জাপানে জমকালো নৃত্যানুষ্ঠান by হানিফ খন্দকার

নৃত্যগুরু সাজু আহমেদ বাংলাদেশ থেকে ১৫ সদস্যের দল নিয়ে জাপানে যাবেন সিক্সথ এশিয়ান কাগুসিমা ইয়ুথ আর্ট কালাচারাল ফেস্টিভ্যালে অংশ নিতে। সহকারী নৃত্য পরিচালক হিসেবে আমিও সঙ্গী হলাম সেই দলের। ১১ অক্টোবর রাত ১১টায় একে একে দলের সব সদস্য পেঁৗছলেন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। প্রথমবারের মতো জাপান যাওয়ার আনন্দে আমি তখন বিভোর। তবে টেনশনও যে লাগছিল না, তাও নয়। দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করছি, তাই পারফরম্যান্সটা যাতে সবচেয়ে ভালো হয় তা নিয়েও ছিল চিন্তা।


দলের লিডার খান মুহাম্মদ সালেক ভাই বিমানবন্দরে এসে পেঁৗছার পর সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ইমিগ্রেশন নিয়ে। ইমিগ্রেশন শেষে সবাই বিমানে উঠলাম। ক্যাথে প্যাসিফিকের সুবিশাল ফ্লাইটে আমার সিটটি ছিল জানালার পাশে। রাত তখন পৌনে ১টা। বিমান উড্ডয়নের কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবার দিয়ে গেলেন বিমানবালা। খাবার সারতেই দাদা (সাজু আহমেদ) সবাইকে ঘুম যেতে বললেন। দাদাকে আমরা সবাই খুব ভয় পাই, তাই ওনার নির্দেশ অমান্য করার সাহস কারও ছিল না।
ঘুম থেকে উঠে দেখি সকাল হয়ে গেছে। আমাদের বিমান হংকং এয়ারপোর্টের খুব কাছাকাছি। জানালা দিয়ে চোখ রাখতেই দেখি, চারদিকে পাহাড় আর পাহাড়। সেই পাহাড়ের মাঝে নদী দিয়ে চলছে জাহাজ। ভয় লাগল, এ বুঝি পানিতে ডুবে গেল বিমান।
নদী ঘেঁষে আমাদের বিমান ল্যান্ড করল হংকং এয়ারপোর্টে। আমাদের নামতে হবে; কারণ এখানে আমাদের তিন ঘণ্টার ট্রানজিট আছে। সবাই নেমে ইমিগ্রেশন পার হলাম। এরপর ঘুরে দেখলাম হংকং এয়ারপোর্ট। এ বিমানবন্দরের নিয়ম-শৃঙ্খলা আমাদের অভিভূত করল।
পরবর্তী বিমানে ওঠার জন্য আমাদের যেতে হবে ২৮ নম্বর গেটে। সেখানে যেতে আমাদের চড়তে হলো স্পিড ট্রেনে। ট্রেন থেকে নেমে একটি নির্দেশনা দেখে অবাক হলাম_ এখানে ৫২৮ নম্বর গেটও আছে!
জাপানের উদ্দেশে যাওয়ার জন্য প্লেনে উঠলাম। তবে এবারের প্লেনটি আগের চেয়ে একটু ছোট। আমাদের গন্তব্য জাপানের ফুকোওকা বিমানবন্দর। এ বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন কর্মীদের ব্যবহারে মুগ্ধ হলাম। ইমিগ্রেশন পার হয়ে যখন বের হলাম তখন জাপানের স্থানীয় সময় বিকাল ৫টা। ইমিগ্রেশন পার হতেই দেখলাম, আমাদের অপেক্ষায় রয়েছেন ইকবাল ভাই। ইকবাল ভাই জাপানের কাগুসিমার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তার মাধ্যমেই সিক্সথ কাগুসিমা ইয়ুথ আর্ট ফেস্টিভ্যালে অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছে বাংলাদেশ।
বিমানবন্দর থেকে গাড়িতে করে আমরা রওনা হলাম কাগুসিমার উদ্দেশে। গাড়িতে আগে থেকেই আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন ইকবাল ভাই। গাড়ি চলতে লাগল, আর আমাদের খাবার খাওয়ার মাঝে ইকবাল ভাই বলে যাচ্ছিলেন আমরা কোন শহর ও কোন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। ব্যস্ত সড়ক কিন্তু কোথাও কোনো কোলাহল নেই। চারদিকে নিরিবিলি, মনোরম পরিবেশ আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলেছিল। হঠাৎ চোখে পড়ল বিশাল টানেল। টানেল হলো পাহাড়ের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তা। টানেলটি প্রায় তিন-চার কিলোমিটার লম্বা।
