ম ণি পু রি গ ল্প-কিষানপুরের মায়া by সুরেন্দ্র কুমার ও শুভাশিস সিনহা

গল্পকার সুরেন্দ্র কুমার সিংহের জন্ম ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জের ঘোড়ামারা গ্রামে। পেশায় সরকারি চাকরিজীবী এ লেখক বাংলাদেশের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি সাহিত্যচর্চা ও আন্দোলনের শুরুর দিক থেকে শুধু জড়িত নন, অন্যতম নেতৃত্বদানকারীও। ১৯৭৫ সালে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত খংচেল পত্রিকায়


তাঁর প্রথম ছোটগল্প প্রকাশিত হয়। পরে অনিয়মিত সাহিত্য পত্রিকা সত্যম-এ ছাপা হয় বেশ কয়েকটি গল্প। এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন সাহিত্যকাগজে ছোটগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ লিখেছেন, তবে সংখ্যায় খুব কম। সুরেন্দ্র কুমার সিংহের গল্পভাষা কোমল, পরিমিত; তবুও তীক্ষ ব্যঞ্জনাধর্মী। বিষয়ের দিক থেকে বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং অবশ্যই ইতিহাস ও দেশকালের ধারক। প্রান্তিক নারীজীবনের অনবদ্য রূপকার তিনি। নিভৃতচারী এ লেখকের এখন পর্যন্ত কোনো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি।

রোদ-বৃষ্টির খেয়াল নেই, কাজের ওপর কাজ, হিসাবের ওপর হিসাব। এমনই চলছে এ গাঁয়ের মানুষের জীবন। দিনরাতের ভেদ নেই, সংসারের কর্মব্যূহে তাদের জীবন ঘূর্ণির মতো পাক খাচ্ছে। কাজই তাদের ভূত-ভবিষ্যৎ, আশা-আকাঙ্ক্ষা সবকিছু। কর্মব্যাধি যেন জাপটে ধরেছে জীবনের অন্য সব সম্ভাবনাকে।
যদি কোনো দিন আপনারা কোনো প্রয়োজনে কিষানপুর নামের এ গ্রামটিতে আসেন, তাহলে দেখতে পাবেন গ্রামের সব দৃশ্য ও পরিবেশ। কাজের চাপে মানুষগুলোর জীবন যেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে।
কী অদ্ভুত পরিবেশ এ গাঁয়ের! গাছ-লতা-বাঁশঝাড়ের নিকষ অন্ধকার দেখে মনে একটু ভয়ও জাগে। বড় বড় গাছ চারদিকে ডাল ছড়িয়ে দিয়েছে, গাঢ় সজুব রঙে এ গাঁয়ের প্রকৃতি এক আশ্চর্য রূপ ধরে আছে যেন। মায়া-প্রেমের ছোঁয়া নেই। সারা দিন হইহই রইরই; বিশ্রাম নেই।
কিষানপুরের বিরাজবাবু কাজকর্মে খুবই হিসেবি। এ হিসাবের গুণেই তিনি অল্পদিনের মধ্যে অর্জন করেছেন অর্থ-প্রতিপত্তি। রাস্তাঘাটে হেঁটে যাওয়ার সময়ও তিনি হাতের আঙুল ভেঙে ভেঙে হিসাব করে চলেন। শ্রীপুরের মাধববাবু বিরাজবাবুর পুরোনো বন্ধু। গাঁয়ের নানা শ্রাদ্ধ-কর্মে তাঁদের দুজনকে এক আসরে বসে থাকতে দেখা যায়। মাধববাবু তাঁর ছোট মেয়ে হরিলক্ষ্মীকে অর্থ-যশের মোহে পড়ে বিরাজবাবুর বড় ছেলে ব্রজকিশোরের হাতে সমর্পণ করলেন।
হরিলক্ষ্মী বিয়ের আগে থেকেই কিষানপুরের মাহাত্ম্য শুনেছিলেন। যেখানে মানুষের ভেতর কেবল একটাই মন্ত্র—কাজ আর কাজ। কাজ ছাড়া অন্য কিছু ভাবলেই যেন জীবন ফাঁকি দিয়ে চলে গেল।
অল্প বয়সী বউয়েরা বছর বছর কাজের চাপাচাপিতে বেসামাল হয়ে শেষ পর্যন্ত সহ্য করতে না পেরে স্বামী-সংসার সব ফেলে মা-বাবার বাড়িতেই নাকি ফিরে যায়। অনেকে আবার কাজের কল্যাণে বড় ব্যাধিতে ভুগে এ জগৎ-সংসার চিরদিনের মতো ছেড়ে চলে গেছে; এমনও কত ঘটনা ঘটেছে। কে আর হিসাব রাখে তার!
