রঙ্গব্যঙ্গ-হ্যালো জেনারেল! by মোস্তফা কামাল

হঠাৎ করেই আবার তিনি আলোচনার শীর্ষে। পত্রপত্রিকায় তাঁকে নিয়ে নানা কাল্পনিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। তিনি দেশে ফিরবেন কি ফিরবেন না তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। কোনো কোনো পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিনি নাকি কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় চাইবেন।


ওয়ান-ইলেভেনের প্রসঙ্গ এলেই তাঁর এবং সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদের নামটি একসঙ্গে এসে যায়। কারো কাছে তিনি ভিলেন, আবার কারো কাছে পার্শ্বনায়ক। কেউ কেউ বলেন, মইনকেও তিনি পরিচালনা করতেন। নিশ্চয়ই পাঠক বুঝে গেছেন তিনি কে?
আর ভণিতা না করে বলেই ফেলি। তিনি অস্ট্রেলিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী। ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবদের অন্যতম একজন তিনি। তিনি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গুরুতর অপরাধ দমন জাতীয় সমন্বয় কমিটির প্রধান ছিলেন। আসলে সেনাসমর্থিত ওই সরকারের আমলে জেনারেল মইনের পরই ছিল তাঁর অবস্থান। তিনি দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, আমলাদের তালিকা প্রণয়ন করে ব্যাপকভাবে আলোচিত হন। শুধু তালিকা প্রণয়নই নয়, দুর্নীতিবিরোধী অভিযানও পরিচালিত হয় তাঁর নেতৃত্বে। রাজনীতিক, আমলা ও ব্যবসায়ী অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলা হয়। দুর্নীতিবাজদের তালিকা প্রণয়নের নামে অনেকেই হয়রানির শিকার হন। আবার অনেকে হয়রানির ভয়ে হন দেশছাড়া। আগামী ২৯ জুন জেনারেল মাসুদ অবসরে যাবেন। স্বাভাবিক কারণেই তাঁকে সরকার দেশে ডেকে পাঠিয়েছে। আর শুরু হয়ে গেছে তাঁকে নিয়ে লেখালেখি। তিনিও মহাজোশে চাকরিতে থেকেই বলে ফেললেন অনেক কথা। তিনি জানালেন, ওয়ান-ইলেভেনের সময় নাকি অনেকেই ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখতেন। জেনারেলের কথা, বিশ্বাস না করে উপায় কী!
অবশ্য দুই বছর আগেও জেনারেল সাহেব আমাকে শর্ত দিয়ে বলেছিলেন, সেনাশাসন জারির জন্য অনেকেই আমাদের তাগিদ দিয়েছিলেন। দুই নেত্রীকে মাইনাস করার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিলেন নাগরিক সমাজের কয়েকজন প্রতিনিধি। তাঁরা দিনের পর দিন তাঁদের কাছে গিয়ে এসব পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং তখন জেনারেল সাহেব নাকি বাদ সেধেছিলেন। তিনি নাকি বলেছিলেন, দুই নেত্রীকে মাইনাস করলে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সব অর্জন বিসর্জন দিতে হবে! সাধারণ মানুষ বেঁকে বসবে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জনপ্রিয়তা দ্রুত হ্রাস পাবে। কিন্তু জেনারেলের কথা সেদিন কেউ শোনেননি।
অথচ এখন জেনারেল সাহেবের কাছে সবাই পাল্টা প্রশ্ন করছেন, স্বপ্ন কি জেনারেল সাহেব নিজেই দেখতেন, নাকি অন্য কেউ দেখতেন জেনারেল সাহেবের চোখে? তা ছাড়া সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণার উদ্ভব হলো কিভাবে? সে কথা জেনারেল সাহেবের মুখ থেকেই শোনা যাক।
জেনারেল জানালেন, তখন দেশে ব্যাপক হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি। পুতুল রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন অজ্ঞাত ব্যক্তির টেলিফোনে কর্ম সম্পাদন করতে লাগলেন। নিজের বুদ্ধি না থাকলে যা হয় আর কি! তিনি যে ধার করা বুদ্ধিতে চলতেন তা বুঝতে পেরে আমরা তাঁর টেলিফোন লাইন কেটে দিলাম। তিনি তখন বেদিশা হয়ে গেলেন। সেই সঙ্গে দিশাহীন দেশ, দিশাহীন মানুষ! বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের দরদও যেন উথলে উঠল। নাগরিক সমাজ ও সাংবাদিকদের দেশপ্রেম বেড়ে গেল। তাঁরা আমাদের মতো দেশপ্রেমিক জেনারেলের কাছে ছুটে এসে বললেন, একটা কিছু করুন! হয় সামরিক শাসন, নয় বিকল্প ব্যবস্থা।
আমরা বললাম, নো মোর সামরিক শাসন। বিকল্প ভাবুন। তাঁরা বললেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যেহেতু মেয়াদ বলা নেই, এই সুযোগটা কাজে লাগানো যায়। আমরা বললাম, তাহলে একজন গ্রহণযোগ্য কেয়ারটেকার চিফ খুঁজে বের করুন। আমেরিকার রাষ্ট্রদূত আশ্বস্ত করলেন, নো চিন্তা ডু ফুর্তি। রেডি আছেন আমাদের ফখরুদ্দীন। কোনো অসুবিধা নেই। আমরা বললাম, তিনি তো বিএনপির লোক। খালেদা জিয়া তাঁকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বানিয়েছিলেন। রাষ্ট্রদূত বললেন, তাঁর লোক দিয়েই তো তাঁকে শায়েস্তা করতে হবে। আর তিনি তো পুতুল! কাজ করবেন আপনারা!
আমরা ভাবলাম, আইডিয়াটা মন্দ না। সঙ্গে সঙ্গে লুফে নিলাম। আমরা জনসমর্থনও পাচ্ছিলাম ব্যাপকভাবে। আর তাতে আমাদের মাথা গেল খারাপ হয়ে। আমরা বেপরোয়া হয়ে গেলাম। দেখলাম, আমরা যা কিছু করি তাতেই মিডিয়া ও জনগণ সমর্থন দিচ্ছে; কাজেই আমাদের আর ঠেকায় কে? আমরাই দেশ চালাব, হাসিনা-খালেদা কেডা!
আমরা সাতপাঁচ না ভেবে সুশীল সমাজের কিছু লোকের বুদ্ধিতে মাইনাস টু থিওরি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলাম। এটা যে একটা ভুল সিদ্ধান্ত সেটা আমি অবশ্য বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরামর্শদাতারা বললেন, এটা না হলে নাকি রাজনীতি ঠিক করা যাবে না। আমরা ভাবলাম, জনগণ যেভাবে আমাদের পেছনে ছুটেছে আমরা যেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা! কাজেই দুই নেত্রীকে মাইনাস করার মোক্ষম সময় এখনই। তা ছাড়া দেশ চালাব আমরা। ওসব ঘুণে ধরা রাজনীতি বিদায় করতে হবে। তা না হলে দেশ এগোবে না। দেশ দ্বিধাবিভক্তই থাকবে।
আমরা রাজনীতিকে ঠিক করতে গিয়ে রাজনীতির ফাঁদে পড়ে গেলাম। দুই নেত্রীকে গ্রেপ্তার করার কারণে আবেগপ্রবণ বাঙালি তাঁদের পক্ষে চলে গেল। আমাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়ে গেল। তা ছাড়া ব্যবসায়ীদের অতিমাত্রায় চটিয়ে দিয়েছিলাম। আর তাতে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হতে লাগল। যারা দুদিন আগেও আমাদের উৎসাহ জোগাত, তারাও আমাদের বিরুদ্ধে চলে গেল। আমরা যখন একের পর এক বন্ধুহীন হয়ে পড়ছিলাম তখন সেই প্রতিনিধিরা জেনারেল মইনকে রাষ্ট্রপতি বানানোর জন্য উঠেপড়ে লাগল! এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গোয়েন্দাদের দিয়ে কিংস পার্টি বানানোর চেষ্টা করা হলো। আওয়ামী লীগ, বিএনপিকে ভাঙার চেষ্টাও হলো। আমরা আগে জানতাম, আমাদের মতো জেনারেলদের বুদ্ধি থাকে হাঁটুতে। পরে জানলাম, নাগরিক সমাজের লোকদেরও বুদ্ধি হাঁটুতে থাকে। আমরা বুঝতে পারলাম, তারা উল্টাপাল্টা বুদ্ধি দিয়ে আমাদের বিভ্রান্ত করেছে।
আমরা দুই নেত্রীকে নিরাপদ রেখে যা কিছু করতাম তাতেই মানুষ সমর্থন দিত। মিডিয়াও আমাদের পক্ষে থাকত। আমরা ব্যবসায়ীদের নিয়েও বাড়াবাড়ি করেছি। আমরা নিজেরা ধরাকে সরাজ্ঞান করেছি। আর সেটাই আমাদের জন্য কাল হলো। অবস্থা বেগতিক দেখে আগেভাগে দেশ ছেড়ে চলে এসেও কোনো লাভ হলো না। প্রসঙ্গ এলেই সমালোচনার ঝড় ওঠে। এখন মনে হচ্ছে, কেন যে এত কিছু করতে গেলাম! এসব করে আমার পদটা কেন যে কলঙ্কিত করলাম!
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.