ভিন্নমত-বিনিয়োগের বর্তমান খরায় ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে না by আবু আহমেদ

অর্থমন্ত্রী মহোদয় আগামী অর্থবছরের জন্য ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছেন এবং তিনি এও বলেছেন যে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে না। আমরা অবশ্যই অর্থমন্ত্রীর সাফল্য কামনা করি। কারণ এটা অর্জন করা গেলে তা হবে গত অর্থবছরের অর্জন থেকে বেশি এবং বাংলাদেশের মতো উঠতি অর্থনীতির জন্য এই টার্গেট কম নয়।


এই টার্গেট যে বেশি নয়, তা আমরাও বলি। কারণ অতীতেও, সেই ২০০৫-০৬ অর্থবছরেও এই অর্থনীতি ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল। আর ৭-৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে না পারলে অর্থনীতিতে বেকারত্ব বাড়বে এবং দরিদ্র লোকের সংখ্যাও বাড়বে। তবে অর্থনীতিকে সামনের বছরগুলোতে আরো উচ্চ প্রবৃদ্ধিতে নেওয়ার ক্ষেত্রে যে ধরনের ম্যাক্রো ম্যানেজমেন্ট দরকার হবে, সেটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বরং যে আর্থিক শৃঙ্খলার ভিত আমরা গত এক যুগে গড়ে তুলেছিলাম, তা নষ্ট হতে বসেছে। এবারের বাজেটের কিছু গতি-প্রকৃতি আর পরিসংখ্যান দেখলেই সেই ব্যাপারটি বোঝা যাবে। এবার ঘাটতি বাজেট কত? ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এবার অতীতের ঋণের সুদ বাবদ কত ব্যয় হবে? ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এবার বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের আকার কত? ৪৬ হাজার কোটি টাকার। এবার রাজস্ব খাতে কত ব্যয় হবে? এক লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকার বাজেটের বাকি অংশ। তাহলে কী বোঝা যায়?
রাজস্ব ব্যয় প্রায় জ্যামিতিক হারে বাড়ছে, আর সেই তুলনায় উন্নয়ন ব্যয় শুধু পেছনেই পড়ছে। ঘাটতি বাজেট আর বার্ষিক উন্নয়ন ব্যয় প্রায় সমান সমান। এটা ঘটল, স্মরণ মতে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে এই প্রথমবার। ভবিষ্যতে মানে আগামী অর্থবছরে আমাদের স্থির বিশ্বাস, ঘাটতি বাজেট উন্নয়ন ব্যয়কে পেছনে ফেলে দেবে। সুদ ব্যয় হচ্ছে উন্নয়ন ব্যয়ের প্রায় অর্ধেক। সামনের বছরগুলোতে এই ব্যয় উন্নয়ন ব্যয়কেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। এর অন্য অর্থ হলো, পেছনের দায় পরিশোধ করার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে নতুন করে আরো বড় ঋণ নিতে হবে। এর অন্য অর্থ হলো, এক ঘাটতি বাজেট আরেক ঘাটতি বাজেটকে শুধু দৌড়াবে এবং পরবর্তী ঘাটতি বাজেট আগের ঘাটতি বাজেট থেকে শুধু বড়ই হবে। এর পরিণাম কী? এক দেউলিয়া সরকার। বিশ্বের অর্থনৈতিক ইতিহাসের অনেক দেউলিয়া সরকার দুই কৌশলের আশ্রয় নিয়ে দায় থেকে নিষ্কৃতি পেতে চেয়েছে, নতুবা অভিজ্ঞ খাতে এমন কিছু নীতি গ্রহণ করেছে, যার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি করে ঋণের প্রকৃত বোঝাকে কমিয়ে দিয়েছে। কূটকৌশল হলো, সরকারকে তার দায় প্রদানকে স্থগিত ঘোষণা করা। বলে দেওয়া যে সরকারি বন্ড ও ট্রেজারি বিলসের ওপর সময়মতো সুদ দেওয়া সম্ভব হবে না। অন্যটা হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বাধ্য করা বেশি করে নোট বা মুদ্রা ছাপিয়ে সরকারের হাতে অর্পণ করা। আর ওই নোট দিয়ে সরকার পুরনো ঋণ শোধ করতে থাকবে। তবে এর পরিণাম কী, জানেন তো? জনসাধারণের হাতে থাকা নোটের কোনো ক্রয়মূল্য থাকবে না। যে থলে করে আপনি বাজারে নোটগুলো নিয়ে গেলেন, দেখা যাবে নোটগুলো থেকে থলের মূল্য বেশি! অবশ্য এমন অবস্থা ঘটে অতি আপৎকালে। বহুদিন কোনো দেশ যদি যুদ্ধে লিপ্ত থাকে, তাহলেও এমন ঘটতে পারে। ছোট আপদ ঘটে যখন দেখবেন আপনার সরকার ঋণ করে ঘি খাওয়ার নীতি গ্রহণ করেছে। এই যে আজকে বিশ্ববাজারে স্বর্ণের এত মূল্য হলো এর পেছনে কারণ কী? বড় কারণ একটাই, লোকে ইউএস ডলারের মূল্যের ওপর আর আস্থা রাখতে পারছে না। কারণ বুশ ও ওবামা প্রশাসন যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে ট্রিলিয়ন ডলারের ঘাটতি বাজেটের দিকে নিয়ে গেছে, তাতে আমেরিকাবাসী এবং সেই সঙ্গে বিশ্ববাসীও ডলারের ক্রয়ক্ষমতার ওপর সন্দিহান হয়ে পড়েছে। তাই তারা সম্পদ ধারণের শক্তি হিসেবে আপাতত স্বর্ণকে প্রাধান্য দিচ্ছে।
