১৩ বছরে ১২ বার নাম বদলেও ধরা হুজির আবু বক্কর

ঢাকার কেরানীগঞ্জে সম্প্রতি র‌্যাবের একটি গাড়ি দেখে ফলের দোকান থেকে তড়িঘড়ি করে সরে যান এক ব্যবসায়ী। বিষয়টি চোখে পড়ে র‌্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্মকর্তার। বেশ কিছু সময় পর এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা ক্রেতা সেজে ফলের দোকানে যান। বিভিন্ন রকমের ফল কেনেন। দোকান কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করেন, দোকানটি কার? ওই কর্মচারী বলেন স্যার, এটা হুজুরের দোকান। হুজুরের বাড়ি গোপালগঞ্জে। কী নাম তার জানতে চাইলে কর্মচারী জানান, হুজুরের অনেক নাম। অনেক লোকে জানে সেলিম হায়দার। কেউ কেউ আবার আবু বক্কর সিদ্দিক নামে চেনে। তার আরও নাম আছে।
পরে ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা ফলের দোকানি লোকটির বর্ণনা দেন সদর দফতরের আরেক কর্মকর্তার কাছে। এরপর অভিযান চালিয়ে রমনা বটমূল বোমা হামলার মামলায় ফাঁসির আদেশ পাওয়া হরকাতুল জিহাদ (হুজি) সদস্য আবু বক্কর সিদ্দিককে গ্রেফতার করে র‌্যাব। বৃহস্পতিবার ভোরে কেরানীগঞ্জের একটি বাড়ি থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলারও অভিযুক্ত আসামি এবং নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হুজির শীর্ষ নেতা মুফতি হান্নানের অন্যতম সহযোগী।
বৃহস্পতিবার দুপুরে র‌্যাব সদর দফতরে আবু বক্করকে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করা হয়। র‌্যাব জানায়, আবু বক্কর পহেলা বৈশাখ রমনা বটমূলে একটি গ্রেনেড ছুড়েছিল বলে তাদের কাছে তথ্য রয়েছে। ওই দিন সকালে হামলার পর মাগরিবের নামাজ পর্যন্ত বায়তুল মোকাররম মসজিদেই ছিলেন তিনি। এরপর বিভিন্ন নাম নিয়ে ১৩ বছর ধরে আত্মগোপনে ছিলেন। এ সময়ের মধ্যে ১২ বার তার নাম বদল করেছেন।
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, পরিচয় গোপন করে ছদ্মবেশে বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত হয়ে আত্মগোপন করেন আবু বক্কর। ব্যবসার আড়ালে হুজির এ নেতা নাশকতার পরিকল্পনা করেন।
তিনি জানান, মুফতি হান্নানের আফগান যুদ্ধে অংশ নেয়ার গল্প শুনে হুজিতে যোগদান করেন আবু বক্কর। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। এত অল্প বয়সে হুজিতে যোগ দেয়া এই নেতা এক সময় মুফতি হান্নানের অন্যতম সহযোগী হয়ে যান।
২০০১ সালে রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে বোমা হামলায় ঘটনাস্থলে ৭ জন নিহত হন। হাসপাতালে মারা যান আরও তিনজন। ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় চলতি বছরের জুন মাসে ১৪ জন আসামির মধ্যে মুফতি হান্নান, আবু বক্করসহ আটজনের মৃত্যুদণ্ড এবং ছয়জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। এর মধ্যে ৬ জন গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন। ফাঁসির দণ্ডাদেশ পাওয়া ৮ জনের মধ্যে ৫ জন পলাতক রয়েছেন।
২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালায় জঙ্গিরা। এতে ২২ জন নিহত এবং শতাধিক নেতাকর্মী আহত হন। গ্রেনেড হামলা মামলায় অভিযুক্ত ৫২ আসামির মধ্যে ২৫ কারাগারে, ১৯ পলাতক এবং ৮ জন জামিনে রয়েছেন।
র‌্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ যুগান্তরকে বলেন, জঙ্গি দমনে র‌্যাব কঠোর গোয়েন্দা নজরদারি করে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ধরা পড়ে হুজির শুরুর দিকের এই ভয়ংকর নেতা।
হুজি নেতা মাওলানা আবু বক্কর সিদ্দিক আত্মগোপনে থাকার ১৩ বছরে সেলিম সিদ্দিক, সেলিম হায়দার, সেলিম হাওলাদার, হাফেজ আবু বক্কর হায়দার, আবু সিদ্দিক, হাফেজ আবু সেলিম, সেলিম ইসলাম, আবু হায়দার হাওলাদার, আবু হায়দার সেলিম, আবু মোহাম্মদ সিদ্দিক, হাফেজ হায়দার ইসলাম ও মুন্সি সেলিম বা হাফেজ হুজুর নামে নিজেকে পরিচয় দিয়েছেন।
র‌্যাব জানায়, আবু বক্কর সিদ্দিকের বাবার নাম মৃত আবদুর রাজ্জাক হাওলাদার। তার গ্রামের বাড়ি বরিশালের চর আবদানী এলাকায়। ছোটবেলায় সেলিম গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার গওহর ডাঙ্গা হাফিজিয়া মাদ্রাসায় লেখাপড়াকালীন মুফতি হান্নানের সঙ্গে পরিচয় হয়।
র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে আবু বক্কর জানান, ১৯৯২ সালে এই মাদ্রসায় মুফতি হান্নান তার আফগান যুদ্ধে অংশ নেয়ার গল্প বলেছিলেন। তখন তিনি হান্নানকে বলেছিলেন, গল্প শুনে তার যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছা হচ্ছে। সেই থেকে হান্নানের হাত ধরে নাশকতায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। ১৩ বছর আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় কখনও তিনি মাছের ব্যবসা, কখনও মুদি দোকান, কখনও আবার তেলের ব্যবসা করেছেন। ২০০৬ সালে তিনি মাগুরায় সিদ্দিকীয়া মাদ্রসায় চাকরি করেন। কিন্তু সেখানেও নিজেকে নিরাপদ না ভেবে ফের ব্যবসার হাল ধরেন। ২০০৯ সালের দিকে ঢাকার কেরানীগঞ্জে ফলের আড়তে কর্মচারী হিসেবে যোগ দেন। পরে ব্যবসার লাইন-ঘাট দেখে নিজেই ফলের দোকান দেন।
তিনি স্বীকার করেন, ২১ আগস্ট হামলা চালাতে তার পরিচিত কাজল আহমেদের ফোন পেয়ে তিনি ঢাকায় আসেন। কাজল ঢাকায় তৎকালীন ওলামা লীগের সভাপতি আক্তার হোসেন বোখারীর সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেন। পরে ওলামা লীগের সঙ্গে স্লোগান দিতে দিতে সমাবেশে প্রবেশ করেন। বোমা হামলার সময় তিনি সমাবেশের মঞ্চ থেকে ৪/৫ হাত দূরে ছিলেন। র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, পাসপোর্টে আবু বক্কর সিদ্দিক নামের বদলে সেলিম হায়দার উল্লেখ করা হয়েছে। সম্প্রতি দেশে বেশ কিছু জঙ্গিকে গ্রেফতার করার খবরে আবু বক্কর পালানোর পরিকল্পনা করছিলেন। কারাগারে গিয়ে মুফতি হান্নানের সঙ্গে দেখাও করেছেন এই হুজি নেতা।

No comments

Powered by Blogger.