সামাজিক ব্যবসা অন্তর্ভুক্ত হলো ইইউতেও by শওকত হোসেন

ম্মেলনের শেষ পর্বে ছিল একটি প্যানেল আলোচনা। বিষয় ছিল সামাজিক ব্যবসার জন্য একটি রাজনৈতিক রূপরেখা খুঁজে বের করা। কিছু প্রশ্নের জবাব দিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এর পরই আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মেলন সমাপ্তি ঘোষণার কথা। কিন্তু জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব থমাস স্টেলজার সঞ্চালকের কাছ থেকে এক মিনিট সময় চেয়ে নিয়ে বললেন, ‘আপনারা অধ্যাপক ইউনূসের কথা শুনুন। কারণ, তিনি হচ্ছেন আশাবাদের সবচেয়ে টেকসই উৎস। তিনি সব সময় আশার কথা শোনান, পথ বলে দেন।’

পুরো সম্মেলনের মূল কেন্দ্রে ছিলেন ড. ইউনূস। বারবারই তিনি বললেন মানুষের অসীম ক্ষমতার কথা। বাংলাদেশের গরিব মানুষের কথা উল্লেখ করে তিনি বললেন, তারা বনসাইয়ের মতো। তাদের চাপিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে বেড়ে উঠতে পারছে না। অথচ সবারই সক্ষমতা আছে। প্রয়োজন শুধু সুযোগ করে দেওয়া।
সমাপনী বক্তব্যে ড. ইউনূস আরও বলেন, ‘এমন না যে আমরা সব লন্ডভন্ড করে দিয়ে অন্য গ্রহে চলে যাব। আমরাই এখানে থাকব। সুতরাং এই পৃথিবী ঠিক করার দায়িত্ব আমাদেরই।’
সমাপনী অধিবেশনের আগে নতুন একটি ঘোষণা দেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সামাজিক বিষয় ও অন্তর্ভুক্তকরণ বিষয়ের কমিশনার লাজলো এনডর। তিনি জানান, ইইউ তাদের কার্যক্রমের মধ্যে সামাজিক ব্যবসাকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে ইইউ সামাজিক ব্যবসার উদ্যোগ এবং সামাজিক দায়বদ্ধতাকে গ্রহণ করেছে।
অধ্যাপক ইউনূস ইইউর এই উদ্যোগকে আশার সংবাদ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, এর ফলে ইইউতে আইনানুগভাবে সামাজিক ব্যবসা অন্তর্ভুক্ত হলো। এটি একটি বড় অগ্রগতি।
গতকাল শনিবার ভিয়েনায় শেষ হলো তৃতীয় সামাজিক ব্যবসা সম্মেলন। জার্মানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ক্রিয়েটিভ ল্যাব এর মূল আয়োজক। সম্মেলনে মূল আলোচনা অবশ্য শেষ হয় শুক্রবার রাতেই। সম্মেলনে জানানো হয়, ইইউ ১৮ নভেম্বর ব্রাসেলসে সামাজিক ব্যবসা নিয়ে একটি সম্মেলনের আয়োজন করেছে। এতে মূল বক্তা হবেন অধ্যাপক ইউনূস। উপস্থিত থাকবেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হোসে ম্যানুয়েল বারোসো, ইইউর প্রেসিডেন্ট, গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী ও বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিক।
সম্মেলনে সমাপনী বক্তব্যে ড. ইউনূস আরও জানান, এবার ১০টি নতুন কোম্পানি সামাজিক ব্যবসায় আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া সরকারের প্রতিনিধিরা, বিভিন্ন শহর এবং বিশ্ববিদ্যালয় সামাজিক ব্যবসা নিয়ে কাজ করবে বলে জানিয়েছে। তিনি বলেন, সম্মেলনে অনেক দেশের প্রতিনিধিরা ছিলেন। এখানে শুধু আলোচনাই হয়নি, কীভাবে সামাজিক ব্যবসা নিয়ে সবাই এগিয়ে যাবে, তা নিয়েও অভিজ্ঞতা বিনিময় হয়েছে।
সম্মেলনে পুরোটা সময় ছিলেন মালয়েশিয়ার বর্তমান রাজা টেংকু আবদুর রহমানের বড় ছেলে টেংকু নাকিয়াউদ্দিন। তিনি মালয়েশিয়ার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রো-চ্যান্সেলর। তিনিও মালয়েশিয়ায় সামাজিক ব্যবসা প্রসারের উদ্যোগের কথা জানালেন।
এবারের সম্মেলনে ৮০০-এর বেশি প্রতিনিধি অংশ নেন। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিরা ছাড়াও বিভিন্ন দেশের মন্ত্রীরা ছিলেন। বাহরাইনের মানবাধিকার ও সামাজিক উন্নয়নমন্ত্রী ফাতিমা বালুসি প্যানেল আলোচনায় বাহরাইনসহ আরব বিশ্বে সামাজিক ব্যবসা চালুর ওপর গুরুত্ব দেন। বেসরকারি খাত ও বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) অংশগ্রহণ বাড়ানোর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আরব বিশ্বের বড় সমস্যা হচ্ছে, সবকিছু আসে সরকারের কাছ থেকে। সব সরকার করে দেয়। অথচ দরকার বেসরকারি অংশীদারি। আবার এখানে অন্য সমস্যাও আছে। আরব বিশ্বের বেশির ভাগ এনজিও রাজনৈতিকীকৃত। কিছু উদ্দেশ্যে তারা বাইরে থেকে অর্থ পায়।
প্যানেল আলোচনায় জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব থমাস স্টিলজার বলেন, এখন কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। অথচ প্রয়োজন কর্মসংস্থানের। অনেক শিক্ষিত তরুণের কাজ নেই। তারা সমাজে ভূমিকা রাখতে পারছে না। এতে রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা কমে যাচ্ছে।
ড. ইউনূস বলেন, সরকার সব কাজ করবে না। সরকারের কাজ অনেকটা অর্কেস্ট্রা পরিচালনার মতো। সরকার এটা পরিচালনা করবে। সব বাদ্যযন্ত্র একা বাজাবে না। সবাইকে নিয়ে কাজ করবে। অথচ সরকার অনেক দেশে সেটা করছে না, বরং সরকার বাধা হচ্ছে। সরকার কী করবে, আর কী করবে না ঠিক করতে হবে, যাতে অর্কেস্ট্রা চলে এবং ভালো সংগীতও তৈরি হয়।
সম্মেলন শেষ হয় অধ্যাপক ইউনূসের মেয়ে মনিকা ইউনূসের গানের মধ্য দিয়ে। এ ছাড়া স্থানীয় গ্র্যান্ড হোটেলে রাতে প্রদর্শন করা হয় ইউনূস এবং তাঁর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিয়ে তৈরি করা প্রামাণ্যচিত্র বনসাই পিপল। মার্কিন নির্মাতা হলি মোশার পাঁচ বছর ধরে এটি তৈরি করেছেন। আরেকটি অনুষ্ঠান ছিল সামাজিক ব্যবসার জন্য শিল্পকলা ও সংস্কৃতি বিষয়ে একটি আলোচনা। গতকাল শনিবার অনুষ্ঠিত এই আলোচনায় অংশ নেন ড. ইউনূস ও মনিকা ইউনূস।

No comments

Powered by Blogger.