আইনে আছে, প্রয়োগ নেই-'মার্কেট মেকার' হতে পারে শেয়ারবাজারের রক্ষাকবচ by তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

স্টকব্রোকার, বিনিয়োগকারী, অর্থায়নকারী ছাড়াও বিশ্বের বড় বড় শেয়ারবাজারে সেবাদানকারী বিশেষ ধরনের ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। নিউ ইয়র্ক স্টক এঙ্চেঞ্জে এদের বলা হয় স্পেশালিস্ট আর নাসডাকে এরা 'মার্কেট মেকার' হিসেবে পরিচিত। এদের কাজ হলো বাজারে অর্থের প্রবাহ বাড়ানো, যৌক্তিক দামে শেয়ারের মানসম্মত ও প্রতিযোগিতামূলক লেনদেনের মাধ্যমে বাজার স্থিতিশীল রাখা। বাংলাদেশের সিকিউরিটিজ আইনেও 'মার্কেট মেকারের' কথা উল্লেখ রয়েছে। তবে এদের তৈরি করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি কখনো। শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মার্কেট মেকাররা হতে পারত অস্থিতিশীল এ বাজারের জন্য রক্ষাকবচ।


তারা সক্রিয় থাকলে বাজারের ওঠা-নামার একটা সহনীয় মাত্রা থাকত। বাছাই করা ভালো মৌলভিত্তির কয়েকটি কম্পানির শেয়ার লেনদেন করে বড় ধরনের দরপতন ঠেকানো যেত। অনাস্থা ও আতঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারতেন বিনিয়োগকারীরা। ক্রমেই স্বাভাবিক হয়ে আসত বাজার।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের একটি প্রতিনিধিদল সম্প্রতি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশন (এসইসি)র চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করে 'মার্কেট মেকার'দের মাধ্যমে বাজার স্থিতিশীল করার বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছে। বাজার থেকে অন্তত ভালো ৬০টি কম্পানির শেয়ার লেনদেনের মাধ্যমে দর ধরে রাখার প্রস্তাব দেয় প্রতিনিধিদল। এই ৬০টি কম্পানির শেয়ারের দর ধরে রাখা হলে প্রতিদিন ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের সূচক ১০ থেকে ২০ পয়েন্টের মধ্যে ওঠা-নামা করত। তাতে কোনো দিন ২৩১ পয়েন্ট পতন বা ১৭০ পয়েন্ট উত্থানের ঘটনা ঘটত না। তবে বিষয়টি বেশিদূর এগোয়নি বলে অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কম্পানিজের (বিএপিএলসি) সভাপতি সালমান এফ রহমানের পরিচালকদের পক্ষ থেকে কম্পানির শেয়ার কিনে দরপতন ঠেকানোর উদ্যোগের কথা বলেছিলেন। ডিএসইর পক্ষ থেকে ওই প্রস্তাব সেপ্টেম্বর মাসেই পাঠানো হয় এসইসিতে। এ উদ্যোগের ব্যাপারেও এখনো এসইসির পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
'সিকিউরিটিজ ও এঙ্চেঞ্জ কমিশন (বাজার সৃষ্টিকারী) বিধিমালা ২০০০' নামে অভিহিত এই আইনে বাজার সৃষ্টিকারীর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে_'কোনো অনুমোদিত সিকিউরিটির তারল্য ও উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিতির লক্ষ্যে উহার ক্রয় বিক্রয় নিমিত্ত উহার গভীরতাসহ ক্রমাগত উভয় দর উল্লেখ্য করা।' এই আইনের আওতায় কোনো মার্চেন্ট ব্যাংক, তফসিলি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান, স্টক ডিলার বা স্টক ব্রোকার এসইসি থেকে সনদ পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হবে। এসইসির নিবন্ধনপ্রাপ্ত বাজার সৃষ্টিকারীরা সর্বোচ্চ সততা, বিশ্বস্ততা, দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে বাজার সৃষ্টিকারীরা কাজকর্ম পরিচালনা করবে। প্রতিটি মার্কেট মেকারকে এক বছরের জন্য সনদ দেওয়া হবে। সব ধরনের হিসাব ১০ বছরের জন্য সংরক্ষণ করতে হবে তাদের। 'অনুমোদিত বাজার সৃষ্টিকারী সিকিউরিটির বা শেয়ারের তারল্য ও উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিতকরণের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিবে। এবং বাজারের আচরণের প্রেক্ষিতে উহার ভূমিকা নির্ধারল করিবে' বলে এসইসির আইনে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই বিধিমালায় আরো বলা আছে, 'ক্রয়াদেশ মূল্য এবং বিক্রয় প্রস্তাব মূল্য সনি্নহিত সময়ে একই হইতে পারবে না'।
