রঙ্গ কলাম, চিরতা ও মধুঃ হায়রে ফুয়েল! by হাসান হাফিজ

‘অনেক অনেক দিন আগেকার কথা। আরবের লোকেরা তখন আল্লাহকে ভুলিয়া গিয়াছিল। কন্যাশিশুর জন্ম হইলে তাহাকে জীবন্ত কবর দেওয়া হইত।’ না, না—অত আগের কথা নয়। শিল্পী রফিকুন নবীর একটা কার্টুন দেখেছিলাম।
সেই কার্টুনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ এরকম : এক লোক গেছেন তদবির করতে। সংশ্লিষ্ট কেরানির কথা শুনে তিনি অবাক। কেরানি বলছে, ‘ফাইলটায় তো স্যার চা পানি খাইবার চায়।’
সেই কার্টুনটির কথা মনে পড়ে গেল একটি খবর পড়ে। প্রথমে খবরটা নিই। ঘটনাস্থল জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার চরপলিশা নয়াপাড়া গ্রাম। উদ্যমী ও বিদ্যোত্সাহী যুবক সামিউল হক নিজ উদ্যোগে এখানে ’৯০ সালে একটি প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। বাবার পৈতৃক ভিটে থেকে ৫২ শতাংশ জমি লিখে দেন স্কুলকে। গ্রামের চার শিক্ষিত তরুণ-তরুণীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। অল্প দিনেই ছাত্রছাত্রীরা মুখর করে তোলে স্কুল অঙ্গন। শিক্ষাবঞ্চিত কৃষক দিনমজুরদের ছেলেমেয়েরা পড়ে এখানে। বৃত্তিও পেয়েছে অনেকে। আপন যোগ্যতায় ঠাঁই করে নিয়েছে নামীদামি বিদ্যাপীঠে। এই হলো এই খবরের আলোকিত অংশ। এই কলামের ‘মধু’ময় অংশ এটুকু।
বাকি অংশ তেতো অর্থাত্ অপ্রীতিকর, বিশ্রী। ‘চিরতা’ অংশ। স্কুলটি ২০০৬ সালে পাঠদানের অনুমতি ও ২০০৮ সালে অস্থায়ী রেজিস্ট্রেশন পায়। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও জায়গামতো ‘ফুয়েল’ দিতে না পারায় স্কুলটির কপালে পূর্ণাঙ্গ রেজিস্ট্রেশন জোটেনি আজ পর্যন্ত। গত ২০ বছর ধরে চার শিক্ষক বেতন পান না। এখন স্কুলটিতে বিদ্যার্থীর সংখ্যা তিন শতাধিক। প্রকৃতি বৈরী আচরণ করেছে স্কুলটির সঙ্গে। সেটাকে আমরা বলতে পারি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা কিংবা গোদের উপর বিষফোঁড়ার শামিল। এরই মধ্যে স্কুলঘরটি ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়েছে ১৬ বার। প্রতিবারই প্রতিষ্ঠাতা নিজের গাঁটের টাকায় এ সঙ্কট সামাল দিয়েছেন।
সর্বশেষ গত বছর কালবৈশাখী ঝড়ে স্কুলঘরটি বিধ্বস্ত হয়। তারপর সেটি সংস্কার বা মেরামত করা সম্ভব হয়নি। বছরখানেক ধরে স্কুলের ক্লাস হয় সামিউলের বাড়ির আঙিনার গাছতলায় ও বৈঠকখানায়। গত ২৯ মার্চ একটি জাতীয় দৈনিকে ছবিসহ ছাপা হয়েছে এ সংবাদ।
এই দুর্ভোগ বা শাস্তি কি সামিউল হকের প্রাপ্য? স্কুল প্রতিষ্ঠা করে, এত বছর ধরে ব্যয় বহন করে তিনি কতটা অন্যায় করেছেন? দুষ্ট লোকে বলবে নিশ্চয়ই অন্যায় করেছেন। দুষ্ট লোক নানা যুক্তি তথ্য তত্ত্ব হাজির করবে। কী কী সেই কুযুক্তি ও কুতথ্য? আমরা তাতেও চোখ বুলিয়ে দেখার চেষ্টা করতে পারি। এই নেতিবাচক দৃষ্টিক্ষেপের জন্য পাঠকের কাছে আগাম মার্জনা (আগাম জামিন নেয়ার মতো) চেয়ে নিই।