বিরাজবাবুর চোখে ঘুম কম। রাত পোহানোর সঙ্গে সঙ্গে ঘুম থেকে উঠে গোয়ালঘর ঝাড়ু দিয়ে ভালোমতো পরিষ্কার করে ধানের চারা-টারা সব প্রস্তুত করে রাখেন। তাঁর কাজের নানা শব্দে বাড়ির বউ ছেলে-মেয়ে কেউ একটু শান্তিতে ঘুমোতে পর্যন্ত পারে না।
‘কী হলো, রাত পোহালো কত আগে, এখনো ঘুম ভাঙে না?’ হাতের তামাকে টান দিতে দিতে স্বভাবমতো আজও শুরু হলো তাঁর বকবকানি।
হরিলক্ষ্মী ভোরের দিকেই উঠে বাসন-কোসন ধুয়ে, ঘর-দোর পরিষ্কার করে পশ্চিমের পুকুরে দু-তিনবার নামমাত্র ডুব দিয়ে পান্তাভাতের সঙ্গে কাঁচামরিচ আর লবণ মেখে ঝটপট খেয়েই কোমরে একটা ইনাফির(১) টুকরা বেঁধে খেতের দিকে রওনা দিল। বিকেলের আগে আগে আবার ফিরে রান্নাঘরে ঢুকতে হবে।
খেতের কাজ থেকে ফিরে সবার সেবা-যত্ন শেষে বিকেলবেলা হরিলক্ষ্মী ছেঁড়া-ময়লা একটি কাপড় মাটিতে বিছিয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছে। ব্রজকিশোরও কাজ থেকে ফিরে ঘরের ভেতর থেকে এক সিলিম তামাক আনতে যাবে, এমন সময় বউ ঘুমিয়ে আছে দেখতে পেয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে দিল।
‘এখন কি ঘুমানোর সময়? মাঠে সারা দিনের কাজ ফেলে রেখে মুখ হাঁ করে ঘুমাচ্ছ!’
হরিলক্ষ্মী ঘুমের ঘোরে কিছু বুঝতে না পেরে আঁতকে জেগে ওঠে। পরে কিছুটা আঁচ করে গায়ের ইনাফি ঠিক করতে করতে বলল, ‘আমার কি লোহার শরীর নাকি? একটু বিশ্রাম না নিলে ক্লান্তিটা একটু কমবে কীভাবে?’
‘এখন বিশ্রাম নেওয়ার সময়!’ ব্রজকিশোর চোখ লাল করে বলে।
‘তাহলে?’
