বনায়ন-অসম সমীকরণ by জিয়া উদ্দিন আহমেদ

বনায়নে আমাদের আগ্রহ পুরোনো, তবে এর নতুন মাত্রা বিভ্রান্তির সূত্র। ধরিত্রীতে অক্সিজেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইড স্বাভাবিকভাবেই এক ভারসাম্যে বিদ্যমান ছিল লাখ লাখ বছর ধরে। কারণ, সালোকসংশ্লেষণ ও শ্বসন হলো অণুতে অণুতে সমজাত দুটি রাসায়নিক প্রক্রিয়া।


পরে শক্তির প্রয়োজনে মানুষ বিপুল পরিমাণ ভূগর্ভস্থ জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের সংযোজন ঘটায়। মনুষ্যসৃষ্ট এই বাড়তি কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রিনহাউস সংকট ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির মূল উ ৎস। বাতাসে অক্সিজেন বৃদ্ধি ও কার্বন ডাই-অক্সাইড হ্রাসের জন্য আমরা অতি-আগ্রহে বৃক্ষরোপণের কথা বলে থাকি, সঙ্গে অবশ্য কিছু আর্থিক সুফলের বিষয়ও থাকে। তবে আমাদের অতিঘন জনবসতি ও জমির তীব্র সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে এর উদ্দেশ্য ও সাফল্যের সমীকরণ মেলাতে হবে।
আমাজন রেইন ফরেস্ট আয়তনে ৫০ লাখ বর্গকিলোমিটার এবং ধরা হয়, সেখান থেকে ভূমণ্ডলের মোট ২০ শতাংশ অক্সিজেন তৈরি হয়। বাংলাদেশের সম্পূর্ণ সমতল প্লাবনভূমিজুড়ে (এক লাখ বর্গকিলোমিটার) যদি আমরা বন তৈরি করি, তবে সেখান থেকে ভূমণ্ডলের মোট মাত্র শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ অক্সিজেন উ ৎপাদিত হবে। বিশ্বমঙ্গলের জন্য এটুকু করতে হবে আমাদের সর্বস্ব জমি খুইয়ে।
কার্বন ডাই-অক্সাইড নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারেও হিসাব আমাদের অনুকূলে নয়। পৃথিবীতে বছরে ব্যবহূত চার হাজার কোটি ব্যারেল জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে প্রতিবছর এক হাজার কোটি টন বাড়তি কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে যুক্ত হচ্ছে। বাংলাদেশে আমরা বছরে চার কোটি টন জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করি, যা থেকে সৃষ্ট কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ এক কোটি টন, বৈশ্বিক পরিমাণের মাত্র শূন্য দশমিক ১ শতাংশ। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়ায় ১০টি মাঝারি আকারের গাছ বছরে এক টন কার্বন ডাই-অক্সাইড সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে আয়ত্তীকরণ করতে পারে। তাই এক কোটি টন কার্বন ডাই-অক্সাইড সরানোর জন্য প্রয়োজন ১০ কোটি মাঝারি আকারের গাছ। আমাদের দেশে বৃক্ষের সংখ্যা নিঃসন্দেহে এর চেয়ে বেশি। তারপর রয়েছে শস্যখেত আর লতাগুল্মের বছরব্যাপী বিস্তীর্ণ সবুজ আচ্ছাদন, যা আমাদের সৃষ্ট কার্বন ডাই-অক্সাইড সম্পূর্ণ আয়ত্তীকরণের জন্য যথেষ্ট। বিশ্বের বাড়তি কার্বন ডাই-অক্সাইড নিয়ন্ত্রণে আমাদের করণীয় সামান্য, সারা দেশ গাছ দিয়ে ঢেকে ফেললেও আমরা এর মাত্র শূন্য দশমিক ২ শতাংশের প্রতিকার করতে পারব। বিশ্বের বাড়তি কার্বন ডাই-অক্সাইডের মূল জনক যেমন আমরা নই, তেমনি এর জনক যেসব দেশ, তাদের জমির পরিমাণ অনেক বেশি, বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে কার্বন ডাই-অক্সাইড কমানোর নৈতিক দায়িত্ব তাদেরই। আমাদের জন্য এই ত্যাগের পরিণতি হবে দুর্ভিক্ষ ও মৃত্যু।
বৃক্ষায়নের মাধ্যমে বায়ুশুদ্ধিতে আমাদের সম্ভাব্য অবদান যেমন সীমিত, তেমনি নতুন প্রস্তাবিত বৈশ্বিক কার্বন-বাণিজ্যে আমাদের সুবিধা অনিশ্চিত। বায়ুমণ্ডলে কার্বন কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ২০০৫ সালের কিয়োটো চুক্তিতে কিছুসংখ্যক শিল্পোন্নত দেশ কার্বন-বাণিজ্যের বিষয়টি উপস্থাপন করে। যেসব দেশ কার্বন নির্গমন কম করে, তাদের কার্বন ক্রেডিট বেশি ধরা হয়। এই বাণিজ্যকাঠামো শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে একধরনের, আর শিল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অন্য ধরনের। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে যে পদ্ধতিটি উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য ফরমায়েশ করা হয়, সেটি হচ্ছে পরিচ্ছন্ন উন্নয়ন-প্রক্রিয়া। এতে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে শিল্পোন্নত দেশগুলো সিডিএম প্রকল্পের মাধ্যমে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড বা অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস কমবে এমন সব প্রকল্পে অর্থ সাহায্য করে থাকে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে সত্যায়িত নির্গমন হ্রাস বা ইউনিট অর্জিত হয়। বাতাসে এক টন কার্বন ডাই-অক্সাইড বা তার সমপরিমাণ অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস কমাতে পারলে এক সিইআর ইউনিট অর্জিত হয়, যা কার্বন-বাণিজ্যের বাজারে লাভজনকভাবে ব্যবহার করা যায়। বর্তমানে এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকা মহাদেশের অনেক দেশ নানা ধরনের সিডিএম প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। আমাদের অঞ্চলে চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড এ ক্ষেত্রে অগ্রগামী। বাংলাদেশের নাম বর্তমানে প্রকল্পের তালিকায় দেখা যায় না।
পর্যাপ্ত পতিত জমি ছাড়া কোনো ধরনের কৃত্রিম বনায়ন সম্ভব নয়। প্রাকৃতিক নিয়মে বন কেটে হয়েছে আবাসন খেতখামার। আজ বিশ্বে বিপরীত কাজটির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে কৃত্রিম পদ্ধতিতে, এখানে সমন্বয় কঠিন। তাই বনায়নের দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল নিয়ে নানা বৈজ্ঞানিক অনিশ্চয়তা অহেতুক নয়। আমরা পতিত জমির অভাব বিকল্প পথে মেটাতে চেষ্টা করছি, রাস্তার দুই পাশ ঘেঁষে ঘন বৃক্ষসারি সৃষ্টি হয়েছে, যার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কোনো দেশেই দেখা যায় না। গ্রামাঞ্চলে দিন দিন বসতবাড়ির সংখ্যা বাড়ছে, প্রতিটি নতুন বাড়িতে বৃক্ষায়ন হচ্ছে যথারীতি উচ্চমাত্রায়। আজ নিয়তই দৃষ্টির আড়ালে চলে যাচ্ছে দর্শনীয় স্থানগুলো—মনুমেন্ট, অট্টালিকা, সুন্দর ভাস্কর্যকর্ম। তা ছাড়া নদীতীরে, খোলা মাঠের চারপাশে কোথাও খালি জায়গা আর দেখা যায় না। তাই জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী নিবিড় বৃক্ষায়নের কারণে বর্তমানে আমাদের ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার প্রায় সবটুকুই বন হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। বনায়নে আমাদের অর্জন অকিঞ্চি ৎ নয়, তবে তা কতটুকু বিজ্ঞানসম্মতভাবে হয়েছে এবং সেখানে আমাদের ঈপ্সিত অর্থনৈতিক সাফল্য কতটুকু, সে বিষয়টি স্পষ্ট নয়।
অতিঘন বৃক্ষায়নের নেতিবাচক দিকের বিবেচনায় আমাদের অনীহা লক্ষণীয়। উচ্চগতি যানবাহনের নিরাপত্তার জন্য মহাসড়কের দুই পাশ খালি রাখতে হয়। রৌদ্র-ছায়ার মিশ্রণ রাস্তার ওপরিভাগে অসম তাপ বিতরণ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, যা রাস্তার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। মহাসড়কের ওপরে ধনুকাকৃতি বৃক্ষখিলান সড়কের জন্য ক্ষতিকর কি না, তার বিশ্লেষণ অবহেলার বিষয় নয়। ঘন বৃক্ষছায়া স্যাঁতসেঁতে পরিবেশের সৃষ্টি করে, যা মানুষের স্বাস্থ্য ও ঘরবাড়ির জন্য ক্ষতিকর হয়ে থাকে বলেই আমাদের সনাতন ধারণা। বসতবাড়ির বৃক্ষছায়া পার্শ্ববর্তী কৃষিখেতের অংশবিশেষে উ ৎপাদন হ্রাস করতে পারে, সে সম্ভাবনা অহেতুক নয়। অতিঘন বৃক্ষরোপণের কারণে গাছ মাটি থেকে যথেষ্ট পরিমাণ পুষ্টি উপাদান পায় না, আর সূর্যালোকের অভাবে সালোকসংশ্লেষণ ব্যাহত হয়। এতে গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বিঘ্নিত হয়। আজ কৃত্রিম বনাঞ্চলের ঘন বৃক্ষরাজির দিকে তাকালে এই দৃশ্য দৃষ্টি এড়ায় না।
ধরিত্রীর সম্পদ সীমাহীন নয়, এর ধারণক্ষমতাও তাই সীমাহীন হতে পারে না। মানুষের অতি-উন্নত মস্তিষ্কের কারণেই হয়তো নিজের নিয়ন্ত্রণে সে দুর্বল, সম্পদ বিতরণে ভারসাম্য অর্জন মানুষের জন্য তাই এত কঠিন। এ ক্ষেত্রে মানুষের জীবতাত্ত্বিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে বলেই সংখ্যায় সীমাবদ্ধতা আজ তার জন্য এত বেশি প্রয়োজন।
জিয়া উদ্দিন আহমেদ: ভিজিটিং প্রফেসর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.