টানা ছয় ঘণ্টা গাড়ি চলার পর পেঁৗছলাম আমাদের জন্য নির্ধারিত হোটেল 'বিআরএমবি'তে। পাঁচতারা সেই হোটেলের করিডোরটাও বিশাল। আমাদের দলের সব সদস্যের জন্যই এখানে বরাদ্দ রয়েছে আলাদা আলাদা কক্ষ। সাজানো-গোছানো সেই রুমে গা এলিয়ে দিতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু এর মধ্যেই দাদার ডাক এলো_ প্র্যাকটিস শুরু হবে। প্র্যাকটিস শেষে ক্লান্ত দেহে সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালে নাশতা সেরে সকাল ৭টায় সবাই উঠে পড়লাম গাড়িতে। আয়োজকরা আমাদের নিয়ে যাবেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জাদুঘর পরিদর্শনে। গাড়িতে আমাদের সঙ্গে দেওয়া হলো চারজন গাইড। যথারীতি গাড়ি চলছে আর ইকবাল ভাই বর্ণনা দিচ্ছেন আমাদের চারপাশের। একটি জিনিস আমাকে খুবই অবাক করল_ এত ব্যস্ত সড়ক পেরিয়ে আমরা যাচ্ছি, কিন্তু কখনোই কোনো গাড়ি থেকে হর্নের শব্দ শুনলাম না।
ঘণ্টাখানেকের জার্নি শেষে আমরা বাস থেকে নামলাম। এরপর হেঁটে যেতে থাকলাম জাদুঘরের উদ্দেশে। এখানকার পরিবেশ এতটাই সুন্দর যে সবাই ক্যামেরা বের করে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ছবি তুলতে। ইকবাল ভাই আমাদের একটি রুমে নিয়ে বললেন_ 'দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সুইসাইড স্কোয়াডের বিমানচালকরা এখানে থাকতেন।' রুমটিতে কাঠের একটি খাটে রয়েছে ২০টি বিছানা। সব বিছানায় রয়েছে আলাদা আলাদা চাদর ও বালিশ। ঘরটি দেখতে গ্রামের দোচালা টিনের ঘরের মতো। মাটির সঙ্গে একেবারে লেভেলে রয়েছে চাল। আর মাটি থেকে অন্তত তিন ফুট গভীরে রয়েছে মূল ঘর। ইকবাল ভাই জানালেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যেসব জাপানি সৈনিক আত্মঘাতী বিমান হামলা চালিয়েছিলেন তাদের প্রত্যেকের বয়স ছিল ১৫ থেকে ১৮ বছর। এরপর গাইডরা আমাদের ঘুরে ঘুরে দেখালেন যুদ্ধের বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও ফুটেজ।
কিছুক্ষণ পর আমাদের সবাইকে এক জায়গায় বসতে বলা হলো। এরপর আমাদের সামনে এলেন এক বৃদ্ধ, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি আমাদের সামনে কিছু ছবি তুলে ধরলেন এবং যুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা দিতে থাকলেন। এর মধ্যে একটি ঘটনা ছিল এমন_ 'দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এক কিশোর বিমান নিয়ে আত্মঘাতী হামলার জন্য যাবে। সে ছিল তার মায়ের প্রথম সন্তান। আত্মঘাতী বিমান হামলা চালানোর আগমুহূর্তে কিশোরটি মায়ের কাছে একটি চিঠি লিখল_ 'মা, আজ থেকে ভুলে যাও আমি তোমার প্রথম সন্তান। আজ থেকে এ দেশ তোমার প্রথম সন্তান; যে দেশের জন্য আজ আমি আমার জীবন দিতে যাচ্ছি। তোমার জন্য নিরাপদ একটি বাসস্থান রাখতেই আমি যুদ্ধে যাচ্ছি। আমার জন্য আশীর্বাদ করো। তোমার সঙ্গে স্বর্গে আমার দেখা হবে...।'
আবেগভরা এমন অসংখ্য চিঠি রয়েছে জাদুঘরে। বিনা পয়সায় এগুলো পড়ে শোনান সেখানে থাকা কয়েকজন বৃদ্ধ। যারা নিজ চোখে দেখেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বৃদ্ধদের অশ্রুভেজা চোখে পড়ে শোনানো এসব চিঠির কথা শুনে জাদুঘরে এমন কোনো পর্যটক খুঁজে পাওয়া গেল না যার চোখ থেকে জল ঝরছিল না।
আমাদের সঙ্গে থাকা গাইড জানালেন, জাপান হচ্ছে মাতৃপ্রধান দেশ। এখানে অনেক নারী রয়েছেন যারা বিবাহ ছাড়াই সন্তান জন্ম দিয়েছেন। তাই জাপানিরা মাকে বড় করে দেখেন।
জাদুঘর থেকে বের হয়ে আমরা রওনা হলাম সামুরাই বাড়ি পরিদর্শনে। যেতে যেতে গাইড বললেন, 'আগেকার দিনে সামুরাই পরিবারের সবাই সব সময় ঝগড়া-মারামারিতে লিপ্ত ছিল। এখন আর সেই চিত্র নেই।' সামুরাই পরিবারের বাড়িগুলো দেখলে মনে হবে এটি যেন পার্ক। এগুলো ঘুরে দেখে আমরা রওনা হলাম হোটেলের উদ্দেশে।
পরদিন অনুষ্ঠান, তাই হোটেলে ফিরেই আমরা যোগ দিলাম রিহার্সেলে। যে জন্য জাপান আসা সেই অনুষ্ঠানটিই যদি সফলভাবে সম্পন্ন করতে না পারি তাহলে তো সবকিছুই বৃথা!
