্তর। একই সঙ্গে অত্যন্ত জরুরি হলো, পাহাড়িদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির ব্যবস্থা করা। সংবিধান সংশোধনের কাজ হাতে নিয়েছে মহাজোট সরকার। এখনই এ বিষয়টিরও নিষ্পত্তির লক্ষ্যে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। পাহাড়িদের অধিকার রক্ষায় জোরদার পদক্ষেপ নেওয়া সার্বিক প্রেক্ষাপটে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ও মানবিক, এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন। থেমে থেমেই পাহাড়ে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। এই মানবিক বিপর্যয়ের জন্য যারাই দায়ী, তাদের শিকড় উপড়ে ফেলতে না পারলে সহাবস্থান কঠিন হয়ে পড়বে।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.