স্ত্রী-সন্তান খুন নেপথ্যে পরকীয়া by রুদ্র মিজান

নিজ বান্ধবীর সঙ্গেই গড়ে উঠেছিল স্বামীর পরকীয়া। বিষয়টি জানার পর থেকেই অশান্তি দেখা দেয় আইরিন আক্তার আরজুর সংসারে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই শিশুসন্তান সাবিদ ও স্ত্রী আরজুুকে শ্বাসরোধ করে ব্যাংক কর্মকর্তা আমান উল্লাহ আমান হত্যা করেছে বলে স্বজনদের অভিযোগ। এ ঘটনায় আমান ও তার প্রেমিকা সানজিদা ইয়াসমিন সুবর্ণাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ দু’জনকে আসামি করে গতকাল মিরপুর মডেল থানায় মামলা করেছেন আরজুর চাচা ইউনুছ হাওলাদার।

সূত্র জানায়, হত্যাকাণ্ডের কয়েক দিন আগ থেকে প্রায় প্রতিদিনই আমান ও আরজুর মধ্যে বাগ্‌বিতণ্ডা হতো। গত ৩১শে অক্টোবর সুবর্ণার সঙ্গে দেখা করে আমান। ওই দিন জুমার পর সুবর্ণার বাসায় যায় সে। এসময় আমানের সঙ্গে ছিল ৭ বছর বয়সী তার পুত্র সাবিদ। বাসায় ফিরে বিকাল প্রায় ৫টায়। সন্দেহ হয় আরজুর। কৌশলে সাবিদকে জিজ্ঞাসা করলে সে জানায়, তার বাবা তাকে নিয়ে এক আন্টির বাসায় গিয়েছিল। আন্টি তাকে অনেক আদর করেছে। সাবিদের কাছ থেকে বর্ণনা শুনে আরজু নিশ্চিত হন তার বান্ধবী সুবর্ণার বাসায় গিয়েছিল আমান। এরপরেই স্বামী আমানের সঙ্গে বাগবিতণ্ডা শুরু হয়। তুমুল ঝগড়ার একপর্যায়ে আরজুকে মারধর করে আমান। বিষয়টি ওইদিনই পঞ্চগড়ে তার ছোটভাই অপু রহমানকে ফোনে জানান আরজুু। অপু জানান, আরজু ফোনে কথা বলতে বলতে তখন কান্নাকাটি করেছিলেন। ঝগড়া করতে বারণ করে তার বড় বোন আরজুকে তখন তিনি জানিয়েছিলেন, ঢাকায় এসে আমানের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলবেন। কিন্তু কথা বলার আর সুযোগ পাননি অপু। তার আগেই গত বুধবার সন্ধ্যায় হত্যা করা হয়েছে আরজু ও সাবিদকে।
স্বজনরা জানান, পাঁচ বছর যাবত স্ত্রী ও দু’সন্তানকে নিয়ে মিরপুরের মধ্য পাইকপাড়ার ৬৭/এ বাড়ির পাঁচ তলার একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতো আমান। গতকাল ওই বাড়িতে গিয়ে তাদের ফ্ল্যাটটি তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা সুলতান মুন্সী জানান, বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার পর বাসার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমান চিৎকার করে বলতে থাকে, আমার বউ-বাচ্চার কি হইছে দেখেন। ওরা বিছানায় এভাবে পড়ে আছে কেন? দ্রুত সুলতান ও তার স্ত্রী আলেয়া বেগম এবং পুত্র বধূ জোছনা আক্তার রিয়া গিয়ে দেখেন বাসার বাইরে থেকে সিটকিনি লাগানো। তারা শোবার ঘরে ঢুকে আঁতকে উঠেন। দেখেন, আইরিন ও সাবিদ পাশাপাশি নিথর অবস্থায় পড়ে আছে। পাশে এক বছরের শিশুপুত্র তানভীর কাঁদছে। সাবিদের শরীরে হাত দিয়ে রিয়া অনুভব করেন সে জীবিত। তাৎক্ষণিকভাবে তাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যায় আমান। এর মধ্যেই বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী আবুল কাশেম ও প্রতিবেশীরা আইরিন আক্তার আরজুকে ডেল্টা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। খবর পেয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল থেকে আমানকে আটক করে পুলিশ। তার আগে তারা ঘটনাস্থলে যায়। আমানের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতেই সুবর্ণাকে গতকাল তার অফিস স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের বায়িং হাউজ মিরপুর থেকে আটক করা হয়েছে।
আমান-আরজু দম্পতির প্রতিবেশী গৃহবধূ জোছনা আক্তার রিয়া জানান, আমান-আরজু দম্পতিকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে তারা অসুখী ছিলেন। আমান ও আরজুু দু’জনেই ছিলেন বেশ নম্র ও ভদ্র। সবাই তাদের সুখী দম্পতি হিসেবেই জানতো। প্রায় ছয় মাস আগে আরজুর কথা শুনে চমকে উঠেন রিয়া। আরজু তাকে বলেছিল, আমান আমাকে মেরেই ফেলবে। দু’সন্তানের মুখ চেয়ে আমি তার সংসার করছি। সে আমার এক বান্ধবীর সঙ্গে প্রেম করছে। বিষয়টি জানার পর থেকেই আমার সঙ্গে তার খারাপ সম্পর্ক যাচ্ছে। আরজু নিজের জীবননাশের আশঙ্কা প্রকাশ করে তখন বলেছিলেন, আপা আপনাদের জানিয়ে রাখলাম। যদি কখনও কিছু ঘটে আপনারা অন্তত সবাইকে এগুলো বলতে পারবেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রেম করেই আরজুকে বিয়ে করেছিল আমান। প্রায় চৌদ্দ বছর আগে ইডেন মহিলা কলেজে সমাজ-বিজ্ঞানে মাস্টার্স করেন আইরিন আক্তার আরজু। ওই সময়ে তিনি আজিমপুরে থাকতেন। চুটিয়ে প্রেম করতেন আমানের সঙ্গে। তখন তার রুমমেট ছিল এক বছরের জুনিয়র সুবর্ণা। রুমমেট হিসেবেই বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠে তাদের। আরজুর মাধ্যমেই সুর্বণার সঙ্গে পরিচয় হয় আমানের। ওই সময় থেকেই আমানের প্রতি দুর্বল ছিলেন সুবর্ণা। বিষয়টি অনুভব করেছিলেন আইরিন আক্তার আরজু। পরে অবশ্য আমানের সঙ্গে দেখা করার সময় সুর্বণাকে সঙ্গে নিতেন না। ২০০৪ সালের পর নিজের সিদ্ধান্তেই পূবালী ব্যাংকের এলিফ্যান্ট রোড শাখার কর্মকর্তা আমানকে বিয়ে করেন আইরিন আক্তার আরজু। এদিকে, সবুর্ণারও বিয়ে হয়ে যায়। তার স্বামী থাকেন প্রবাসে। দেবরের পরিবারের সঙ্গে মাকে নিয়ে মিরপুরের ২৫/৪ বড়বাগে থাকেন তিনি। প্রায় দু’বছর আগে হঠাৎ সুবর্ণার সঙ্গে রাস্তায় দেখা হয় আমানের। ওইদিন দু’জনের মধ্যে দীর্ঘসময় কথা হয়। পরে ঋণ উত্তোলনের জন্য পূবালী ব্যাংকের ওই শাখায় যান সুবর্ণা। এভাবেই আমান-সুবর্ণার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। আমান-আরজুর প্রতিবেশী রিয়া জানান, সুবর্ণাকে তিনি কখনও দেখেননি। তবে দু’বার আমান-আরজুর ওই বাসায় যান সুবর্ণা। তখন সুবর্ণাই আরজুকে জানিয়েছিল ব্যাংক থেকে ঋণ উত্তোলনের বিষয়। ওই সময়ে সুবর্ণা তার বিয়ে হয়েছে বলেও আরজুকে জানিয়েছিলেন। সুবর্ণা বাসায় যাওয়ার পর থেকেই