কালের যাত্র by পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

সারা বনময় কারা যেন হাঁটে। ফিসফিস শব্দ। চোখে দেখি না, বুকে টের পাই। 'শকুন্তলা' নাটকে নাট্যকার সেলিম আল দীন এই রকম সংলাপ লিখেছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে গেলে এই সংলাপটি খুব মনে হয়। মনে হয় সারা পাহাড়ে কারা যেন ঘুরঘুর করে, ফিসফিস শব্দ, চোখে দেখি না; কিন্তু বুকে টের পাই।


আমার এই বুকে টের পাওয়ার ভেতরে অমঙ্গলের আশঙ্কা থাকে। অশুভ কিছুর পাঁয়তারা বোধ হয়। পাহাড়ে যাই অনেক বছর ধরে। প্রথম প্রথম যেমন রোমাঞ্চিত হতাম, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য-দর্শনে আজও সে রকম হই। পাহাড়ি মানুষদের কঠিন এবং বৈচিত্র্যময় জীবনযাপন দেখে আগেও যেমন আনন্দ পেতাম, আজও তেমনি পাই। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরং গোত্রের ঐতিহ্যিক বর্ণময় সংস্কৃতিচর্চা মুগ্ধ হয়ে দেখি। তবু কোথায় যেন শুভসংগীত শুনতে পাই না। গত কয়েক দশকে পার্বত্য অঞ্চলে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যা দুর্ভাবনা বাড়ায়। এখনো এমন কিছু মাঝেমধ্যে ঘটে, যা কাঙ্ক্ষিত নয়। অথচ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশের এই পাহাড়ি অঞ্চলে সুখ, সমৃদ্ধি এবং শান্তির বন্যা বয়ে যাওয়াই তো উচিত ছিল। অসম্ভব উর্বর জমিন, অঢেল ফল-সম্পদ, শস্যরাজি, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, সহজ-সরল মানুষ ইত্যাদি মিলে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো অনেক কিছুই তো আছে বাংলাদেশের এই অঞ্চলে। এ কারণেই বোধ হয় স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা চালায় স্বার্থান্বেষী মহল এবং তাদের নানাভাবে মদদ দেয় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের বিশেষ গোষ্ঠী। অর্থ দিয়ে, কুবুদ্ধি দিয়ে, ভুল তথ্য দিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করাই বোধ হয় তাদের কাজ। লোভ এবং মোহের বশবর্তী হয়ে ভুল পথে চলে এ অঞ্চলের মানুষ তাদের সহজাত সারল্য হারিয়েছে। না, সবার কথা বলছি না। যারা চতুর এবং ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চায় তারাই এ অঞ্চলে সমস্যা তৈরি করেছে এবং সংকট সৃষ্টি করেই চলেছে। এই সুযোগে পাহাড়ের গহিনে চলছে অস্ত্রের দাপট, মাদক ব্যবসা, অহেতুক হত্যা, উদ্দেশ্যপূর্ণ ধর্ষণ এবং সাধারণ মানুষের ওপর অনৈতিক অত্যাচার ও শোষণ। গোত্রে গোত্রে বৈষম্য হয়তো আগেও ছিল। কিন্তু ইদানীং তাকে উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে উসকে দেওয়া হচ্ছে। উন্নয়নের নামে চলছে সুদূরপ্রসারী আধিপত্য সৃষ্টির চেষ্টা। অতিপ্রাচীন ভূমি সমস্যার সহজ সমাধানে রাষ্ট্রীয় নিয়মরীতিকে অবজ্ঞা ও অস্বীকার করার চেষ্টাও বেশ স্পষ্ট। পাহাড়ি অঞ্চলে সমতলের মানুষ অনেক আগে থেকেই ছিল। গত ত্রিশ বছরে তা অবশ্যই বেড়েছে। বাংলাদেশের মানচিত্রের অধিবাসী হিসেবে তারা তাদের ন্যায্য অধিকারের দাবি তুলবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। সমতলভূমির এসব মানুষ বাঙালি। তাদের অনেকের শিকড় দীর্ঘদিনে অনেক গভীরে প্রোথিত হয়েছে। তাদের অবস্থানকে মেনে নিতে না