ধানের বাম্পার ফলন-কৃষকদের দুর্গতি হবে কেন?

আবারও ধানের বাম্পার ফলন! আবার বাংলাদেশের কৃষকের কান্না! মৌসুমের পর মৌসুম ধানের বাম্পার ফলন এনে দিয়ে তারা কি অপরাধ করছে? এসব প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের দিতে হবে।
বাড়তি ফসল ফলিয়ে কেন কৃষকের দুর্ভোগ, অর্থনীতিবিদ এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়দের জন্যও এ প্রশ্ন জ্বলন্ত। বহু বছর বাংলাদেশের তকমা ছিল 'খাদ্য ঘাটতির দেশ'। এখন এ অপবাদ ঘুচে গেছে। বিশ্বব্যাপী যখন খাদ্যের আসন্ন সংকট নিয়ে উদ্বেগ, তখন বাংলাদেশে গোলাভরা ধান। এর পেছনে শেখ হাসিনার সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি ও কর্মকৌশলের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু প্রধান অবদান কৃষকদেরই। তারাই জাতীয় বীর। অনেক বিশেষজ্ঞ যথার্থই বলেন, স্বাধীন দেশ প্রকৃত অর্থেই 'সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা'। এর পুরস্কার কৃষকদের দিতেই হবে। কিন্তু শনিবার সমকালে 'প্রতি মণ ধানে কমপক্ষে ৮০ টাকা লোকসান দিচ্ছে কৃষক' শিরোনামের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় যত বেশি ফলন, ততই সেটা যেন কৃষকের জন্য অভিশাপ। বিদেশে প্রতি কেজি চালের গড় দাম এখন ৪৬ টাকা। দেশে সরকার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে ২৬ টাকা। ২০১০-১১ সালে প্রতি কেজির দাম নির্ধারিত ছিল ২৯ টাকা, গত বছর কমিয়ে করা হয় ২৮ টাকা। এবারে আরও কমিয়ে করা হয় ২৬ টাকা। অথচ প্রতিবছর বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়। কমছে উৎপাদিত ধানের দাম। কৃষকের সঙ্গে এ কেমন পরিহাস! মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ছে বলে সরকার গর্ব করে। তাহলে ধান-চালের দাম কেন বাড়বে না? কৃষক মূল্যস্ফীতির অর্থ হয়তো ঠিকভাবে বোঝে না, কিন্তু নিশ্চিতভাবেই তারা এর চরম শিকার। চাল-ডাল-মাছ থেকে শুরু করে ধান ফলানোর সার-বীজ-সেচের পানি, এক কথায় সবই তাদের কিনতে হয় চড়া দামে। জীবনযাপনে ব্যয়ের পরিমাণও বাড়ছে। উৎপাদিত প্রধান ফসলের দাম না পেলে সংসারের ব্যয় কীভাবে বহন করবে? নতুন বিনিয়োগের অর্থই বা আসবে কোত্থেকে? পাটের উৎপাদন করে তারা লাভ পায় না। বোরো ধানে লোকসান গেছে। আমনেও লোকসান। কৃষক কত খেসারত দেবে? এটাও মনে রাখতে হবে, কৃষকের সামনে বিকল্প রয়েছে। শনিবার সমকালে 'দিনাজপুরে আগাম আলু/কৃষকের মুখে হাসি' শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়, 'বোরো-আমন মৌসুমে ধানের ভালো দাম না পেলেও দিনাজপুরে আগাম আলুর বাম্পার ফলন এবং বাজারমূল্য কৃষকের মুখে হাসি ফুটিয়েছে।' শীতকালীন সবজিতেও ভালো দাম মেলে। মৌসুমের পর মৌসুম কৃষক ধানের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হলে তারা লাভজনক অন্যান্য ফসল আবাদে ঝুঁকে পড়লে দোষ দেওয়া যাবে না। বিশ্ববাজারে ধান-চালের ভালো দাম মিলছে। বাংলাদেশ প্রতি বছর ৩০-৩৫ লাখ টন গম আমদানি করে। তার দামও দেশের বাজারে চালের তুলনায় বেশি। এ চিত্র আমাদের কৃষকদের জন্য হতাশার। এটা ঠিক যে, চালের দাম কম থাকলে দরিদ্র জনগোষ্ঠী খুশি থাকে। শহরের বিত্তবান, সচ্ছল ক্রেতাদেরও এটাই পছন্দ। কিন্তু তার দায় কেন ধানের উৎপাদক কৃষকরা বহন করবে? সরকার কি ভাবছে না, দেশ খাদ্যে ফের ঘাটতি দেশে পরিণত হলে কী বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে তা পূরণ করতে হতো? খাদ্য নিরাপত্তা পড়বে শঙ্কায়। সরকার সার-বীজ-সেচের জন্য ভর্তুকি দিলে এ শঙ্কা থাকে না। এতে কিন্তু উৎপাদক ও ক্রেতা সবারই লাভ। বাম্পার ফলনের কারণে সরকার ১০-১২ লাখ টন চাল রফতানির বিষয়েও জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.