মায়ের লাশ কাঁধে নিল রিফাত-রশ্মি কাতর হাসপাতালে by এস এম আজাদ

হাসপাতালে জ্ঞান ফেরার পর থেকেই রশ্মি বারবার বলছে, 'আম্মু কোথায়? আম্মুর কাছে যাব।' বড় ভাই রিফাতেরও খোঁজ করছে সে। শুনে স্বজনদের কেউ কেউ আড়ালে গিয়ে চোখ মুছেছে। কেউ বা বলেছে, 'তোমরা অ্যাঙ্েিডন্ট করেছ তো, তোমার আম্মু আর ভাইয়া হাসপাতালের অন্য জায়গায় আছে।
' মা ও ভাইয়ের এমন খবর শুনে ছোট্ট রশ্মির মন আরো খারাপ হয়ে যায়। কী যেন ভাবে। রেল দুর্ঘটনায় তার মা মারা গেছে- সাত বছরের শিশুর মন কি এমন অনুমান করতে পারে?
আতিকা সুলতানা রশ্মির কারাবন্দি বাবা রিপন খন্দকার গত শুক্রবার দুর্ঘটনার দিনই জেনেছেন, রাজধানীর খিলগাঁওয়ে ট্রেনের ধাক্কায় তাঁর স্ত্রী রত্না খন্দকার মারা গেছেন। আহত হয়েছে তাঁর দুই শিশু সন্তান রশ্মি ও রিফাত। স্ত্রীর মুখ শেষবারের মতো দেখতে, আর সন্তানদের কাছে ছুটে যেতে ছটফট করেছেন রিপন। কিন্তু আইনের শিকলে যে বাঁধা তাঁর দুটি পা। গতকাল শনিবারও আদালত তাঁর জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেছেন। তবে রিপনের ইচ্ছে অনুযায়ীই গতকাল তাঁর গ্রামে রত্নাকে দাফন করেছে স্বজনরা। এমন পরিস্থিতিতে রিফাত ও রশ্মিকে মানসিক আঘাত থেকে দূরে রাখতে চাইছে স্বজনরা। বড় রিফাত জানলেও রশ্মি যেন কিছুতেই তার মায়ের মৃত্যু সংবাদ না পায়- এমন চেষ্টাই সবার। তাই গতকাল কোনো সাংবাদিককেই রশ্মির কাছে ভিড়তে দেয়নি তারা।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ২০৬ নম্বর ওয়ার্ডে এখনো চিকিৎসাধীন রশ্মি। গতকাল হাসপাতালে গিয়ে জানা গেছে, তার শয্যাপাশে আছেন ফুফু সুলতানা রাজিয়া, ফুফাতো বোন চিকিৎসক ফাহমিদা সুলতানা এবং আরেক ফুফাতো বোন ডেন্টাল কলেজছাত্রী নূরে তামান্না তৃষা। তাঁরা রশ্মিকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন নানা কথা বলে। গতকাল তৃষার অনেক সহপাঠী দেখতে আসে রশ্মিকে। তারা সাংবাদিকদের সঙ্গে রশ্মিকে কথা বলতে দেয়নি। স্বজনরা বলছিল, রেললাইনের লেভেল ক্রসিংয়ে দ্রুত ট্রেন চলে এলে সন্তানদের নিরাপদ দূরত্বে ছুড়ে মারেন রত্না। এরপর নিজেকে আর রক্ষা করতে পারেননি। স্বজন ও চিকিৎসকরা জানিয়েছে, রশ্মির সিটি স্ক্যান করা হয়েছে। তার মাথায় বড় ধরনের জখম পাওয়া যায়নি। সে এখন আশঙ্কামুক্ত।
একজন দুর্ভাগা রিপন : রিফাত ও রশ্মির ফুফা আবদুল লতিফ কালের কণ্ঠকে জানান, গত শুক্রবার সকালে সন্তানদের নিয়ে কারাগারে স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন রত্না। স্ত্রী-সন্তান আসছে এ খবর আগেই পেয়ে অপেক্ষাই ছিলেন রিপন। সকাল গড়িয়ে দুপুর হলেও স্ত্রী-সন্তানদের না দেখে উৎকণ্ঠায় ছিলেন তিনি। একপর্যায়ে লতিফের মাধ্যমে রিপন জানতে পারেন দুর্ঘটনার খবর। এ খবর শুনে চিৎকারে ফেটে পড়লেও জেলহাজতের দেয়ালের বাইরে যায়নি সে আওয়াজ।
