অনন্য সংগঠক আবদুর রাজ্জাক by কাজী নজরুল ইসলাম

প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, সাবেক পানিসম্পদ মন্ত্রী, জাতীয় নেতা আবদুর রাজ্জাকের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। গত বছর এই দিনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
তিনি পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগ থেকেই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৬০-৬২ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হল ছাত্র সংসদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিএস নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে বঙ্গবন্ধু আবদুর রাজ্জাককে কাজী আরেফ আহমেদ ও সিরাজুল আলম খানের সমন্বয়ে নিউক্লিয়াস অব বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স বা বিএফএল গঠন করে চূড়ান্ত মুক্তির লক্ষ্যে সংগঠিত হওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। তিনি '৬৩-৬৫ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৫-৬৬ সালের ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সভাপতি মাজহারুল ইসলাম বাকির সঙ্গে এবং '৬৬-৬৭ সালের কমিটিতে ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর সঙ্গে পরপর দু'বার সাধারণ সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯-৭২ সাল পর্যন্ত আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আবদুর রাজ্জাক। ১৯৭২ থেকে '৭৫ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন তিনি (বঙ্গবন্ধু ছিলেন সভাপতি)। ১৯৭৫-৭৮ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু কর্তৃক গঠিত বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশালের সম্পাদক ছিলেন আবদুর রাজ্জাক (বঙ্গবন্ধু ছিলেন চেয়ারম্যান)। ১৯৭৮ থেকে '৮১ সাল পর্যন্ত পরপর দু'বার দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় প্রথমবার সভাপতি ছিলেন আবদুল মালেক উকিল ও পরেরবার শেখ হাসিনা। ১৯৮৩ সালে আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে পুনরায় বাকশাল গঠন করে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯১ সালে বাকশাল বিলুপ্ত করে আবার আওয়ামী লীগে প্রত্যাবর্তন করে ১৯৯২-২০০৯ সাল পর্যন্ত দলের কেন্দ্রীয় সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। ২০০৯ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দলের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে আবদুর রাজ্জাক পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সফল মন্ত্রী হিসেবে ৫ বছর দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমান নবম জাতীয় সংসদে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতিও ছিলেন তিনি। এ ছাড়াও '৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। যুদ্ধকালীন মুজিব বাহিনীর অন্যতম প্রধান হিসেবে ভারতের দেরাদুন ও মেঘালয়ে একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। তার স্বপ্ন ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখে যাওয়া। এর আগে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক সমাবেশে বঙ্গবন্ধুকে মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার সাহসী দায়িত্ব পালন করেন আবদুর রাজ্জাক। তিনি পঞ্চাশের দশক থেকে '৭৫-এর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর একজন স্নেহভাজন, বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচর হিসেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন। '৭৫-এর ট্র্যাজেডির পরে আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠনের জন্য কাজ করতে গিয়ে জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার তাকে কারারুদ্ধ করেছিল।
আবদুর রাজ্জাক প্রথম ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে তৎকালীন ভেদরগঞ্জ ও গোসাইরহাট থানা নিয়ে গঠিত ফরিদপুর-১৭ আসন থেকে বিজয়ী হয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনের তৎকালীন একাংশ (মাদারীপুরের কালকিনি ও গোসাইরহাট) নিয়ে গঠিত নির্বাচনী এলাকা থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৭৯, ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাংগঠনিক সিদ্ধান্তের কারণে তিনি অংশগ্রহণ করেননি। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮-এর পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শরীয়তপুর-৩ আসন থেকে পরপর ৪ বার তিনি বিপুল ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৯১ সালে আবদুর রাজ্জাক শরীয়তপুর-৩ ও মাদারীপুর-২ আসন থেকে, ১৯৯৬ সালে শরীয়তপুর-১ ও শরীয়তপুর-৩ আসন থেকে, ২০০১ সালে শরীয়তপুর-৩ ও ফরিদপুর-৪ আসন থেকে তাকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হলে তিনি প্রতিটি আসন থেকেই সম্মানের সঙ্গে বিজয় লাভ করেন। অথচ ওইসব নির্বাচনে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা ও আবদুর রাজ্জাক ছাড়া অন্য কোনো কেন্দ্রীয় নেতা একাধিক আসন থেকে নির্বাচিত হতে পারেননি।

কাজী নজরুল ইসলাম :সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.