স্মরণ-শিল্পী এম মহিউদ্দিন by মফিজ ইমাম মিলন

শতাব্দীর বাগানে প্রস্ফুটিত একটি কুসুম হতে পারতেন তিনি, যদি আরো কয়েকটি বছর জীবিত থাকতেন। স্বভাব-আচরণে, চলনে-বলনে, ব্যবহারে মাধুর্যের এক স্বতঃস্ফূর্ত উৎস তিনি। তাঁর মতো এমন মধুর কথার মানুষ খুব কমই দেখেছি।
তিনি আপন-পর, আত্মীয়-অনাত্মীয়, ধনী-নির্ধন বিবেচনা না করে স্নেহের দুই হাত প্রসারিত করে সবাইকে কাছে ডেকেছেন; শহর থেকে শুরু করে অজপাড়াগাঁয়ের লোক- সবাই এক সম্মোহনী আকর্ষণে ছুটে গেছে তাঁর কাছে। বলছি চিত্রশিল্পী মুন্সি মহিউদ্দিনের কথা। ফরিদপুরের গর্বের সন্তান চিত্রশিল্পী ছাড়াও বৈচিত্র্যপিপাসু শিল্পী মুন্সি মহিউদ্দিন। তাঁর বিচরণক্ষেত্র কবিতা, উপন্যাস, নাটক, চলচ্চিত্র নির্মাণ ও সাংবাদিকতা পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল। ষাটের দশকের প্রখ্যাত রাজনৈতিক বক্তা এম মহিউদ্দিন। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দি হন। বন্দিদশার সেই নির্যাতনের চিহ্ন বহন করে বেড়িয়েছেন ১৯৯৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।
শিল্পী কামরুল হাসানের মতো পটুয়া চিত্রের লোকজ ঐতিহ্যের নিবিষ্ট অনুসারী ছিলেন মহিউদ্দিন। তিনি উপমহাদেশের প্রাচীন হরপ্পা প্রত্নতাত্তি্বক আবিষ্কার, অজন্তার গুহাচিত্র ও ময়নামতির ফলক থেকে উপাদান দিয়ে লোকজ অনুষঙ্গ তৈরি করেছেন। যে কেউ সহজেই তাঁর চিত্রশিল্পে ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সমন্বয় খুঁজে পেয়েছেন। ১৯৭২ সালে ভারতের সাপ্তাহিক 'দেশ' পত্রিকায় শিল্পী মহিউদ্দিন সম্পর্কে একটি মূল্যায়ন করা হয়েছিল : 'রংতুলি বা ব্রাশের সাহায্যে আপন বক্তব্যটুকু প্রকাশ করাই শিল্পীর ধর্ম। বেশির ভাগ শিল্পী বিভিন্ন অঙ্কনরীতি অবলম্বন করে তাঁদের বক্তব্য ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। অনেকে আবার অঙ্কনরীতির চেয়ে চিন্তাধারার ওপর প্রাধান্য দেন।'
মহিউদ্দিনের জন্ম ১৯৪৩ সালের ১৪ এপ্রিল। ফরিদপুর জিলা স্কুল থেকে ১৯৫৯ সালে ম্যাট্রিক, ১৯৬২তে সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ থেকে আইএসসি এবং ১৯৬৭তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় থেকে বিএফএ ডিগ্রি নেন তিনি। ১৯৬৮ সালে ঢাকা জাদুঘরের অধীনে আইকনোগ্রাফি কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৭৮ সালে ভারতের বোম্বে মহানগরীতে চলচ্চিত্র নির্মাণ ও লোকস্ট অডিওভিজুয়াল ম্যাটেরিয়াল তৈরির ওপর প্রশিক্ষণ নেন।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এম মহিউদ্দিনের নিজস্ব বিজ্ঞাপনী সংস্থা পদ্মা অ্যাডভারটাইজার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ব্যবসা পরিচালনা করেছেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত পরিবার পরিকল্পনা সমিতিতে সহযোগী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকা বেতারের সুখী পরিবার অনুষ্ঠানের সংগঠক ও নির্দেশক হিসেবে ১৯৭২ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে ১৯৬৮ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বেতারের শিল্পীসংক্রান্ত একক কথক হিসেবে অংশ নেন। ১৯৯১ সালে শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার হিসেবে জাতীয় পুরস্কারে সম্মানিত হন 'পদ্মা মেঘনা যমুনা' ছবির কাহিনীকার হিসেবে। এম মহিউদ্দিনের শিল্প সংগ্রহ রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মা, জাতীয় জাদুঘর, রাষ্ট্রীয় ব্যাংক-বীমা কার্যালয়ে এবং বিভিন্ন শিল্প সংগ্রাহক ও শৌখিন শিল্পরসিকদের সংগ্রহে আছে।
লেখক-সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত একবার লিখেছিলেন, শিল্পী মহিউদ্দিনের ছবির ভাষা সোচ্চার হৃদয় যন্ত্রণাদগ্ধ, আশা যেখানে আর্তনাদ করে উঠেছে।
মফিজ ইমাম মিলন

No comments

Powered by Blogger.