জানা যায়, গতকাল শনিবার জামিনের জন্য আইনজীবীর মাধ্যমে আবেদনও করেছিলেন রিপন। কিন্তু সেই জামিন আবেদন মঞ্জুর না হওয়ায় তিনি জেলহাজত থেকে বের হতে পারেননি। লতিফ জানান, রিপন স্বজনদের কাছে অনুরোধ করেছেন, নরসিংদীর বেলাবতে তাঁর গ্রামের বাড়ির কবরস্থানে যেন রত্নাকে দাফন করা হয়। আর জানাজার নামাজটি যেন পড়ান রিপনের বাবা আলহাজ খন্দকার রেজাউল করিম। রিপনের চাওয়া অনুযায়ীই স্বজনরা গতকাল বাদ জোহর জানাজা শেষে রত্নাকে দাফন করেছে। মায়ের লাশ কাঁধে বহন করেছে ১৪ বছরের খন্দকার আশফাক রিফাতও।
রিপনের ভগি্নপতি আবদুল লতিফ দুঃখ করে বলেন, 'দেখেন, ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। আমার শ্যালক কোনো বড় অপরাধ করেছে বলে জানা নেই। সন্দেহভাজন হিসেবে তাকে গ্রেপ্তার করা হলো। আর তার জীবনে কী ট্র্যাজেডি ঘটে গেল...।'
স্বজনরা জানায়, গত ১০ ডিসেম্বর নয়াপল্টনের বিএনপি অফিসের সামনে থেকে পুলিশ রিপনকে গ্রেপ্তার করে। বনানীর একটি রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপক রিপন ব্যক্তিগত কাজে সেখানে গিয়েছিলেন। আটকের পর তাঁকে ৯ ডিসেম্বর অবরোধের সময় গাড়ি ভাঙচুর ও পোড়ানো মামলায় জেলহাজতে পাঠানো হয়। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পল্টন থানার ওসি গোলাম সরোয়ার বলেন, 'তিনি (রিপন) বিএনপির সক্রিয়া কর্মী হিসেবে কর্মসূচিতে অংশ নিতেন। গাড়ি ভাঙচুর ও পোড়ানোর মামলাসহ তাঁর বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা আছে।'
স্বজনরা জানিয়েছে, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র খন্দকার আশফাক রিফাতও দুর্ঘটনায় আহত হয়। তার মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম হয়। তবে সে আঘাত গুরুতর নয়। বাবা কারাগারে, ছোট বোন আহত; তাই হাসপাতালে ভর্তি থাকতে চাইছিল না রিফাত। গত শুক্রবার বিকেলেই ফুফুর বাসায় চলে যায় সে। অসুস্থ শরীরে গতকাল নরসিংদী গিয়ে নিজ হাতে মাকে দাফন করে।
গত শুক্রবার সকালে রাজধানীর খিলগাঁও রেললাইনের লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় প্রাইভেট কার, সিএনজি অটোরিকশাসহ তিনটি রিকশা দুমড়েমুচড়ে যায়। এ দুর্ঘটনায় রিকশার যাত্রী রত্না খন্দকার নিহত ও তাঁর দুই সন্তান আহত হয়। তাঁদের বহনকারী রিকশাচালক শহিদুল ইসলামও গুরুতর আহত হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

No comments

Powered by Blogger.