দান করুন নীরবে ও প্রয়োজন বুঝে by মুফতি এনায়েতুল্লাহ

দানশীলতা একটি উত্তম গুণ। ইসলাম দানশীলতাকে উৎসাহ দিয়ে পরনির্ভরশীল হওয়াকে নিরুৎসাহিত করেছে। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'ওপরের হাত নিচের হাত থেকে উত্তম, আর যারা তোমার অধীনে আছে, তাদের থেকেই দান করা শুরু করো। আর উত্তম দান হচ্ছে তা, যা প্রাচুর্য থেকে প্রদান করা হয়' (বুখারি ও মুসলিম)।


ইসলাম মানুষকে দানশীল ও পারস্পরিক কল্যাণকামী হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি প্রতিদিনের ইবাদত-বন্দেগিতে মগ্ন থেকে সহানুভূতি, সদয় আচরণ এবং দানশীলতার মাধ্যমে ইহকালীন কল্যাণ ও পারলৌকিক মুক্তির পথ তৈরির জন্য বিশেষ তাগিদ দেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষ আল্লাহর পথে ব্যয় করতে উদ্বুদ্ধ হয়। দানশীলতা সম্পর্কে হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত আছে, 'আল্লাহতায়ালা বলেছেন, হে আদম সন্তান! তুমি দান করতে থাকো, আমিও তোমাকে দান করব' (বুখারি ও মুসলিম)।
দাতার হাত দানগ্রহীতার হাত থেকে উত্তম। দাতা শ্রেষ্ঠ এ জন্য যে তিনি দানশীলতার মাধ্যমে অন্যের উপকার করেন। দান প্রসঙ্গে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'একজন কৃপণ আবেদের চেয়ে একজন মূর্খ দানশীল ব্যক্তি আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়।' আমাদের সমাজের প্রচুর লোক খাদ্য-পানীয়ের অভাবে নিপতিত। এমন গরিব-দুঃখী ও দরিদ্র-অসহায় লোকদের কষ্ট লাঘবে সমাজের ধর্মপ্রাণ ধনী সামর্থ্যবান ব্যক্তির সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত।
দানশীলতা প্রসঙ্গে হজরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) বলেছেন, 'নামাজ মানুষকে আল্লাহর পথে অর্ধেক পেঁৗছে দেয়। রোজা তাকে আল্লাহর ঘরের দরজার কাছে পেঁৗছায়। আর দান-খয়রাত তাকে খোদ আল্লাহর ঘরে পেঁৗছে দেয়।' সুতরাং প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের একান্ত কর্তব্য হলো স্বীয় ধন-সম্পদকে দুস্থ মানবতার সেবায় সাধ্যমতো ব্যয় করা। এ দান হতে পারে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও সামষ্টি। ব্যক্তিকেন্দ্রিক বলতে দুস্থ, নিঃস্ব, গরিব, এতিম, মিসকিন, বস্ত্রাভাবী, পঙ্গু, অন্ধ, আশ্রয়হীন, অভাব-অনটনগ্রস্ত অসহায় মানুষকে বোঝায়। আর সামষ্টিক বলতে বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক সামাজিক কাজ, যেমন_ মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা, হাসপাতাল ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠাকে বোঝায়।
অনেককেই দেখা যায়, সাহায্যপ্রার্থীকে ধমক দিয়ে কথা বলছে বা তাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। সাহায্যপ্রার্থীর সঙ্গে এমন ব্যবহার ও কথা বলতে কোরআনে নিষেধ করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, 'তুমি দানপ্রার্থীকে ধমক দিও না।' শুধু এ কথা বলেই আল্লাহতায়ালা ক্ষান্ত হননি, তিনি আরও ইরশাদ করেন, 'কোনো কিছু দানপ্রার্থীকে দান বা খয়রাত দেওয়া হোক বা না হোক কোনো প্রকার কষ্টদায়ক কথা বলার চেয়ে একটি মিষ্টি মধুর কথা বলাই উত্তম।' আল্লাহতায়ালার বাণীতে স্পষ্ট বোঝা যায়, অভাব-অভিযোগের তাড়নায় যারা সাহায্য চাইতে এসেছে, তারা তো মানুষ। এদেরও ক্ষুধা রয়েছে, চাহিদা রয়েছে। তাই তাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না করে সম্ভব হলে কিছু দান করে তাকে সাহায্য করা।
উল্লেখ করা যেতে পারে, দান-খয়রাতের ক্ষেত্রে অনেকেই নিজেদের ব্যবহৃত অকেজো-অযোগ্য পুরনো জিনিসপত্র প্রদান করে থাকে। এ দানে নেকি অর্জন সম্ভব নয়, বরং সাহায্য সেবার মর্যাদাকেই পরোক্ষভাবে ক্ষুণ্ন করা হয়। সুতরাং এমন জিনিস দান করা থেকে বিরত থাকা উত্তম।
তবে দানকারীদের প্রতি একটি বিশেষ পরামর্শ থাকবে, দানটি আপনি নিজ হাতেই করুন। না হলে সেই দান বেহাত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। কারণস্বরূপ বলা যায়_ ইদানীং মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানার নামে এক শ্রেণীর লোক টাকা কালেকশন করে নিজেরাই তা ভোগ করছে। এ ছাড়া প্রায়ই দেখা যায়, চলন্ত বাসে কিছু লোক যাত্রীদের হাতে বিভিন্ন আবেদন সংবলিত কাগজ ধরিয়ে দিয়ে দ্বিনের কাজে দান করার ফজিলত বর্ণনা করে ভুয়া রসিদ প্রদর্শন করে অস্তিত্বহীন বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানার নামে সাহায্য প্রার্থনা করছে। এই ভাঁওতাবাজির ফলে প্রকৃত অর্থে প্রয়োজন এমন স্থানে মানুষ দান করছে না। আর এই দানের সঙ্গে যেহেতু ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট জড়িত, তাই জানা থাকা সত্ত্বেও রাস্তায় ঠিক সেভাবে কেউ প্রতিবাদও করে না। ফলে তারা এই অপকর্ম করে বারবার পার পেয়ে যাচ্ছে। আমরা আশা করব, সমাজের দানশীল লোকেরা প্রয়োজন বুঝে, দেখেশুনে খোঁজ নিয়ে এসব জায়গায় দান করবেন।
ইসলাম অসহায় ও দুস্থ মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ প্রত্যাশা করে। তেমনি সামাজিক বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে পরস্পরকে উদ্বুদ্ধও করে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হচ্ছে, 'যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের পার্থিব দুঃখ-কষ্ট দূর করবে আল্লাহ তার কিয়ামতের দুঃখ-কষ্ট দূর করবেন। যে ব্যক্তি এতিম, অসহায় ও সংকটাপন্ন ব্যক্তির প্রয়োজন ও সংকট নিরসন করবে, আল্লাহ তার দুনিয়া ও আখিরাতের যাবতীয় সংকট নিরসন করবেন। আর আল্লাহতায়ালা ততক্ষণ মানুষের সঙ্গে থাকেন যতক্ষণ মানুষ এতিম-মিসকিন, অসহায় ও মজলুম মানুষের সাহায্যরত থাকে' (বুখারি ও মুসলিম)।
muftianaet@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.