আইলাদুর্গতদের দুর্ভোগঃ দেখার কেউ নেই

গত বছরের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল উপকূলীয় অঞ্চল। তার আগে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর আঘাত হানা সিডরের বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার আগেই আইলা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দক্ষিণের জেলাগুলোর ওপর। সেখানকার দুর্গত এলাকা এখনও স্বাভাবিক হয়ে উঠেনি।
লাখ লাখ মানুষ বেড়িবাঁধের পাশে ঝুপড়িতে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। সেই থেকে এলাকার স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থমকে আছে। দুর্গত মানুষের খাদ্য পানীয়ের আহাজারিতে কান দেয়ার সময় হয়নি কারও। মার্চ মাসের শেষদিনে জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবসের অনুষ্ঠানে খাদ্যমন্ত্রীর কণ্ঠে হতাশা প্রকাশ পেয়েছে। আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় আন্তর্জাতিক সাহায্য মেলেনি বলেছেন তিনি। গত ক’দিন ধরে আমার দেশ-এ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দুর্গত জীবন নিয়ে বেশ ক’টি প্রতিবেদন প্রকাশের পর খাদ্যমন্ত্রীর কথা থেকে সরকারের মনোভাব পরিষ্কার। বিদেশি সাহায্যের দিকেই তাকিয়ে আছে সরকার।
প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর দেশ-বিদেশের অনেকেই দুর্গত এলাকায় ছুটে আসেন। সরেজমিন পরিদর্শনের সময় তারা অনেক প্রতিশ্রুতিও দেন। মিডিয়ায় তা প্রচার হয়; কিন্তু বাস্তবে কী হয় তার প্রমাণ উপকূলীয় জনপদের আজকের চিত্র। এই গরমে খাবার পানির অভাবে পুকুরের পানি কিনে খেয়ে পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। আইলার কারণে বিশুদ্ধ পানির উত্স নষ্ট হওয়ার পর এক বছর পার হতে চললেও এলাকার পানি সমস্যার সমাধান হয়নি। সাগরের লাবণাক্ত পানিতে জমির লবণাক্ততা বেড়ে ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ হওয়ায় এখন সমগ্র এলাকা স্যালাইন ডেজার্ট বা লোনা মরুতে পরিণত হয়েছে। জমিতে ফসল হচ্ছে না। পুকুরে মাছ চাষ বন্ধ। খাওয়ার পানি নেই। মানুষ অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। অপরিহার্য খাবার পানি সংগ্রহের স্বার্থে সোমত্ত মেয়েদের বিয়ে দিচ্ছেন না আইলাবিধ্বস্ত এলাকার মানুষ। এর চেয়ে মর্মস্পর্শী খবর আর কি হতে পারে! এখনও নিজেদের ঘরবাড়িতে ফিরতে পারেনি লাখ লাখ মানুষ। মেরামত হয়নি বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধগুলো, যেখানে আগে ছিল ৩০-৪০ ফুট উঁচু বাঁধ, সেখানে এখন ৪০-৫০ ফুট গভীর খাল। খাল দিয়ে জোয়ারের লোনা পানি ঢুকে প্লাবিত করছে বিস্তীর্ণ এলাকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রেই জানা যায়, মৃতের সংখ্যা দেড় শতাধিক। চার লাখ ৪৬ হাজার মানুষকে আইলার আগে-পরে সরিয়ে আনা হয়েছিল। ৫০ লাখ মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তিন লাখ ২৩ হাজার একর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেড় লাখ গবাদিপশু মারা গেছে। ৭০ শতাংশ চিংড়িঘের নষ্ট হয়েছে। এসবের ফলে প্রতিটি পরিবারের স্বাভাবিক আয় নেমে এসেছে অর্ধেকে। প্রায় ৬০ হাজার মানুষ কাজের খোঁজে এলাকা ছেড়েছে। ১৬৬ কিলোমিটার উপকূলীয় বেড়িবাঁধ পুরোপুরি বা আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। সবচেয়ে অবাক কথা, এখনও সরকারিভাবে দুর্গতদের তালিকা তৈরির কাজ শেষ হয়নি। ফলে সরকারের সাহায্যপ্রাপ্তির অবস্থা সহজেই অনুমেয়। আইলা আঘাত হানার চার মাস পর সরকার ঋণদাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকে সাত হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা চেয়েছিল বেড়িবাঁধ মেরামত ও ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের জন্য। এখন পর্যন্ত সেই ‘উন্নয়ন সহযোগী’দের কাছ থেকে যে তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি সেটা খাদ্যমন্ত্রীর কথা থেকে বোঝা যায়। বিদেশিদের কাছে আইলা এখন ‘ভুলে যাওয়া দুর্যোগ’। ভারত সরকারও তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতি রাখেনি। সিডর বিধ্বস্তদের ১৬শ’ পরিবারকে বাড়ি বানিয়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েও একটি ঘরও তৈরি হয়নি। বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকাও ভিন্ন নয়। নির্বাচনের আগে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সেখানে গেলেও পরে আর মনে রাখেননি দুর্গত মানুষের কথা। কয়েকজন মন্ত্রী-এমপির দেয়া আশ্বাস বাতাসে মিলিয়ে গেছে। পানিসম্পদমন্ত্রীর কথামত গত ডিসেম্বরে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামতের কথা থাকলেও এখনও তা শুরুই হয়নি বলে জানা গেছে।
আইলা-সিডরের আগে ১৯৯১ ও ১৯৮৮ সালের ঘূর্ণিঝড়ের বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠা গেলেও এখনকার বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না উপকূলীয় মানুষের পক্ষে। বর্তমান সরকারের অবহেলা মানুষকে হতবাক করেছে। তাদের মনে ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করি ঘূর্ণিঝড়-সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের পর উপকূলীয় মানুষের প্রতি পাকিস্তান সরকারের অবহেলার কথা জেগে ওঠা স্বাভাবিক, যার জবাব তারা দিয়েছিলেন ভোটের মাধ্যমে। আজকের আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সম্ভবত তা ভুলে গেছেন। মহাজোট সরকারের একই ধরনের অবহেলার জবাব তেমনই হলে বলার কিছু থাকবে না।

No comments

Powered by Blogger.