উন্নয়ন-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা by এ এম এম শওকত আলী

রকারি নীতি-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার কুফল বহুবিধ। অর্থের অপচয় ছাড়াও অন্য সমস্যা হলো, যে উদ্দেশ্যে উন্নয়নমূলক নীতি বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় তা বাস্তবায়নে দেরি হলে জনগণও যথাসময়ে সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। দীর্ঘসূত্রতার জন্য উন্নয়নমূলক প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পায়। এর মধ্যে উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থের সংস্থান থাকলে পরবর্তী পর্যায়ে এই সহযোগীরা পরবর্তী বছর অর্থের জোগান হ্রাস করে। অর্থের সময়মতো ব্যবহারে বাংলাদেশের অক্ষমতা রয়েছে বলে যুক্তি প্রদর্শন করে। দীর্ঘসূত্রতার একটা বড় কারণ হিসেবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ায় লাল ফিতার দৌরাত্ম্যকে প্রধান অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।


এর সঙ্গে যোগ করা হয় আরো কিছু কারণ, যথা_বাস্তবায়নকারী সংস্থার দুর্বলতা বা সংস্থায় কর্মরত ব্যক্তিদের দক্ষতার অভাব। বাস্তবায়নকারী সংস্থা যুক্তি দেখায় যে সময়মতো অর্থ ছাড় করা হয় না, যা অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। এমনটিই শোনা গিয়েছিল সাম্প্রতিককালে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের যুক্তি ছিল, প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ বা ছাড় করা হয়নি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের পাল্টা যুক্তি ছিল, অর্থের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সরকার প্রধানের নির্দেশে আরো অর্থ বরাদ্দ বা ছাড় করা হয়।
বৃষ্টির মৌসুমে রাস্তা মেরামতের কাজ শুরু হয়। কয়েক দিন আগে সংবাদমাধ্যমের মত অনুযায়ী এ অর্থের সঠিক ব্যবহার হয়নি। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের তাড়া ছিল_গত ঈদের আগেই জরাজীর্ণ সব সড়ক সংস্কারের কাজ সম্পন্ন করতে হবে। এর জন্য প্রকাশিত এক সূত্র মতে, কোনো দরপত্র আহ্বান না করেই কিছু ব্যক্তিকে সংস্কারের কাজ দেওয়া হয়। এতে কত অর্থের অপচয় হয়েছে তার হিসাব হয়তো পাওয়া যাবে দুই-তিন বছর পর। অন্যদিকে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত আইন ও বিধিতেও প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করা হয়। কিন্তু তাতে কি কোনো সুফল পাওয়া গেছে?
পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজে দীর্ঘসূত্রতার কথা সবাই জানে। তবে এর প্রধান কারণটি ভিন্ন। একটি বৃহৎ উন্নয়ন সহযোগী অর্থপ্রতিষ্ঠান অর্থ ছাড় করবে না। অভিযোগ পাওয়া গেছে যে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে কাজ দেওয়ার প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতাসহ সততার অভাব ছিল। এখনো বিষয়টি ঝুলে আছে। এরই মধ্যে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে। এখন দেখতে হবে, ভবিষ্যতে কী হয় অর্থাৎ কোন সেতু আগে নির্মাণ হবে। মেট্রোরেল যোগাযোগের বিষয়টিও অনিশ্চিত। কারণ কোন দিক দিয়ে এ সংযোগ যাবে, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। প্রথমে ছিল, পুরনো বিমানবন্দর হয়ে যাবে। নিরাপত্তার কারণে বিমানবাহিনীর আপত্তির জন্য পথ পরিবর্তন করে জাতীয় সংসদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ নিয়ে প্রথমে স্পিকারের আপত্তি ছিল। শেষ পর্যন্ত তা অবসান হলেও এখন নাগরিক সমাজ আপত্তি করছে। ঈদের পর তারা গণ-অনশনের হুমকি দিয়েছে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কী হবে তা এখনো অজানা।
নতুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের স্থান নির্বাচনের বিষয়টি সম্পর্কে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। বিশাল ব্যয়বহুল এ প্রকল্পের প্রয়োজন সম্পর্কে নাগরিক সমাজের প্রবল আপত্তি ছিল। কিন্তু স্থান নির্বাচন একের পর এক বদলানো হয়েছে। অর্থাৎ নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়ে সঠিক পরিকল্পনার অভাব ছিল। এরপর ছিল স্থান নির্বাচনে সঠিক প্রক্রিয়ায় সম্ভাব্যতা জরিপের অভাব। এ কারণেই দেরি হয়েছে। শেষ পর্যন্ত রাজধানী থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে পদ্মার একটি চর সাময়িকভাবে স্থান হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। জানা যায়, পদ্মার বুকে জেগে ওঠা এ চরটির বয়স প্রায় ৫০ বছর। এ চরে কত মানুষ বসবাস করে তার হিসাব কী? কত জমিতে ফসল হয়? এ বিষয়গুলো জনসমক্ষে এখনো প্রকাশ করা হয়নি। নব্বইয়ের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে ঢাকা শহরের আবাসনব্যবস্থা ও যানজট নিরসনের এক জরিপে সুপারিশ ছিল ঢাকা ক্যান্টনমেন্টকে দূরে কোথাও স্থানান্তর করার। তা নিয়ে সেনাবাহিনীর প্রবল আপত্তি ছিল। কত লাখ ব্যক্তি সেনানিবাস স্থানান্তর করলে উপকৃত হবে তা মুখ্য বিষয় নয়। আপত্তিকারীদের তা মনে হয়নি। তারা অন্যত্র যাবে না_এটাই মুখ্য বিষয়। মেট্রোরেল সংযোগের বিষয়েও একই কথা বলা যায়। বৃহত্তর জনস্বার্থের কথা বিমানবাহিনী আমলেই নেয়নি। পথ পরিবর্তনের জন্য ব্যয় বাড়বে। তা পাওয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত নয়।
কৃষি উপকরণ বিতরণের কাজে বিএডিসি ছিল একটি বৃহৎ সরকারি প্রতিষ্ঠান। কাঠামোগতভাবে এ প্রতিষ্ঠানটি ছিল স্বায়ত্তশাষিত। কৃষি খাতে এর অবদান অস্বীকার করা যায় না। আশির দশকের শেষার্ধে বেসরকারি খাতকে শক্তিশালী করার জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের ক্রমাগত চাপে নব্বইয়ের দশকের প্রথমার্ধে কৃষি উপকরণ ক্রয় ও বিতরণ করার দায়িত্ব থেকে এ প্রতিষ্ঠানকে বিরত রাখা হয়। এরপর আসে ইউরিয়া সারের প্রচণ্ড আকাল। কারণ ছিল বহুবিধ। একটি কারণ ছিল সরকারের দূরদর্শিতার অভাব। সঠিকভাবে চিন্তাভাবনা না করেই সরকার উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণচুক্তি-সংক্রান্ত সব শর্তই মেনে নিয়েছিল। অথচ ওই সময়ে অন্তত সরকার গঠিত দুটি কমিটি সার বিতরণের জন্য বিএডিসির মাধ্যমে আপৎকালীন মজুদ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব প্রদানের সুপারিশ করে। সরকার তা সময়মতো বাস্তবায়ন করেনি। একই সময়ে বিএডিসির ভবিষ্যৎ দায়িত্বাবলি কী হবে সে বিষয়েও একটি বৃহৎ উন্নয়ন সহযোগীর অর্থায়নে সমীক্ষা সম্পন্ন করা হয়। এ সমীক্ষার সুপারিশও সরকার সময়মতো বাস্তবায়ন করেনি।