পারলে তো ভুল হবে। এসব মানুষকে 'সেটেলার' বলে যাঁরা বিরোধ সৃষ্টির চেষ্টা করেন তাঁরা তো স্বাভাবিকতাকেই অস্বীকার করেন। ইতিহাস বলে মানুষ মাত্রই পরিযায়ী। মাইগ্রেশন তাদের সহজাত প্রবৃত্তি। এটা ঐতিহাসিক সত্য। বাঁচার প্রয়োজনে, একটু ভালো থাকার প্রয়োজনে মানুষ এক স্থান ছেড়ে নতুন স্থানে যায়, দেশান্তরীও হয়। যাঁরা পাহাড়ের আদি বাসিন্দা বলে দাবি করেন তাঁদের ইতিহাসও কিন্তু সে রকমই বলে। সুতরাং গত তিন দশকে যারা পাহাড়ি-বাঙালির বিরোধ সৃষ্টি করে বহুবার রক্ত ঝরিয়েছে, তাদের উদ্দেশ্য কখনোই ভালো হতে পারে না। নানামুখী ষড়যন্ত্রে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ফারাক বেড়েছে। জাতিতে জাতিতে, গোত্রে গোত্রে এই ফারাক কমিয়ে আনার চেষ্টা করে চলেছে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী। এ কথাটি অস্বীকার করা যায় না। গত প্রায় চার দশকে ওই অঞ্চলে স্বস্তি স্থাপনে তারা যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তা সব সময় শুভফল দিয়েছে তা বলা যাবে না। কিছু কিছু বিষয়ে যে সমালোচনার ঊধর্ে্ব ছিল না, তা অবশ্যই সত্য। তার দায় বর্তায় কিছু একক ব্যক্তির অদূরদর্শী ও অবিবেচনাপ্রসূত কর্মকাণ্ডের ওপর। কিন্তু সেনাবাহিনীর সার্বিক কর্মপ্রয়াসে বিশেষ করে শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর বর্তমান সময়ে তাদের প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানানো যায়। সম্প্রতি খাগড়াছড়ি ঘুরে এসে আমার অন্তত তা-ই মনে হয়েছে। খাগড়াছড়িতে সেনাবাহিনী পরিচালিত পাহাড়ি-বাঙালির কো-এডুকেশন স্কুল অ্যান্ড কলেজটি এ ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি রেসিডেন্সিয়াল। পাহাড়ি এবং বাঙালি ছাত্রছাত্রীদের কলকাকলিতে কে বলবে তাদের ভেতর আদৌ কোনো সমস্যা বা বৈষম্য আছে! বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ফারাক কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে এ উদ্যোগটি অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য। তবু পরিপূর্ণ স্বস্তি আসছে কোথায়! জেলার প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, স্থানীয় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, চাপা দুশ্চিন্তা আছে। বেশির ভাগ লোকই ঝেড়ে কাশেন না। এক গোত্রের প্রতি আরেক গোত্রের বৈষম্যের নীরব অভিযোগ বুকে টের পাওয়া যায়। অভিযোগ আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং এনজিওর কর্মকাণ্ডের ব্যাপারেও। প্রলোভনে ধর্মান্তরিত হওয়ার কথাও শুনেছি। গোটা পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ি মানুষের শিক্ষার হার নাকি শতকরা ৩৮ ভাগ। সবচেয়ে বেশি চাকমাদের ভেতর। তাদের হার শতকরা ৭২ ভাগ। পার্বত্য অঞ্চলে চাকমাদের সংখ্যাই বেশি। ১০ লাখ মারমার ভেতর শিক্ষিতের হার শুনেছি শতকরা ৭ ভাগ। ত্রিপুরাদের মধ্যেও প্রায় একই হার। সারা দেশে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বোধ হয় ৩০ লাখের মতো। সবচেয়ে বেশি ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বাস খাগড়াছড়ির মাটিরাঙা উপজেলায়। সংখ্যা ৪০ হাজার। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শেখ হাসিনার উদ্যোগে শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর আশা করা গিয়েছিল যে পাহাড়ে পুরোপুরি শান্তি ফিরে আসবে। আদতে তা হয়নি। শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করে গড়ে উঠেছে দল-উপদল। তারা একের পর এক হানাহানির ঘটনা ঘটিয়ে শান্ত পাহাড়ি অঞ্চলকে অশান্ত করার পাঁয়তারা চালিয়েই যাচ্ছে। গত বৈশাখে পাহাড়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রধান উৎসব বৈসাবির আনন্দধ্বনির সুর থামার আগেই খুন-খারাবি হয়েছে। বৈসাবি হচ্ছে ত্রিপুরা, মারমা এবং চাকমাদের প্রধান উৎসবের আদ্যক্ষর নিয়ে মিলিত শব্দ। অর্থাৎ ত্রিপুরাদের বৈশু, মারমাদের সাংগ্রাই এবং চাকমাদের বিজু_এই তিন উৎসবের আদ্যক্ষর মিলে বৈসাবি। মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ঘোষণায় পাহাড়িদের এই প্রধান উৎসবকে নাকি কেবল 'বিজু' বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যার ফলে ত্রিপুরা ও মারমাদের মনে জমেছে অভিমানের ক্ষোভ। বিষয়টি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় পুনর্বার বিবেচনা করে দেখলে ভালো হয়। যা-ই হোক, আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ভূমি, শিক্ষা, আইনশৃঙ্খলা ইত্যাদি মিলে পার্বত্য অঞ্চলে সৃষ্টি করা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে বিশাল পর্বতমালার ওপর জমেছে ধোঁয়াশার মেঘ। তেতে থাকা কড়াইয়ে নানা মহল থেকে দেওয়া হচ্ছে ঘিয়ের ফোঁটা। 'উপজাতি' এবং 'অ-উপজাতির' মধ্যে সম্পাদিত তাৎপর্যপূর্ণ শান্তিচুক্তির সমালোচনা, অপব্যাখ্যা এবং প্রতিবাদও করা হচ্ছে। অথচ '৯৭ সালের ডিসেম্বরে সম্পাদিত এই গুরুত্বপূর্ণ শান্তিচুক্তি বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে ক্ষমতাসীন সরকার-আমলে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পশ্চাৎপদ সংস্কৃতিতে শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। শান্তিচুক্তির প্রধান স্থপতি শেখ হাসিনা পুনরায় সরকার গঠন করে এই চুক্তি বাস্তবায়নের পথে সব কাঁটা দূর করার প্রয়াস ও উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু এর বিরুদ্ধেও চলছে নানা ষড়যন্ত্র ও কূটচাল। সাম্প্রতিককালে একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তোলা হয়েছে 'আদিবাসী' ইস্যু। পাহাড়ে-সমতলে, জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ ব্যাপারে চলছে নানামুখী কর্মকাণ্ড। বক্তৃতা-বিবৃতি-সেমিনার-ওয়ার্কশপসহ সর্বত্র পেটানো হচ্ছে প্রোপাগান্ডার হাতুড়ি। নানা দিক থেকে বাজানো হচ্ছে প্রচারণার ঢাক। এ ব্যাপারে পার্বত্য অঞ্চলের ওপিনিয়ন লিডারদের পাশে এসেছেন সমতলের কিছু বুদ্ধিজীবী। আরো আছেন প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কিছু 'সংবেদনশীল' মানুষ। 'আদিবাসী' ইস্যুটিকে সবাই বোধ হয় খুব সহজ চোখে দেখছেন। সরকারের কতিপয় ব্যক্তি এবং কোনো কোনো রাজনীতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বও যেভাবে বিষয়টি সম্পর্কে কথা বলেন; যাতে সরকার, আইন, গণমাধ্যম এবং জনগণ বিভ্রান্ত না হয়ে পারে না।

লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.