বিশেষ সাক্ষাৎকার-বাংলাদেশে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছি by তাইয়ুং চো

দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত তাইয়ুং চো জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৮ সালের ১৯ মে। কোরিয়ার সিউল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটা থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে তিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। কূটনৈতিক জীবনের শুরু ১৯৮১ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে।
গত তিন দশকের কূটনৈতিক জীবনে জাপান, পাকিস্তান ও ইতালিতে বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত থেকে তিনি দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। এ ছাড়া দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উত্তর-পূর্ব এশিয়া ব্যুরোর মহাপরিচালকের পদেও কাজ করেছেন। চো ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশে দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত হন।
 সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাহীদ এজাজ

প্রথম আলো  গত বছর উত্তর কোরিয়ার টর্পেডো ছিওনানের আঘাতে দক্ষিণ কোরিয়ার রণতরী ডুবে ৪৬ নাবিকের হত্যাকাণ্ডের কারণে দুই কোরিয়ার মধ্যে নতুন করে তিক্ততার সৃষ্টি হয়। এর প্রেক্ষাপটে কোরীয় উপদ্বীপের সর্বশেষ পরিস্থিতিটা কেমন?
তাইয়ুং চো  গত জুলাইয়ে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত আসিয়ান আঞ্চলিক ফোরামের (এআরএফ) বৈঠকের ফাঁকে দুই কোরিয়ার মধ্যে বৈঠক হয়। আমরা সব সময় কোরিয়াকে নিয়ে সংলাপ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি এ প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে যুক্ত রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। এআরএফের আলোচনায় আমরা কোরিয়া উপদ্বীপ ও উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করেছি। এ বিষয়ে আমরা আমাদের অবস্থান সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছি। যদি উত্তর কোরিয়া ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে পারমাণবিক অস্ত্রবিরতির ব্যাপারে আলোচনা করতে চায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও জাপানকে নিয়ে আমরা ছয় দেশের আলোচনা অনুষ্ঠান আয়োজন করতে তৈরি আছি।
প্রথম আলো  আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অব্যাহত আহ্বানের পরও পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে উত্তর কোরিয়া। এ পরিস্থিতিতে পিয়ংইয়ংকে নিবৃত্ত করতে সিউল সর্বশেষ কী পদক্ষেপ নিয়েছে?
তাইয়ুং চো  উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি আমাদের জন্য বিশেষ উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মারণাস্ত্র নিয়ে উত্তর কোরিয়ার এই উদ্যোগ শুধু দক্ষিণ কোরিয়ার জন্যই নয়, শঙ্কা তৈরি করেছে বিশ্বসম্প্রদায়ের জন্যও। পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে উত্তর কোরিয়ার এই উচ্চাভিলাষ আমাদের জন্য বিশাল এক সংকট তৈরি করেছে।
প্রথম আলো  তার মানে কি এই মুহূর্তে কোরিয়া উপদ্বীপে কোনো উত্তেজনা নেই?
তাইয়ুং চো  গত বছরের মতো কোনো উত্তেজনা আমি এখন কোরীয় উপদ্বীপে দেখছি না।
প্রথম আলো  আপনি কি আশাবাদী যে উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে সরে আসবে?
তাইয়ুং চো  আমি আশাবাদী তারা সরে আসবে। কারণ, আমরাসহ সবাই চাই, পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে মুক্ত থাকবে কোরীয় উপদ্বীপ। আমাদের অবশ্যই উচিত হবে, উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক অস্ত্রবিস্তার কর্মসূচি থেকে বিরত রাখা।
প্রথম আলো  দক্ষিণ কোরিয়ার বর্তমান সরকারও কি ‘সানশাইন পলিসি’ অনুসরণ করছে?
তাইয়ুং চো  অবশ্যই আমরা উত্তর কোরিয়াকে সহায়তা করতে চাই। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাদেরকে পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে সরে আসার আলোচনায়ও বসাতে চাই। আমরা তাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখতে চাই না; তাদের ওপর চাপও দিতে চাই না। আমরা তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চাই। তবে তারা পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে যাবে, এটা আমরা মেনে নেব না।
প্রথম আলো  তার মানে পারমাণবিক কর্মসূচি বাদ দিলেই তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবেন?