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বিএডিসিকে যখন পুনর্গঠন করা হয়, সারের আপৎকালীন মজুদ রক্ষণাবেক্ষণ ও বিতরণের দায়িত্বও তখন বিএডিসিকে দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। কারণ এর আগেই ২০০১-২০০৫ সময়কালে বিসিআইসিকে এ দায়িত্ব অনেকটা জোর করেই দেওয়া হয় সম্ভবত উন্নয়ন সহযোগীদের শর্ত ভঙ্গ না করার জন্য। এরপর ২০০৭ সালে আসে অপরিকল্পিত পদক্ষেপ। টিএসপি ও এমওপি সার বেসরকারি খাতের পাশাপাশি বিএডিসিকেও দেওয়া। যুক্তি ছিল, ওই সময় এসব সারের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য অধিক হওয়ায় বেসরকারি খাত প্রয়োজনমতো আমদানি করবে না। এখনো এ ব্যবস্থা বিদ্যমান, অর্থাৎ স্থায়িত্ব লাভ করেছে। অন্যদিকে সার-সংক্রান্ত বেসরকারি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বিএফএ চাহিদার পুরোই আমদানি করতে প্রস্তুত। পক্ষান্তরে ইউরিয়া সার আমদানির একচেটিয়া দায়িত্ব বিসিআইসির। দুই সরকারি সংস্থাই ঝামেলা এড়ানোর জন্য ২০০৭ সালে রপ্তানিকারক দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ক্রয়চুক্তি করে আসছে। দাম বেসরকারি খাতের তুলনায় অধিকতর। এ প্রক্রিয়াও এখন স্থায়িত্ব লাভ করেছে। কত সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে তার খোঁজ কেউ করে না। তবে ২০০৯ সালে বিএডিসিকে পুনর্গঠন করার জন্য সরকার গঠিত কমিটি সার বিতরণব্যবস্থায় এর ভূমিকা সীমিত করার সুপারিশ করলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। কমিটির হিসাবে দেখা যায়, প্রয়োজনের অধিক আমদানির জন্য জুন ২০১০ পর্যন্ত বিএডিসির ব্যাংক-সংক্রান্ত ঋণ ছিল ১৮০ কোটি টাকা। বিদেশি সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ইউরিয়া আমদানির জন্য কত দেনা_এ খবরও কেউ রাখে না।
ভারতসহ পার্শ্ববর্তী অন্যান্য দেশকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে সব সময়ই বহুমুখী বিতর্ক হয়। এর ভালো ও মন্দ দিকগুলোও চিহ্নিত হয়। শেষ পর্যন্ত পরীক্ষামূলকভাবে ট্রানজিট সুবিধাও ভারতকে দেওয়া হয়। এখন সরকার গঠিত একটি কমিটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর যে সংবাদ দিয়েছে, এর ফলে ট্রানজিটে ৪৭ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রয়োজন। অক্টোবরের ৬ তারিখে একটি বাংলা দৈনিকে এ সংবাদ প্রকাশিত হয়। এতে আরো বলা হয়েছে, ঋণ নিয়ে এ বিনিয়োগ হবে ঝুঁকিপূর্ণ। অপরিকল্পিত ট্রানজিট চুক্তির উদ্যোগ বহু উদাহরণের মধ্যে একটি। তবে এখানে দীর্ঘসূত্রতার বিষয়টি প্রাসঙ্গিক নয়। সঠিক পরিকল্পনার অভাবই এ দুঃসংবাদের মূল কারণ। সঠিক পরিকল্পনার জন্য সময়ের প্রয়োজন ছিল। সে সময় না নিয়ে তড়িঘড়ি করে পরীক্ষামূলক ট্রানজিট সুবিধাদি চালু হয়েছে। অবশ্য এ যুক্তি দেখানো সম্ভব যে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা পরিকল্পনারই অংশবিশেষ। সর্বোপরি সরকার অন্তত একটি কমিটি গঠন করেছে। কমিটি তার মতামতও দিয়েছে। এ মতামতে বিশাল এ বিনিয়োগের জন্য ঝুঁকি কিভাবে সরকার এড়াবে_সেটাই হবে দেখার বিষয়।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.