১. সামিউল হক নির্ঘাত অন্যায় করেছেন। কারণ, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে কে বলেছে তাকে? বাপের ভিটেমাটি স্কুলকে অহেতুক দান-দক্ষিণা দিয়ে কবিরা গুনাহ করে ফেলেছেন। অবিলম্বে তওবা পড়া উচিত তার।
২. দিনবদলের মহাজোটীয় যুগ শুরু হয়েছে মাত্র বছর দেড়েক আগে। তার অনেক অনেক আগে থেকেই তিনি এই কাজ শুরু করেছেন অনুমোদনহীনভাবে। সুতরাং ‘ফুয়েল’ দাবি করে, আমলাতান্ত্রিক গিট্টু দিয়ে তার বারোটা বাজিয়ে দিতে পারলে কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি নেই। যারা করবে, পুরস্কার তাদের প্রাপ্য।
৩. খোলা উঠানে তো দিব্যি চলছে। ঘর থাকলেই আসবাবের দরকার, বিদ্যুতের দরকার। আসবাব মানেই গুচ্ছের গাছপালার গুষ্ঠি নাশ—বনায়নের দফা রফা। সোনার বাংলার সোনার বিদ্যুত্ তো চাইলেই মিলবে না। হেঃ হেঃ।
৪. গাছতলায় লেখাপড়াই তো উত্তম। শিশুরা প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য পাচ্ছে। এই মডেল অনেকটা সার্থক (২০ বছরে ১৬ বার ভেঙে যাওয়া সত্ত্বেও দমানো যায়নি)। অন্যান্য হতদরিদ্র এলাকায় এই মডেল ট্রাই করা যেতে পারে। প্রকল্প সারপত্র তৈরি করে দাতা বাপদের ভজাতে পারলে কিছু ফরেন কারেন্সিও জুটতে পারে। রিজার্ভ বাড়ুক, ক্ষতি কী! রিজার্ভ উদ্বৃত্ত বলেই না বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফুটানি করে বলতে পেরেছেন, আইএমএফের কড়া নজরদারি ও মুরুব্বিপনা আমরা আর আগের মতো সহ্য করব না।
৫. পূর্ণাঙ্গ রেজিস্ট্রেশনের জন্য লোভ করা ঠিক নয়। দিলেই সরকারের অর্থ ব্যয়—নানা দিগদারি। ওই চারজন শিক্ষকের ভূমিকার প্রশংসা হয়তো করা যায়। এই কালে বেতন ছাড়া এক গণ্ডা শিক্ষক যা করছেন তা অনুসরণযোগ্য।
৬. সামিউল হক জায়গা-জমির অপচয় অপব্যবহার করছেন। ছোট্ট কয়েকটি ঘরের পরিবর্তে বিস্তীর্ণ আঙিনা ব্যবহার করতে দিচ্ছেন স্কুলের নামে। এ জায়গায় তামাক চাষ করলে আয়-রোজগার ভালো হতো। স্থানীয় চাষী-মজুররাও দু-চারটে পয়সার মুখ দেখতে পেত এই দুর্দিনে। কিংবা নিদেনপক্ষে কোনো গ্রামভিত্তিক এনজিওকেও ভাড়া দেয়া যেতে পারত।
৭. স্কুল প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ যাবত্ যাবতীয় খরচাপাতির জোগান দিয়েও তিনি সর্বনাশ করেছেন। স্কুলকে পুতু পুতু করে আগলে রেখে তিনি স্বনির্ভর হতে দেননি। নিজের পায়ে দাঁড়ায়নি স্কুল। এটা ফৌজদারি অপরাধ কিনা তদন্ত করে দেখার সুপারিশ করছি।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
hasanhafiz51@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.