তাইয়ুং চো  নিশ্চয়ই। দক্ষিণ কোরিয়ার কর্তৃপক্ষ এ মুহূর্তে উত্তর কোরিয়ার জন্য বড় ধরনের সহযোগিতা দেওয়া বন্ধ রেখেছে। কিন্তু বন্যা ও দুর্ভিক্ষের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে উত্তর কোরিয়ার প্রতি মানবিক সাহায্য আমরা দিয়ে আসছি।
প্রথম আলো  সম্প্রতি এ ধরনের কোনো মানবিক সহায়তা দিয়েছেন কি?
তাইয়ুং চো  এ বছর দক্ষিণ কোরিয়ার বেসরকারি সাহায্য সংস্থাগুলো উত্তর কোরিয়ার বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য চার হাজার টন ময়দা পাঠিয়েছে। আর সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে ৪২ লাখ ডলারের সমপরিমাণ ত্রাণসাহায্য। একটু আগেই যেটা বলছিলাম, বড় ধরনের অর্থনৈতিক সহায়তা বন্ধ রাখলেও পরিস্থিতি অনুযায়ী উত্তর কোরিয়াকে মানবিক সাহায্য দিতে আমরা এতটুকু কার্পণ্য করছি না।
প্রথম আলো  দুই কোরিয়ার মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ কেমন?
তাইয়ুং চো  ২০১০ সালে দুই দেশে ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়েছে।
প্রথম আলো  গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিউল সফরের সময় বাংলাদেশ থেকে আরও পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। এ ব্যাপারে কতটা অগ্রগতি হয়েছে?
তাইয়ুং চো  বাংলাদেশের পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়ে থাকে দক্ষিণ কোরিয়া। ক্রমান্বয়ে শুল্কমুক্ত পণ্যের তালিকা বাড়ছে। গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিউল সফরের আগ পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ৮৫ ভাগই ছিল শুল্কমুক্ত পণ্যের আওতায়। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের রপ্তানির ৯০ ভাগই যাচ্ছে শুল্কমুক্ত তালিকার আওতায়। তার মানে এ বছর বেড়েছে পাঁচ ভাগ। আগামী দিনে এ হার আমরা আরও বাড়াতে চাই। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের চার হাজার ৪১৯টি পণ্য দক্ষিণ কোরিয়ায় শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাচ্ছে।
প্রথম আলো  ওই সফরে ইডিসিএফের আওতায় যে ঋণ দেওয়ার কথা হয়েছে, সে ব্যাপারে নতুন কোনো উদ্যোগ আছে কি?
তাইয়ুং চো  ২০১০-২০১২ সাল পর্যন্ত তিন বছরের জন্য ইডিসিএফের আওতায় বাংলাদেশকে ২০০ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। গত বছরই এটি জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ বছরের আগস্ট পর্যন্ত ১৬৬ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে। এটা হচ্ছে সহজ শর্তে ঋণ। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ঋণের পরিমাণ বাড়ানোর অনুরোধ জানানো হয়েছে। এই অনুরোধে আমরা ইতিবাচক সাড়া দেওয়ার কথা ভাবছি।
প্রথম আলো  ঋণের পরিমাণ বাড়ানোর কথা ভাবছেন কেন?
তাইয়ুং চো  যেহেতু সময় আছে, তাই এ সময়ের মধ্যে বাড়তে পারে। প্রথমত, বাংলাদেশের উন্নয়নে বাইরের সহযোগিতা প্রয়োজন। তাই বাংলাদেশকে আমরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে চাই। দ্বিতীয়ত, সহজ শর্তে পাওয়া ঋণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়ে আসছে বাংলাদেশ। এ দুটি কারণে আমরা বাংলাদেশের অনুরোধে ইতিবাচক সাড়া দেওয়ার কথা ভাবছি।
প্রথম আলো  কর্মসংস্থানের বিশেষায়িত প্রক্রিয়ার (এমপ্লয়মেন্ট পারমিট সিস্টেম—ইপিএস) আওতায় বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হয়েছে। ভাষা শিক্ষার পরীক্ষায় কিছু অনিয়ম ধরা পড়ায় এ প্রক্রিয়াটি বন্ধ রয়েছে। বিষয়টির কবে ও কীভাবে সুরাহা হবে?
