রায়ের কপির অপেক্ষা

জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করা এখন সময়ের ব্যাপার। তবে দণ্ড কার্যকরের আগে প্রয়োজন আপিল বিভাগের রায়ের কপি। সেটি পূর্ণাঙ্গ হোক আর সংক্ষিপ্তই হোক। আপিল বিভাগের নির্দেশনা সংবলিত একটি রায়ের কপি ট্রাইব্যুনালে না পাঠানোর আগে ফাঁসি কার্যকর বা রায় রিভিউ কোনো প্রক্রিয়াই শুরু করা সম্ভব নয়। আইন বিশেষজ্ঞরা এমনটিই বলছেন। আসামিপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্যেও এটি স্পষ্ট।
বৃহস্পতিবার পর্যন্ত রায় বা আদেশের অনুলিপি প্রকাশিত হয়নি। কবে নাগাদ প্রকাশ হতে পারে সে ব্যাপারেও কেউ কিছু বলতে পারেননি। তবে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, এটা তিনদিন হতে পারে, এক সপ্তাহও হতে পারে। আবার সুপ্রিমকোর্টের আদেশ পাওয়া সাপেক্ষে এক মাসও হয়ে যেতে পারে।
৩ নভেম্বর আপিল বিভাগ মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যার দায়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। এরপর থেকে রায় কার্যকর নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা চলছে।
বৃহস্পতিবার অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ২০ (৩) ধারা অনুসারে সরকারের নির্দেশে দণ্ড কার্যকর হবে। কাজেই আপিল বিভাগের রায়ের অনুলিপি প্রকাশের পর সরকার যেদিন ঠিক করবে, সেদিন দণ্ড কার্যকর হবে।
দণ্ড কার্যকরে সংক্ষিপ্ত না পূর্ণাঙ্গ আদেশ লাগবে-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনেকে বলছে সম্পূর্ণ রায় পেতে হবে। আমি বলেছি, সংক্ষিপ্ত রায়ে এটি (ফাঁসির আদেশ) কার্যকর করা যাবে। সম্পূর্ণ বিষয়টি এখন আদালতের ওপর নির্ভর করছে।
এর ব্যাখ্যায় অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আপিল আদালত যে রায় দেন তা বিচারিক আদালতে (ট্রায়াল কোর্ট, এক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল) যায়। ট্রায়াল কোর্ট সে অনুসারে সিদ্ধান্ত নেন, মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেন। এখন আপিল বিভাগ যদি সম্পূর্ণ রায়টা পাঠান বা সিদ্ধান্ত নেন সম্পূর্ণ রায়টা পাঠাবেন, সেটা তাদের বিষয়। তারা যদি মনে করেন, সংক্ষিপ্ত রায় পাঠাবেন, তাহলে সেটাও তাদের বিষয়।
মাহবুবে আলম বলেন, সংক্ষিপ্ত রায়ে ফাঁসি কার্যকর করা যাবে, এটি আমার অভিমত। কামারুজ্জামানের মামলায় ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। এই রায় তো উনারা আগেই পেয়ে গেছেন। এখন এটা কার্যকর সময়ের ব্যাপার মাত্র।
অন্যদিকে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করেছেন তার চার আইনজীবী- মশিউল আলম, শিশির মনির, মতিউর রহমান আকন্দ ও এহসান এ সিদ্দিক। প্রায় আধা ঘণ্টার সাক্ষাৎ শেষে কারাগার থেকে বেরিয়ে শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, পরবর্তী আইনগত পদক্ষেপ নিয়ে তারা কামারুজ্জামানের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেছেন। তিনি তাদের বলেছেন, আপিলের রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি হাতে পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে তিনি রিভিউ পিটিশন দাখিল করবেন।
সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এ সুযোগ রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন শিশির। এ ক্ষেত্রে কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদনের প্রসঙ্গও টানেন তিনি।
গত বছরের ১২ ডিসেম্বর জামায়াতের আরেক নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। ওই রায় বাস্তবায়নের সময়ই রিভিউ নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউয়ের সুযোগ চান কাদের মোল্লা। রায় রিভিউ করে খালাসও চান তিনি। এ নিয়ে দুই পক্ষের বক্তব্য শুনে আপিল বিভাগ কাদের মোল্লার পক্ষে করা দুটি আবেদনই একসঙ্গে খারিজ করে দেন। ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি এখনও প্রকাশিত না হওয়ায় আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষ দুই রকম দাবি করে আসছে। বুধবার সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলন করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, এখন পর্যন্ত একটা রায় (আবদুল কাদের মোল্লার রায়) আছে, যেখানে রিভিউ পিটিশন ডিসমিসড হয়ে রায় কার্যকর হয়েছে। আমাকে সেটা ধরে নিয়ে রায় কার্যকর করার প্রস্তুতির আদেশ দিতে হবে। আমি কারা কর্তৃপক্ষকে সেই আদেশ দিয়েছি।
বৃহস্পতিবার আইনমন্ত্রীর এ বক্তব্যের বিরোধিতা করে শিশির মনির বলেন, তিনি আইনের কর্তৃত্ববহির্ভূত কথা বলেছেন। কারণ এখনও রায়ের শর্ট অর্ডার বের হয়নি। বিচারপতিদের স্বাক্ষর সংবলিত কোনো অর্ডার কারও কাছে পৌঁছায়নি। সুপ্রিমকোর্টের রুলসে আছে রিভিউ আবেদনের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি সংযুক্ত করতে হয়। আর দেশের সব নাগরিকেরই রিভিউয়ের সুযোগ পাওয়ার অধিকার আছে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শিশির মনির বলেন, কামারুজ্জামান ভালো, সুস্থ ও স্বাভাবিক আছেন। মানসিকভাবেও তিনি দৃঢ় রয়েছেন। আর রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়া- না চাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত রিভিউ পিটিশন নিষ্পত্তির পর নেয়া হবে।
গত বছরের ১২ ডিসেম্বর কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়। ৫ ডিসেম্বর তার মামলার আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়। রায়ের কপি প্রকাশের পর ৮ ডিসেম্বর সেটি ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। ট্রাইব্যুনাল সেদিনই কাদের মোল্লার মৃত্যুপরোয়ানা জারি করে আদেশটি ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠান। রায়ের কপি হাতে পেয়েই তার ফাঁসি কার্যকর করার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হয়।
কাদের মোল্লার পক্ষে দুটি আবেদন করা হয়েছিল। একটি রিভিউ (রায় পুনর্বিবেচনার) আবেদন করার সুযোগ চেয়ে বা গ্রহণযোগ্যতার ওপর এবং অন্যটি রায়টি রিভিউয়ের জন্য। ১১ ডিসেম্বর আপিল বিভাগ পুনর্বিবেচনার আবেদনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে শুনানি করেন। ১২ ডিসেম্বরও শুনানি করে প্রধান বিচারপতি কেবল ঘোষণা দেন যে, বোথ দ্য ক্রিমিনাল রিভিউ পিটিশনস আর ডিসমিসড।
কিন্তু তাতে কী কারণে খারিজ হয়েছে তা স্পষ্ট হয়নি। আপিল বিভাগ রিভিউ আবেদনটি গ্রহণ করে খারিজ করেছেন নাকি রিভিউ গ্রহণের আগেই খারিজ হয়েছে সেটি স্পষ্ট করেননি। এমনকি সেই রায়টিও এখনও প্রকাশিত হয়নি। তাই মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডাদেশ পাওয়া ব্যক্তিরা রিভিউ করার সুযোগ পাবেন কিনা তা নিয়ে আইনি তর্কের মীমাংসা হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.