এসইসির আইনে আরো বলা হয়েছে, 'শুধুমাত্র স্টক এঙ্চেঞ্জে তালিকাভুক্ত কম্পানির সিকিউরিটিজের লেনদেন করতে পারবে মার্কেট মেকাররা। প্রতিটি লেনদেনের তথ্য ট্রেডিং মনিটরে অন্তত তিরিশ মিনিট প্রচার করতে হবে।' বাজার সৃষ্টিকারীর মূলধনের পরিমাণ কমিশনের জারি করা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে। এই মূলধনের ওপর নির্ভর করবে কয়টা সিকিউরিটি বা শেয়ার লেনদেন করতে পারবে। এ ছাড়া একটি শেয়ারের জন্য কয়টা মার্কেট মেকার থাকবে, সেটাও নিধারণ করবে এসইসি।
নিউ ইয়র্ক স্টক এঙ্চেঞ্জে সাতটি স্পেশালিস্ট ও নাসডাকে প্রায় ৩০০ মার্কেট মেকার রয়েছে। তারা একই ধরনের ভূমিকা পালন করে থাকে। এরা প্রতিদিন সকালে ওপেনিং প্রাইস ঠিক করে, যা আগের দিনের ক্লোজিং প্রাইসের চেয়ে ভিন্ন হতে পারে। চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে শেয়ারের যৌক্তিক দাম ঠিক করে দেয়। ব্যবস্থাটাই এমন যে দিনের সবচেয়ে ভালো দর উল্লেখ করলেই কেবল শেয়ার বিক্রি করা সম্ভব। এতে বিনিয়োগকারীদের ঠকার আশঙ্কা থাকে না। একটি সিকিউরিটিজের জন্য নাসডাকে ১৪টি মার্কেট মেকারের অনুমোদন রয়েছে। ফলে দেখেশুনে শেয়ার কেনাবেচার সুযোগ পান বিনিয়োগকারীরা। বাজার বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস, এসইসির আইনের বিধিবিধান মেনে বাংলাদেশেও মার্কেট মেকার কার্যক্রম পরিচালিত হলে বাজার ক্রমে স্থিতিশীল হবে।
এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায় সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, মার্কেট মেকার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রয়েছে। এরা বাজার স্থিতিশীল করতে ভূমিকা রেখে থাকে। এসইসির নিয়ন্ত্রণে থেকে এ দেশেও মার্কেট মেকাররা বাজার স্থিতিশীল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। মার্কেট মেকাররা বাজার স্থিতিশীল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন এসইসির আরেক সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকীও। তিনি জানান, কমিশন আইনে মার্কেট মেকারের বিষয়টি রয়েছে। তবে তার প্রয়োগ হয়নি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মার্কেট মেকার রয়েছে। এ দেশেও সেটা সম্ভব। তবে সেটা সময়সাপেক্ষ ও বেশ কঠিন।
এসইসির মুখপাত্রের দায়িত্ব পালনকারী নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শেয়ারবাজারের দুঃসময়ে মার্কেট মেকাররা বাজারকে ধরে রাখে। এসইসির আইনেও মার্কেট মেকার রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত মার্কেট মেকার হওয়ার জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান আবেদন করেনি। তিনি বলেন, এসইসির বিদ্যমান আইনটি যুগোপযোগী করারও প্রয়োজন রয়েছে।
বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য মার্কেট মেকারের গুরুত্বের কথা স্বীকার করলেও ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের সভাপতি শাকিল রিজভী মনে করেন বিষয়টি নিয়ে আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার। চট্টগ্রাম স্টক এঙ্চেঞ্জের সভাপতি ফখরুদ্দিন আলী আহমেদ বলেন, সংশ্লিষ্ট আইনকানুন যদি আরো সুনির্দিষ্ট ও সুনিয়ন্ত্রিত না হয়, তবে বাংলাদেশের জন্য মার্কেট মেকাররা বিপদও ডেকে আনতে পারে।
এ প্রসঙ্গে জনতা ক্যাপিটাল অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর মিয়া বলেন, চলমান মন্দা পরিস্থিতিতে শেয়ারবাজার স্থিতিশীল রাখতে মার্কেট মেকার গুরুত্ব ভূমিকা রাখবে। ফিনিঙ্ সিকিউরিটিজ হাউসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কাদের চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, বাজার স্থিতিশীল রাখতে মার্কেট মেকাররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে; কিন্তু বাংলাদেশে এ ধারা তৈরি হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.