‘মুখে মুখে কথাবোলো না, ভালোয় ভালোয় বলছি, শিগগির ধান রোপণ করতে যাও, এক্ষুনি।’
হরিলক্ষ্মী আর কথা না বাড়িয়ে চিকচিক রোদে আবার খেতের দিকে যেতে লাগল। কী কড়া রোদ! মাঠেও জনমানুষের সাড়া নেই। রাস্তা দিয়ে দু-একজন ব্যাপারী কাঁধে বোঝা নিয়ে বাজারে যাচ্ছে। হরিলক্ষ্মী প্রথম যেদিন বউ হয়ে এসেছিল, তখনই এ গাঁয়ের মানুষদের আচার-ব্যবহার দেখে বিস্মিত হয়েছিল। শ্রীমান পতিদেবকেও ওর প্রথম প্রথম স্বামী মানতে যেন ভেতরে ভেতরে কী এক উসখুস ছিল। ব্রজকিশোরের গড়নভঙ্গি দেখে ওর মাথা লজ্জায় হেঁট হয়ে যেত। তবু কিষানপুরের মায়াই ওকে ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক করে নিতে শিখিয়েছে। স্বামী-শ্বশুরসহ সব মানুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে ও মানিয়ে নিল।
যা হোক, হরিলক্ষ্মী এখন খেতে কাজ করছে। ব্রজকিশোর চারার আঁটি এনে ওর সামনে ফেলে দিল। হরিলক্ষ্মী একবারও মাথা তুলে না চেয়ে চারা রোপণ করতে থাকল। ওর রোদে পোড়া চকচকে গাল বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম নেমে আসছে।
‘শোনো, আজ এ জমিটা যেন শেষ করে আসতে পারো, এ চেষ্টাই কোরো। এখন চারাগুলো এখানে ফেলে গেলে কাল আর একটিও পাওয়া যাবে না। চারার অভাবে অনেক লোক এখনো খেতে নামতেই পারেনি, বুঝেছ?’
ধমকের সুরে কথাগুলো বলে চলে গেলে হরিলক্ষ্মী একবারের জন্যও স্বামীর দিকে না তাকিয়ে নিজের কাজ করে যেতে লাগল।
হরিলক্ষ্মীর সংসারে কোনো কিছুরই অভাব নেই। গোলাভর্তি ধান, শাকসবজির বাগানে ভিটা ভরে আছে। শ্বশুর-শাশুড়ি, স্বামী-দেবরের সেবা করে ওর মনে একটু শান্তি আসে কখনো-সখনো। অথচ আজ পর্যন্ত ওর কোমল, হরিলক্ষ্মীরূপী মনটার কানাকড়ি দাম কেউ দিল না।
কাজের চাপ সহ্য করতে না পেরেই যেন আজ হরিলক্ষ্মীর গায়ে জ্বর এল। এদিকে কাজের একেবারে হুলস্থুল সময়। ভাত-পানি পর্যন্ত ঘরে খাওয়ার সময় না পেয়ে মাঠে ভাত নিয়ে গেলে কিষানপুরের লোকেরা কোনোমতে খেতের জলেই হাত-পা ধুয়ে আলে বসে খেয়ে নিচ্ছে, এমন অবস্থা।
তবু হরিলক্ষ্মী প্রচণ্ড জ্বরে বেশ কয়েক দিন বিছানায় পড়ে রইল। কেউ পাশে বসে একটু খোঁজখবর নেবে, এমন ভাগ্য তার নেই। কারই বা এমন আদিখ্যেতার সময়। তার পরও জ্বর না কমলে ব্রজকিশোর দায়ে পড়ে সত্যব্রত ডাক্তারের কাছ থেকে চারটা প্যারাসিটামল এনে ওর মাথার কাছে রেখে বলল, ‘এগুলো দুটি করে গরম পানি দিয়ে গিলবে। বাকি দুটি কাল সকালে, যদি জ্বর কমার লক্ষণ না দেখো।’
জ্বরে চোখেমুখে চিনচিন করে ব্যথা উঠলেও হরিলক্ষ্মী বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবল—এটাই ওর জীবনের একটু বিশ্রাম। স্বামী-শ্বশুরের কাজের চাপাচাপি নিয়ে শুধু নয়, জ্বরের ঘোরেও হরিলক্ষ্মী পুরো কিষানপুরের মূর্তিটা নিয়ে ভাবতে লাগল।
