প্রধান উপদেষ্টা করতে হবে সমঝোতার ভিত্তিতে by আবদুল্লাহ আল নোমান

কালের কণ্ঠ : তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে তার মীমাংসা কী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন? আবদুল্লাহ আল নোমান : বাংলাদেশের রাজনীতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা একটি মীমাংসিত ইস্যু। আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির জন্য ১৯৯৫-৯৬ সালে আওয়ামী লীগ,
জামায়াত, জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য দল দেশে কী অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। জ্বালাও, পোড়াও, হরতালসহ তখন দেশে এক ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি করেছিল তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। বর্তমানে বিচার বিভাগের কাঁধে বন্দুক রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি অবৈধ হিসেবে যে রায়ের কথা বলা হচ্ছে, সে রায়ের দ্বিতীয় অংশের কথা কিন্তু সরকার বা আওয়ামী লীগ বলছে না। যেখানে আগামী দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বহাল রাখা যেতে পারে বলা হয়েছে। এখানে একটি কথা মনে রাখা দরকার, রায়ের কিছু অংশ মানব, কিছু অংশ মানব না, তা হতে পারে না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা শত বছর বহাল থাকুক এটা বিএনপিও চায় না। তবে আমাদের রাজনীতিবিদদের মধ্যে আস্থাহীনতার কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে হয়েছে। এখন কী আমাদের মধ্যে এই আস্থা পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? অবশ্যই না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে আমাদের দলের মাননীয় চেয়ারপারসন সুস্পষ্ট অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। অর্থাৎ সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যেমন আছে তেমনি ঠিক রাখতে হবে। আর যেহেতু বিচারপতি খায়রুল হক সাহেবকে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে মেনে নেবে না, তাই সংবিধানে এ বিষয়ে পরের অপশনগুলো ফলো করে সমঝোতার ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করতে হবে। এখানেও সমঝোতা লাগবে। তাই সরকারকেই এ বিষয়ে এগিয়ে এসে আগামী দিনের রাজনীতির আকাশের কালো মেঘ দূর করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : খালেদা জিয়া বলেছেন, সংসদ বর্জনের কর্মসূচি বিএনপির নেই। অথচ আপনারা সংসদে যাচ্ছেন না। সংসদে ফেরার বিষয়টিকে গণতন্ত্র সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় মনে করেন কি?
আবদুল্লাহ আল নোমান : বিএনপি কখনো স্থায়ীভাবে সংসদ বর্জনের রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিল না। এখনো নেই। আমাদের দেশের ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে স্থায়ী করতে বিএনপি সব সময়ই সংসদে যেতে চায়। কিন্তু বর্তমানে যে সংসদ চালু আছে তার দিকে খেয়াল করুন। মাননীয় স্পিকার এই সংসদকে মাছের বাজারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এখানে যেভাবে আমাদের জাতীয় নেতা-নেত্রীদের চরিত্র হনন করা হয়, তাতে অনেকের মতে, আগামী দিনগুলোতে ভদ্রলোকরা সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে অনীহা প্রকাশ করবেন। তার পরও বিএনপি সংসদে যেতে চায়। কারণ বিএনপি বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তার গড়া দল। আমি গণতন্ত্র সুরক্ষার জন্য বিএনপির সংসদে যোগ দেওয়ার পক্ষে। সংসদ বর্জন অর্থাৎ সংসদ থেকে ওয়াকআউট সংসদীয় রীতিনীতিরই অংশ। বিভিন্ন ইস্যুতে জনগণের পক্ষে কথা বলতে না পারলে যেকোনো দলের সংসদ বর্জন করার অধিকার আছে। তবে স্থায়ীভাবে সংসদ বর্জন কারোর জন্য কাম্য নয়। অবশ্য সরকারি দলের এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে হবে। বিরোধী দলকে সংসদে প্রয়োজনে বেশি বেশি কথা বলার সুযোগ দিয়ে সরকার তার ভুলগুলো আত্মস্থ করতে পারবে। তারা আরো বেশি জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে।
কালের কণ্ঠ : আপনাদের তরফ থেকে যে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি করা হচ্ছে এর যৌক্তিক ভিত্তি কতটুকু? এ মুহূর্তে নির্বাচন হলে কি প্রক্রিয়ায় হতে পারে; যেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান নিয়ে আপনাদের আপত্তি আছে?