তাইয়ুং চো  আমরা বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নাগরিকদের দক্ষিণ কোরিয়ায় কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে চাই। ইপিএসের আওতায় ২০০৯ সালে বাংলাদেশের তিন হাজার ৮০০ জন দক্ষিণ কোরিয়ায় গেছে। আমি গত বছর ঢাকায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে যোগ দেওয়ার পর সংখ্যা বাড়ানোর ব্যাপারে আলাপ শুরু করি এবং বাংলাদেশিদের জন্য সংখ্যা বাড়িয়ে চার হাজার ৪০০-তে নিয়ে যেতে পেরেছি। এ বছর সংখ্যাটি চার হাজার ৮০০-তে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিই। এ থেকেই কিন্তু বোঝা যায়, আমরা বাংলাদেশের বেশি লোকজনকে কাজ দিতে চাই। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ায় যোগ দেওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে বাধ্যতামূলকভাবে ভাষা শিক্ষার প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু অনিয়ম ধরা পড়েছে। আমরা দেখতে পেয়েছি, কিছু আবেদন প্রার্থী ভুয়া পরিচয়পত্র জমা দিয়ে নাম নিবন্ধন করেছেন। বিষয়টি আমাদের জন্য গভীর উদ্বেগের। কেউ যদি ভুয়া পরিচয়পত্র দিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় যায়, তা আমাদের জন্য নিরাপত্তাজনিত হুমকি তৈরি করতে পারে। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে আমাদের যে সম্পর্ক, সে প্রেক্ষাপট থেকে দেখলে বলা যায়, মিথ্যা পরিচয় দিয়ে কারও দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবেশ আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকির কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। কাজেই দক্ষিণ কোরিয়ায় কাজ পেতে আগ্রহী কোনো বাংলাদেশি যদি মিথ্যা পরিচয়ে আমাদের দেশে ঢোকে, সেটি আমাদের জন্য গভীর উদ্বেগের। এ ব্যাপারে আমাদের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের ধারাবাহিক আলোচনা হয়েছে। এরপর বাংলাদেশ সরকার যে পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে, তাতে আমরা যথেষ্ট সন্তুষ্ট। কাজেই খুব শিগগির আমরা ভাষা শিক্ষার পরীক্ষা পুনরায় শুরু করতে পারব।
তবে ভাষা শিক্ষার পরীক্ষা বন্ধ থাকলে দক্ষিণ কোরিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমিকদের যাওয়া কিন্তু থেমে নেই। এর আগে যাঁরা চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁরা নিয়মিতভাবেই বাংলাদেশ ছাড়ছেন।
প্রথম আলো  চট্টগ্রামে কেইপিজেড প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অনেক দিন আগেই চুক্তি হয়েছে। এখনো এটি বাস্তবায়িত হয়নি। এ প্রকল্পটি এখন কোন পর্যায়ে রয়েছে?
তাইয়ুং চো  দুই দেশের সরকার চট্টগ্রামে কেইপিজেড প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৯৫ সালে চুক্তি স্বাক্ষর করে। এরপর পেরিয়ে গেছে ১৬ বছর। অনেকেই আমার কাছে জানতে চান, এটি শুরু হতে এত বেশি সময় লাগছে কেন? ১৬ বছর পার হলেও আমরা বিশেষায়িত রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকাটি চালু হতে দেখিনি। কিন্তু আমি সব সময় বলে আসছি, কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে কিছু বিষয়ের নিষ্পত্তি হয়নি। ওই বিষয়গুলোর জন্য এত বেশি সময় লাগছে। রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকাটি তৈরি করতে ১৯৯৯ সালে লাইসেন্স পাওয়ার আবেদন জানায় কেইপিজেড করপোরেশন এবং লাইসেন্স পায় ২০০৭ সালে। এখনো সেখানকার জমি কেইপিজেড করপোরেশনের নামে নিবন্ধন হয়নি। তবে এটাও ঠিক যে ওই প্রকল্পের অনেকগুলো অনিষ্পন্ন বিষয়ের সুরাহা আলোচনার মাধ্যমে হয়েছে। এখনো কয়েকটি বিষয়ের সুরাহা হয়নি। তার পরও কেইপিজেডকে কাজের জন্য তৈরি করার প্রক্রিয়া কিন্তু থেমে নেই। আশা করছি, আগামী পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে বিশেষায়িত রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকাটি উৎপাদনের জন্য পুরোপুরি তৈরি হয়ে যাবে। এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো, এটি পুরোপুরি তৈরি হওয়ার আগেই কর্ণফুলী শু ফ্যাক্টরি নামের একটি জুতার কারখানা উৎপাদন শুরু করবে। ইয়াংওয়ান করপোরেশনের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটি হবে বিশ্বের সর্ববৃহৎ জুতার কারখানা। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে ৪০ হাজার লোকের।
প্রথম আলো  ধন্যবাদ।
তাইয়ুং চো  আপনাকেও ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.