আরজুর সন্দেহ হয়। ওই সময় থেকেই আমানের আচার-আচরণে পরিবর্তন লক্ষ করেন আরজু। আরজু প্রতিবেশী রিয়াকে জানিয়েছিলেন, প্রায়ই গভীর রাতে অন্য রুম থেকে মোবাইলফোনে সুবর্ণার সঙ্গে কথা বলতো আমান। প্রায় দেড় বছর আগে বিষয়টি জানতে পারেন আরজু। সেই থেকে দু’জনের মধ্যে কলহ লেগেই থাকতো। এ পরকীয়ার কারণেই আরজু ও শিশুসন্তান সাবিদকে জীবন দিতে হয়েছে বলে তাদের স্বজনরা অভিযোগ করেছেন। আরজুর চাচা ইউনুছ হাওলাদার অভিযোগ করেন, ‘ঝগড়া, মারধরের একপর্যায়ে আরজুকে গলাটিপে হত্যা করেছে আমান। এ হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করার কারণেই শিশু সাবিদকে একই কায়দায় হত্যা করা হয়েছে। ঘটনার পর আমান মোবাইল ফোনে তাকে জানান, আরজু ও সাবিদ অসুস্থ। পরকীয়ার বিষয়টি তারা জানতেন দাবি করে তিনি বলেন, ‘এ নিয়ে ঘরোয়াভাবে সালিশ-বৈঠক হয়েছে।’ এদিকে, গতকাল পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের বিষয় স্বীকার করেনি আমান। তিনি জানান, যখন এ ঘটনা ঘটেছে সে তখন বাসায় ছিল না। সে বাসায় এসেছে সন্ধ্যার পর।  কিন্তু তার এ বক্তব্যের সত্যতা পায়নি পুলিশ। বাড়ির নিরাপত্তকর্মী আবুল কাশেম জানান, ঘটনার দিন বিকাল প্রায় সাড়ে ৫টায় বাসায় ঢুকে আমান। এর প্রায় এক ঘণ্টা পরে সে চিৎকার করলে তার স্ত্রী, সন্তানকে নিস্তেজ অবস্থায় পাওয়া যায়। গতকাল মিরপুর মডেল থানায় আটক সুবর্ণা নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, এ ঘটনায় তাকে অযথা জড়ানো হয়েছে। আমানের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল না বলে তিনি দাবি করেন। মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকতা (ওসি) সালাহ উদ্দিন জানান, আমান অসংলগ্ন কথা বলছেন। তিনি স্ত্রী, সন্তানের নিথর দেহ দেখে চিৎকার করেছেন। অথচ বাইরে দরজা বন্ধ ছিল। আমানই তার স্ত্রী-সন্তানকে হত্যা করেছেন বলে প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ প্রমাণ পেয়েছে। পরকীয়ার কারণে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এ বিষয়ে তদন্ত অব্যাহত আছে বলে জানান তিনি।
নিহত আইরিন আক্তার আরজু পঞ্চগড় জেলা সদরের ঢাকাইয়া পট্টির মৃত আবদুর রহমানের কন্যা। প্রায় ১০ বছর আগে গাজীপুরের কালিগঞ্জের সোনাপাড়ার মৃত আবদুস সোবহানের পুত্র আমান উল্লাহ আমানের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তাদের দু’পুত্র সন্তানের মধ্যে ৭ বছর বয়সী সাবিদকে তার মায়ের সঙ্গে হত্যা করা হয়েছে। অপর সন্তান এক বছর বয়সী তানভীর। এ ঘটনায় আটক সানজিদা ইয়াসমিন সুবর্ণা গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জের গোয়ালিয়ার এ কে এম সিদ্দিকুল ইসলাম বুজরুকের কন্যা। গতকাল নিহত মা ও শিশুসন্তানের লাশ ময়নাতদন্ত শেষে আইরিন আক্তার আরজুর স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.