অতিসম্প্রতি ঋণ করে ঘি খেতে গিয়ে ইউরোপের গ্রিস অতি বড় বিপদে পড়েছে। অতীতের ঋণ ফেরত দেওয়ার জন্য গ্রিসবাসীকে বেশি করে ট্যাঙ্ দিতে হবে। অথবা বর্তমানে কম ভোগ করতে হবে। তারা কোনোটাই করতে নারাজ। তাই তারা সরকারি আদেশের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এত কথা বলার উদ্দেশ্য হলো, ঘাটতি বাজেট বাংলাদেশের জন্যও বড়ই বিপদ ডেকে আনতে পারে। ঘাটতি বাজেট হলো, সরকার তার আয় থেকে বেশি ব্যয় করছে। বেশি কেন ব্যয় করছে? ভর্তুকি আর দান-অনুদানের বিশাল অঙ্কের টাকা ব্যয় করার জন্য। ঘাটতি বাজেট প্রথম দিকে মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি না-ও করতে পারে, যদি সরকার ঋণটা নেয় বন্ড বিক্রি করে জনগণের কাছ থেকে অথবা ব্যাংকিং সূত্র থেকে। তবে এতেও ক্ষতির দিক আছে। সরকার নিজে ঋণ করতে গেলে ব্যক্তিকে ঋণ পেতে কষ্ট হবে এবং দুই খাত যখন সমানে ঋণের জন্য প্রতিযোগিতা করবে, তখন সুদের হারও বেড়ে যাবে। আর শেষ পর্যন্ত ঘাটতি থেকে দায় অনেক বেড়ে গেলে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দিকে নজর দেয় অর্থ ছাপিয়ে মুদ্রা আনার জন্য। সেই নীতির ভয়ানক ফল হলো অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি করা। সুতরাং দান-অনুদান ও ভর্তুকির অর্থনীতি যাঁরা ভালো বলেন, তাঁরা অনেক কিছুই না জেনে বলেন। ঘাটতি বাজেট অর্থনীতিকে ডোবাতে থাকবে যদি বাজেটের সিংহভাগ রাজস্ব খাতে ব্যয় হতে থাকে, যে লক্ষণ আজকের বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ফুটে উঠেছে।
কেন বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমান অবস্থায় প্রস্তাবিত ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে না, সে ব্যাপারে কিছু ব্যাখ্যা দিতে চাই। ক্যাপিটাল-আউটপুট অনুপাত (ঈধঢ়রঃধষ-ড়ঁঃঢ়ঁঃ ৎধঃরড়) যদি চার হয়, যা আমাদের অথনীতিতে বিরাজিত বলে পুরনো হিসাব-নিকাশ বলে, তাহলে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য জিডিপির কমপক্ষে ২৮ থেকে ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে। আমাদের জিডিপি যদি ডলারে ১২০ বিলিয়ন বা তার থেকে কম-বেশি হয়, তাহলে এই প্রবৃদ্ধি অর্জন করার জন্য বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে ৩২ থেকে ৩৬ বিলিয়ন ডলার। এখন সরকারি খাত যদি ৪৬ হাজার কোটি টাকা বার্ষিক উন্নয়ন খাতে ব্যয় করে, যা ডলারের হিসাবে হবে কম-বেশি ছয় বিলিয়ন ডলার। আর উন্নয়ন কর্মসূচি বৃদ্ধি ৫০ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়, তাহলে সরকার বড়জোর তিন-চার বিলিয়ন ডলার উন্নয়ন খাতে খরচ করতে পারবে। এর অর্থ হচ্ছে বাকি বিনিয়োগ, অর্থাৎ ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি আসতে হবে বেসরকারি খাত থেকে। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের জন্য অর্থের প্রধান দুটো উৎস হলো ক্যাপিটাল মার্কেট তথা শেয়ারবাজার এবং ব্যাংকিং খাত। বর্তমানে শেয়ারবাজার প্রায় অচল অবস্থায় পড়ে আছে। তারল্য সংকট, আস্থাহীনতা এই বাজারকে প্রায় প্রাণশূন্য করে চলেছে। যে বাজারে এক দিনে টার্নওভার বা লেনদেন হতো তিন হাজার কোটি টাকার বেশি, আজকে সেটা হচ্ছে ৩০০-৪০০ কোটি টাকা। গত তিন-চার মাসে কোনো নতুন আইপিও বিক্রি বা গণ-অফার দিয়ে বাজার থেকে অর্থ তোলার প্রস্তাব আসেনি। গত ডিসেম্বর মাসের পর এই বাজারে এক মহাবিপর্যয় নেমে এসেছে; যার ধাক্কা সামাল দিয়ে বাজার স্বাভাবিক হতে অনেক দিন লাগবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক তার টাইট মুদ্রানীতির মাধ্যমে ব্যাংকিং খাত থেকে ব্যক্তি খাতের জন্য অর্থ প্রাপ্তিকে কঠিন করে তুলেছে। সেখানেও চলছে অর্থের সংকট। এ অবস্থায় ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির জন্য কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ কোথা থেকে আসবে অর্থমন্ত্রী তা ভালো করে ব্যাখ্যা করেননি।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.