এদিকে বিরাজবাবু কপালে হাত দিয়ে ‘ইস ইস সারা বছরের ক্ষেতিটা নষ্ট হয়ে গেল’ বলে আফসোস করতে লাগলেন। শ্বশুরের কথা শুনে হরিলক্ষ্মীর জ্বরে বিধ্বস্ত শরীরে দ্বিগুণ জ্বালা ধরল যেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় মরার মতো পড়ে রইল সে।
এদিকে ব্রজকিশোর খুব ঘন করে বীজ বুনছে। নিজের জান গেলেও রুয়াওলি(২) ধরে পয়সা খরচ করবে না, পণ করে সে এ কাজে লেগেছে।
এ সংসারে জীবন শুরু হওয়ার পর থেকে হরিলক্ষ্মীর শরীরে আর কোনো আনন্দ নেই। সমাজ, পূজা-পালি, পালা-পার্বণ কোনো কিছুর সঙ্গে নেই ওর কোনো সম্পর্ক। এমনকি আজ বছর খানেক হতে চলল, হরিলক্ষ্মী তার বাপের বাড়িতেও যেতে পারেনি। বিরাজবাবুর এ কারাগারে পড়ে আছে।
খেতখামারের কাজ শেষ হয়ে এলে গাঁয়ের মানুষ একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। গ্রামের মেয়েরা একটু আনন্দের জন্য সবার কাছ থেকে আরতির চাঁদা তুলে কাঞ্চনবাড়ির দেবমন্দিরে একটি আরতির আয়োজন করতে লাগল।
পাড়ার দেবসখী আরতিতে যোগ দেওয়ার জন্য হরিলক্ষ্মীকে বলে গেছে। আরতিতে যাবে বলে ঘরের সব কাজ শেষ করে হরিলক্ষ্মী একটু সাজগোজ করছে, এমন সময় বিরাজবাবু ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বউমা, কোথায় যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছো?’
হরিলক্ষ্মী ভয়ে ভয়ে উত্তর দিল, ‘আরতি করতে...’ ‘এদিকে বাড়িঘর, জমিতে ফসল পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সব তো চোখে পড়ছে না, ফাও কাজে গিয়ে অযথা সময় নষ্ট করতে কারও আগ্রহের শেষ নেই।’
এই বলে বিরাজবাবু বাঁ হাতে একটি দা নিয়ে হুঁকোয় টান দিতে দিতে উঠানে নেমে গেলেন।
হরিলক্ষ্মীর বিষণ্ন কাতর মনে কী যেন ছ্যাঁৎ করে বিঁধে ওঠে। বিছানায় উপুড় হয়ে এক অসহ্য যন্ত্রণায় কাঁদতে লাগল নীরবে।
রাতে ভাত না খেয়েই ঘুমোতে গেল। কিন্তু চোখে এক ফোটা ঘুম এল না।
নিঝুম অন্ধকার রাত। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। হরিলক্ষ্মীর চোখে শ্বশুরের চেহারাটা ভেসে উঠছে, ভেসে উঠছে স্বামীর মুখটাও। কী কুৎসিত এক আগ্রাসী মায়ার মূর্তি ওকে জন্মের মতো ছিঁড়ে-খুবলে খেয়ে নিতে যাচ্ছে। হরিলক্ষ্মী ভয়ে, বিস্ময়ে নিথর হয়ে আসে।

শব্দসংকেত:
(১) ইনাফি: মণিপুরি মহিলাদের গায়ে জড়ানো ওড়নার মতো বস্ত্র। এটি কোমরের ওপর থেকে গলা পর্যন্ত পেঁচিয়ে পরতে হয়।
(২) রুয়াওলি: এক অর্থে খেতের কামলা বা শ্রমিক। ধানের বীজ রোপণের সাময়িক কাজে নিয়োজিত কৃষক।

No comments

Powered by Blogger.