স্বাস্থ্যখাতে নিয়োগ-পদোন্নতিতে ১০ লাখ পর্যন্ত ঘুষ নেয়া হয় -ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল

চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশনে পছন্দের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগী পাঠানো হয়। আর ওই সব ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে চিকিৎসকরা শতকরা ৩০ থেকে ৫০ ভাগ পর্যন্ত কমিশন নেন। অনেক সময় প্যাথলজিস্ট না রেখেই তাদের সিল ব্যবহার করে  পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট তৈরি করে তা সরবরাহ করা হয়। এ অবস্থায় অনেকেই বিদেশে চিকিৎসার জন্য ছুটছেন। পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিতে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ আদান-প্রদান হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সিভিল সার্জন অফিসের কর্মকর্তা ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা এ উৎকোচ গ্রহণ করেন। এ তথ্য প্রকাশ করে স্বাস্থ্য খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে ১৭ দফা সুপারিশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। বলা হয়েছে সরকারি স্বাস্থ্য সেবা প্রদানে বছরে নিয়ম বর্হিভূত ৭০.৩ কোটি টাকা আদান-প্রদান হয়। গতকাল দুপুরে মহাখালীর একটি হোটেলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যখাতে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায় শীর্ষক এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সম্মেলনে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপ-নির্বাহী পরিচালক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক রফিক হাসান এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম. আকরাম উপস্থিত ছিলেন। মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার তাসলিমা আক্তার।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, স্বাস্থ্য খাতে সার্বিকভাবে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসনীয় ও স্বীকৃতিপ্রাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে সুশাসন নিশ্চিত করে কার্যকরভাবে দুর্নীতি ও বহুমুখী অনিয়ম নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে এ খাতে অর্জন আরও অগ্রগতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি বলেন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে অর্জিত অগ্রগতির স্থায়িত্ব ঝুঁকির সম্মুখীন হবে। অন্যদিকে স্বাস্থ্যখাতের মতো মৌলিক অধিকার খাতে আর্থিক বরাদ্দ বিব্রতকরভাবে নিম্নমানের; যার প্রভাবে স্বাস্থ্য অবকাঠামো, জনবল ও গুণগত চিকিৎসা সেবায় প্রত্যাশিত মান অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না। ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, চিকিৎসক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর কমিশন বাণিজ্য ও সিন্ডিকেটের কারণে রোগীরা সেবা নিতে গিয়ে আস্থার সঙ্কটে ভুগছে। আর তাই তারা বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছেন। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতে দলীয়করণ ও বৈষম্য তো রয়েছেই। আর্থিক বরাদ্দও উদ্বেগজনকভাবে কমে গেছে। এ খাতে বরাদ্দ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী জিডিপির শতকরা ৫ ভাগ হওয়ার কথা থাকলেও তা কমে শূন্য দশমিক ৮৪ ভাগ দেয়া হচ্ছে। এ অবস্থার পরিবর্তনে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও  জাতীয় প্রাধান্য নির্ধারণ অপরিহার্য ।
গবেষণার পর্যবেক্ষণে বলা হয়, জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০১১, দি মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেগুলেশন) (অর্ডিন্যান্স) ১৯৮২, এবং দি মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (অ্যামেন্ডমেন্ট) অর্ডিন্যান্স ১৯৮৪ বলবৎ থাকলেও এগুলো যুগোপযোগী না হওয়ায় চিকিৎসকের অবহেলার কারণে কোন রোগীর মৃত্যু বা ক্ষতি হলে তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, বিনা অনুমতিতে কাজে অনুপস্থিতির ও বিলম্বে উপস্থিতির জন্য শাস্তির বিধান থাকলেও তার প্রয়োগ অত্যন্ত সীমিত। অনেক ক্ষেত্রে আবার শাস্তি কম।
