স্মরণ-মুকুলের কথা, কলম ও কণ্ঠ by শামীম মমতাজ

কথার জাদুকর মুকুলের আজ বাংলা ছেড়ে চলে যাওয়ার দিন। সাত বছর আগের এই দিনটিতে তাঁর কথার সুরের সমাপ্তি হয়। সবাইকে হতবাক, নিশ্চুপ, স্তম্ভিত করে দিয়ে কথাপ্রেমিক মুকুল চলে যান অনন্তলোকে। তবে বাংলার হৃদয়ে, বাংলার চেতনায় মুকুল আজও আছেন, আজও ফুটছেন। মুকুল কথা বলতে ভালোবাসতেন ছেলেবেলা থেকে।


বড় দুই ভাইকে চুপ করিয়ে তাঁর কথাই শুনতে হতো মা-বাবা আর সবাইকে। ব্রিটিশ আমলে শৈশব কাটানো মুকুলের হাতেখড়ি হয় কলকাতায় ১৯৩৩ সালে। আধো-আধো গলায় কচি স্বরে তিনি সেদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাইকে মায়ের শেখানো 'কাক ডাকে কা, কা/আগে অ পরে আ' ছড়া শোনান। সেই থেকেই শুরু কথা বলা। যৌবনে মুকুল দেখলেন পাকিস্তান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের তরতাজা ছাত্র। আমতলা, ঢাকা হলের পুকুর পাড়_সবখানেই তাঁর কথা ও বক্তৃতায় গরম হয়ে ওঠে। হাসি-গান আর টাটকা আলাপচারিতায় তখন তিনি মধুদার ক্যান্টিনের আসরের মধ্যমণি। বায়ান্নর ২০, ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সব ঘটনায় অংশ নিয়ে ভাষা আন্দোলনকে আরো বেগবান করে তোলেন মুকুল। মুকুলের কথা বলার স্টাইল সম্পূর্ণ নিজস্ব। ঢাকাইয়া ভাষার সঙ্গে চলিত শব্দের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে লঘু ও ভারী কথা অনর্গল বলে যেতে পারতেন তিনি। শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই বাক্যবাণে বিদ্ধ করতেন। কোনো কোনো অনুষ্ঠানে মাইক হাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বক্তৃতা করেও ক্লান্ত হতেন না মুকুল। এল ২০০৪ সালের জুন, বারডেমের ১৩ তলার ১৩১০ নম্বর কেবিনে শুয়ে বলেছিলেন_'আমার অনেক কথা আছে, কিছুই আপনাদের বলে যেতে পারলাম না।' এই ছিল তাঁর শেষ কথা, আমাদের শোনা হয়নি বা মুকুলের বলা হয়নি। অনেকবার অনেকে গিয়েছিলেন সেখানে, কিন্তু না, চোখ মেলে তাকালেও কোনো কথাই বলতে পারলেন না, কারণ তখন জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ চলছে তাঁর।
মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে তাঁর কলম ছিল আপসহীন। রাজাকারদের বিরুদ্ধে রচনায় তাঁর ক্রোধ-জ্বালা-যন্ত্রণার অভিব্যক্তি ছড়িয়ে দিতে পারতেন মাত্র কয়েকটি শব্দের মধ্যে। দেশদ্রোহীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অসততার কথা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারতেন। কলাম লেখক হিসেবে মুকুলের নিবন্ধ, প্রবন্ধ তাঁর লেখক সত্তার সাফল্য। হাতে ছিল তাঁর স্বাদু দুর্লভ রমণীয় গদ্য, তাঁর লেখার মধ্যে তারুণ্যের সুর ফুটে উঠত। তাঁর এই অনন্য ভাষাভঙ্গি তৈরি হয়েছিল তাঁর জীবন উৎস থেকে। জীবনকে তিনি ভালোবাসতেন_প্রকৃত জীবনরসিক মুকুল জীবনের গান রচনা করেছেন সারা জীবন। এবার মুকুলের বিরামহীন কথা ও সাহসী কলমের রথ দাঁড়াল এসে একাত্তরে। শুরু হলো বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম। মুকুলের কথা ও কলম এবার একসঙ্গে গর্জে উঠল তাঁর তেজি কণ্ঠে :
'চরমপত্র'
একি পত্রে রাখলে মন/ক্রলিং করে শব্দেরা যায়/অ্যাম্বুশ করে পঙ্ক্তি ছোটে/বাংকারে বসে মুক্তি সেনা/শুনছে চরমপত্রের ডাক/এ আমাদের স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু/চরমপত্রের অমেয় হাঁক।
যুদ্ধের এক মহা অস্ত্র শব্দস্বর গেরিলার গর্জন, রক্তমুখী শব্দের মালা সাজিয়ে অতি সাহসে মুকুলের অগি্নবীণায় এল ঝঙ্কার। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রতিদিন সকালের ৮ থেকে ১০ মিনিটের একটি কথিকা 'চরমপত্র', যার মধ্যে মুকুলের হৃদয়ের গহনে এতদিনকার জমে থাকা সাংবাদিকতার নানা তথ্য, সাক্ষ্য, অভিজ্ঞতা, স্থান পেল। রণাঙ্গন পরিদর্শন শেষে এক মুকুল একই সঙ্গে লেখক-কথক ও ভাষ্যকার হয়ে উঠলেন।
প্রতিদিন ভোরে তিনি লিখতে বসতেন চরমপত্র_আগের দিনের রণাঙ্গনের শেষ খবর নিয়ে আঁকতে বসতেন সেদিনের ভাষ্য। একেক দিন একেক রূপে নানা ভঙ্গিমায় নানা রঙে, নানা সুরে, নানা ছন্দে_তিনি ফুটিয়ে তুলতেন তাঁর প্রতিদিনের চরমপত্র। রোজকার সুরে সুরে হয়ে উঠত যুদ্ধজয়ের ধ্বনি। অবাক কাণ্ড এই যে একেবারে চরমপত্রের শেষ দিনে অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর, প্রথম বিজয় দিবসে, সারা বাংলার কোটি শ্রোতা প্রথম জানতে পারল এর রচয়িতা ও পাঠকের নাম, যা তিনি এত দিন ধরে গোপন রেখেছিলেন।
শামীম মমতাজ

No comments

Powered by Blogger.