আবদুল্লাহ আল নোমান : সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে মধ্যবর্তী নির্বাচন একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। যখন কোনো ক্ষমতাসীন সরকার সংসদে তার আস্থা হারায়, তখন সংসদ ভেঙে দিয়ে রাষ্ট্রপতি মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে পারেন। আবার অনেক সময় ক্ষমতাসীন সরকার তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো সঠিকভাবে পূরণ করতে না পারলে, দেশের আইনশৃঙ্খলার ব্যাপক অবনতিসহ শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়লে ক্ষমতাসীন সরকার বিরোধী দলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আপনা থেকেই মধ্যবর্তী নির্বাচন দিয়ে জনমত যাচাই করতে পারে। এটা দোষের কিছু নয়। বরং মহত্ত্বের। এতে গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি উন্নত হয়।
বর্তমানে দেশের যে পরিস্থিতি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ আজ দিশেহারা। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির সংকট; সর্বত্র সরকারদলীয় ক্যাডারদের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিতে মানুষের আজ নাভিশ্বাস উঠেছে। মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষ আজ পিষ্ট হতে চলেছে। এ অবস্থায় আমরা মধ্যবর্তী নির্বাচন দিয়ে সরকারকে জনগণের ম্যান্ডেট নেওয়ার দাবি জানিয়েছি। কাজেই আমাদের এ দাবি অবশ্যই যৌক্তিক। জনগণ এ বিষয়ে তাদের অব্যাহত সমর্থন জানাচ্ছে।
আপনার প্রশ্নমতে, এ মুহূর্তে নির্বাচন হলে তা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমেই হতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে বিচারপতি খায়রুল হককে নিয়ে আমাদের আপত্তি। তাঁকে পদে রেখে সংবিধানের পরের অপশনগুলো বিবেচনা করলে অসুবিধা কোথায়? আর ইতিমধ্যেই বিচারপতি তাঁর রায় নিয়ে বিতর্কিত হয়েছেন।
কালের কণ্ঠ : সংবিধান পরিবর্তন, সংশোধন ও সংযোজনের বিষয়ে আপনাদের দলীয় অবস্থান আছে আমরা জানি। এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে আপনার বক্তব্য বলুন।
আবদুল্লাহ আল নোমান : সংবিধান সংশোধন বিষয়ে আমাদের দলীয় বিভিন্ন সভা ও সমাবেশে আলোচিত হয়েছে। একটা দেশের সংবিধান হলো সর্বোচ্চ আইন। সেটা যখন তখন যার তার খুশিমতো পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা উচিত নয়। বিএনপি তো সংবিধান সংশোধনের জন্য কোনো প্রস্তাব আনেনি। বরং আওয়ামী লীগ এটা কৌশলে আদালতের কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছে। আদালত একের পর এক বিষয়ে সংবিধানের অংশ অবৈধ ঘোষণা করছে। এখন সংবিধানে প্রকৃত বৈধ অংশ কোনটা, তা কেউ সঠিকভাবে বলতে পারছে না। ইতিমধ্যে একটা খসড়া সংবিধান ছাপানো হয়েছে। তাতে আবার বিচার বিভাগের রায়ের বিকৃতি করা হয়েছে। ফলে প্রকৃত সংবিধান কোনটা তা জনগণ আজ জানতে পারছে না। এটা জাতির জন্য অবশ্যই বিভ্রান্তিকর। জাতি এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন।
কালের কণ্ঠ : আপনার কি মনে হয়, রাজপথের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করা সম্ভব?
আবদুল্লাহ আল নোমান : রাজপথের আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করা হয় না। সরকার যে ব্যর্থ হচ্ছে, তা এ দেশের মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণ জানতে পারছে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সরকারের ব্যর্থতার দিকগুলো দায়িত্বশীল সংবাদকর্মীরা তাঁদের লেখনীর মাধ্যমে জনগণকে অবহিত করেন। রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের সভা-সমাবেশ, পোস্টার ও লিফলেটের মাধ্যমে সরকারের ব্যর্থতার দিকগুলো জনগণের কাছে উন্মোচন করে। তবে রাজপথে মূলত সরকারের অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আমাদের মতে, সরকার তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। তাই তারা ক্ষমতায় থাকার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। আমরা তাদের ব্যর্থতার কথাগুলো বারবার উত্থাপন করব। সেই সঙ্গে একটি কার্যকর গণ-অভ্যুত্থান সৃষ্টির মাধ্যমে এ সরকারের পতন ঘটানো হবে। আর গণ-অভ্যুত্থান কখনো সময়ের ফ্রেমে আটকানো যায় না।
কালের কণ্ঠ : যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
আবদুল্লাহ আল নোমান : যুদ্ধাপরাধীদের সুষ্ঠু বিচার হোক, তা বিএনপিও চায়। আমরা সবাই চাই। বিচার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখে চলুক। কাউকে রাজনৈতিক হয়রানি যাতে না করা হয়। সেই সঙ্গে সরকারি দলের মধ্যে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে উঠছে তাদেরও যাতে বিচার হয়, তা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের মনে হয়, সরকার যুদ্ধাপরাধের একটা প্রতীকী বিচার করতে চাচ্ছে। সরকারের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয়, তারা এ বিষয়ে নিরপেক্ষ নয়। এ কারণে জনমনে ইতিমধ্যেই এ বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সরকার এ বিচারপ্রক্রিয়া দলীয় এজেন্ডা হিসেবে বাস্তবায়ন করছে।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
আবদুল্লাহ আল নোমান : আপনাকেও ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.