প্রতিবেদনে প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে বলা হয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মোট জনবলের শতকরা ২০ ভাগ পদ শূন্য রয়েছে। অন্যদিকে বিদ্যমান জনবলের অনুপাত বিশ্ব মানদণ্ড অনুপাতে খুবই কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী চিকিৎসক জনসংখ্যা অনুপাতে ১ঃ৬০০ হলেও বাংলাদেশে এটি ১ঃ৩২৯৭। যেখানে আন্তর্জাতিকভাবে ডাক্তার ও নার্সের স্বীকৃত অনুপাত ১ঃ৩, বাংলাদেশে এ অনুপাত ১ঃ০.৪। ৬৪টি জেলার মধ্যে ২৬টি জেলায় ডেপুটি সিভিল সার্জন পদ তৈরি করা হলেও ছয়টি জেলায় উক্ত পদে পদায়ন নেই। হাসপাতালের সুষ্ঠু চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হওয়ার পেছনে  নান অপ্রীতিকর ঘটনায় হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়া; হাসপাতালে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বা প্রভাব; হাসপাতাল অভ্যন্তরে দালাল দ্বারা হয়রানির শিকার ইত্যাদি বিষয়  গবেষণায় উঠে এসেছে।
এতে বলা হয়, এডহক চিকিৎসক ও কর্মচারী নিয়োগে দলীয় তদবিরের পাশাপাশি নিয়ম-বহির্ভূত অর্থের লেনদেন হয়। এডহক চিকিৎসক ও তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগে নিয়মবর্হিভূতভাবে ১ থেকে ৫ লাখ টাকা, বদলির জন্য ১০ হাজার থেকে ১০ লাখ টাকা এবং ডিপার্টমেন্টাল প্রমোশন কমিটি (ডিপিসি)’র মাধ্যমে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা ঘুষ আদান-প্রদান হয়। এসব অনিয়ম ও লেনদেনে দলীয় নেতা, কর্মচারী ইউনিয়ন নেতা, অফিস প্রধান সহকারী, হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা, এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের একাংশের যোগসাজশের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া, চিকিৎসকদের সঙ্গে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কমিশনভিত্তিক অলিখিত চুক্তির অভিযোগ রয়েছে।
বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে টিআইবি ১৭টি সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
নতুন আইন প্রণয়ন ও বিদ্যমান আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার করা। বিভিন্ন শূন্য পদ পূরণে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ। জনবল নিয়োগে দীর্ঘসূত্রতা দূর করা। পদোন্নতিতে যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচনে যোগ্যতার বিভিন্ন সূচকে স্কোরিং ব্যবস্থা চালু। পেশাজীবী সংগঠনগুলোর দলীয় হস্তক্ষেপ বন্ধ করা। স্থানীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে সংসদ সদস্যদের সক্রিয় উদ্যোগে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলো কার্যকর করা। রোগীর তথ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিটি হাসপাতালে তথ্য ও অনুসন্ধান ডেস্ক কার্যক্রম চালু। চিকিৎসকের অবহেলা বা ভুল চিকিৎসার ক্ষেত্রে তদন্তসাপেক্ষে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ। বিএমডিসি’র ওয়েবসাইটে নিবন্ধিত চিকিৎসকদের ডিগ্রি বা যোগ্যতাসহ তালিকা প্রকাশ এবং নিয়মিত হালনাগাদ করা। ক্রয়, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে ই-টেন্ডারিং প্রক্রিয়া চালু করা এবং বেসরকারি চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানের মান নিয়ন্ত্রণে তদারকি কার্যক্রম ব্যবস্থা জোরদার করা। এতে বলা হয়, ২০১৩ সালের নভেম্বর থেকে আগস্ট ২০১৪ পর্যন্ত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় উৎস হতে তথ্য সংগ্রহ করা হয় এ গবেষণার জন্য। একই সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের চিকিৎসাসেবাদানকারী ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের জনবল ব্যবস্থাপনা, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের ক্রয়, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থাপনা, সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানের সেবা কার্যক্রম এবং বেসরকারি চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানের তদারকি ব্যবস্থাপনা পর্যালোচনা করা হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে। আর খসড়া প্রতিবেদনটি গত ২৮শে আগস্ট স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের উপস্থাপন করে তাদের মতামত সন্নিবেশন করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

No comments

Powered by Blogger.