সকালে নাশতা সেরে ৯টার দিকে আমরা গাড়িতে উঠলাম সিটি হলের উদ্দেশে। সেখানে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন স্বয়ং কাগুসিমার মেয়র হিগো ইকো মোরি। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পর মেয়র প্রতিটি দেশকে সম্মানসূচক ক্রেস্ট প্রদান করলেন। এরপর শুরু হলো নৃত্যানুষ্ঠান। আমাদের পালা ছিল ৭ নম্বরে।
দেশের সম্মান জড়িত থাকায় আমরা সবাই সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি ভালো নাচ উপহার দেওয়ার। এর পরও টেনশনে ছিলাম বিভিন্ন দেশ থেকে আসা শিল্পীদের আমাদের নাচ কেমন লেগেছে তা নিয়ে। তবে আমাদের সেই টেনশনটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। অনুষ্ঠান শেষেই কাগুসিমার মেয়র আমাদের কাছে এসে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, বাংলাদেশের পারফরম্যান্স ওনার খুবই ভালো লেগেছে। এ জন্য তিনি বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানালেন আমাদের গুরু সাজু আহমেদকে। একই সঙ্গে তিনি গুরুকে অনুরোধ জানালেন দল নিয়ে আবার জাপান আসার।
অনুষ্ঠান শেষে আমরা প্রতিটি দেশের শিল্পীদের সঙ্গে মিলে ফটোসেশন করলাম। এরপর একে অন্যের সঙ্গে আলাপচারিতায় মেতে উঠলাম। সংস্কৃতির এ ভাব বিনিময়ের অংশটুকু দারুণভাবে উপভোগ করলাম আমরা। পরদিন আমাদের প্রোগ্রাম ছিল একটি স্কুলে। 'ক্ষিরে' নামের সেই স্কুলের অবস্থান জাপানের জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি সাকুরাপিমার পাদদেশে। সকাল ১০টায় আমরা ক্ষিরেতে পেঁৗছালাম। স্কুলের সাংস্কৃতিক দল সাকুরাজিমা আগ্নেয়গিরির ইতিহাসকে কেন্দ্র করে প্রদর্শন করল নানা ডিসপ্লে। আমরা আমাদের দেশের ঐতিহ্য তুলে ধরা নৃত্য প্রদর্শন করলাম। মূলত দু'দেশের সংস্কৃতি বিনিময় করার লক্ষ্যেই এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। অনুষ্ঠান শেষে আমরা পুরো স্কুল ঘুরে দেখলাম। স্কুলের ছাত্র, শিক্ষক থেকে শুরু করে কর্মচারী সবাই খুব শৃঙ্খলাবদ্ধ। শিক্ষার্থীরা সে গরিব হোক আর ধনী, নিজেদের কাজ সবাই নিজেরাই করে। স্কুলের অধ্যক্ষ জানালেন, স্কুলে সর্বাগ্রে তারা গুরুত্ব দেন ভদ্রতাকে। ভদ্রতা শেখানোর পরই পড়ালেখা।
ঘোরা হলো, অনুষ্ঠানও শেষ হলো এবার বিদায় নেওয়ার পালা। আমরা সব দেশের শিল্পীরা একত্রিত হলাম বিদায় অনুষ্ঠানে। বিশাল হলে সবাই একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করলাম। এক দেশের শিল্পীরা অন্য দেশের শিল্পীদের দিলেন নিজ নিজ দেশ থেকে আনা উপহার সামগ্রী। সবশেষে কাগুসিমার মেয়র বিদায়ী ভাষণে আহ্বান জানালেন_ আসুন এশিয়ার সব দেশ একত্রিত হয়ে কাজ করি। গড়ে তুলি সুন্দর এক পৃথিবী।
কিছুদিন আগে চীন সরকারের আমন্ত্রণে বাংলাদেশের যে নৃত্যশিল্পী দল চীন গিয়েছিল সেই দলে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। লুইআং ইন্টারন্যাশনাল কালচারাল ফেস্টিভ্যালের সেই অনুষ্ঠানে গিয়ে চীনের সংস্কৃতি ও পরিবেশ আমায় মুগ্ধ করেছে। কিন্তু এর পরও সবকিছু থেকে আমি ওপরে রাখব জাপানকে। পৃথিবীতে একটি জাতি কতটা ভদ্র এবং কতটা শৃঙ্খলাপরায়ণ হতে পারে এর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত এ দেশটি। এ সফরে জাপানের পথঘাটের কোথাও কাউকে উচ্চস্বরে কথা বলতে দেখিনি। দেখিনি কাউকে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হতে। এখানকার শান্ত পরিবেশ যেন মানুষগুলোকে করে রেখেছে শান্ত।

No comments

Powered by Blogger.