সাক্ষাৎকার-স্বল্পোন্নত দেশের জন্য প্রয়োজন শর্তহীন সহায়তা by ড. মহিউদ্দিন আহমদ

সাক্ষাৎকার গ্রহণ :সুভাষ সাহা ড. মহিউদ্দিন আহমদ একাধারে শিক্ষাবিদ, গবেষক, লেখক, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নাগরিক আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক। একসময় সিউলের সংকোংহে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব এনজিও স্টাডিজের ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন।
বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়া দারিদ্র্য দূরীকরণ অ্যালায়েন্সের বোর্ড সদস্য, পিপলস সার্কের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে বেশ কয়েকটি জাতিসংঘ সম্মেলনে যোগদান করেন তিনি। ৯-১৩ মে ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিতব্য জাতিসংঘ আয়োজিত স্বল্পোন্নত দেশগুলোর চতুর্থ সম্মেলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সিভিল সোসাইটি ফোরামের অন্যতম উদ্যোক্তা ও এ সম্মেলন উপলক্ষে রচিত নাগরিক সমাজের বৈশ্বিক প্রতিবেদনের অন্যতম রচয়িতা। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর নাগরিক সমাজের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক 'এলডিসি ওয়াচ'-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ছয়টি উপন্যাসসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় এবং গবেষণাধর্মী তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩৬


সমকাল :আপনি দীর্ঘদিন বৈশ্বিক নাগরিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। এ সম্পর্কে কিছু বলবেন?
মহিউদ্দিন আহমদ : হ্যাঁ, জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক স্তরে বিভিন্ন নাগরিক উদ্যোগ-আন্দোলনের সঙ্গে আমি জড়িত। এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর দারিদ্র্র্য ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাধাগুলো চিহ্নিত করার জন্য কাজ করছি। এ প্রসঙ্গে বিশ্বের ৪৯টি স্বল্পোন্নত দেশের নাগরিক সমাজের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক এলডিসি ওয়াচের কথা উল্লেখ করা যায়। আমি আন্তর্জাতিক এ সংস্থার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। এর সচিবালয় রয়েছে কাঠমান্ডুতে। বস্তুত স্বল্পোন্নত দেশগুলো অনুন্নয়নের বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে তেমন দৃষ্টান্ত দীর্ঘ সময়েও স্থাপন করতে পারেনি বলে আন্তর্জাতিক স্তরে নাগরিক সমাজ এ বিষয়টি অ্যাড্রেস করার প্রয়োজন অনুভব করে। কেবল এলডিসির অন্তর্গত দেশগুলোর সরকারগুলোর প্রচেষ্টায় এই বৃত্ত ভাঙা সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থার বৈষম্যমূলক ও একপেশে নীতির পরিবর্তন না করে যে তা একপ্রকার অসম্ভব, তা আমাদের প্রাথমিক অনুসন্ধানেই ধরা পড়ে।
সমকাল :এলডিসি ওয়াচের কাজ কী?
মহিউদ্দিন আহমদ : সংস্থাটির কাজ হচ্ছে সরকার ও দাতা সংস্থাগুলোর কর্মকাণ্ডের পর্যালোচনা করা, অসঙ্গতি থেকে থাকলে সেগুলোকে চিহ্নিত করা এবং টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে জোরালো মতামত ও সুপারিশ তুলে ধরা।
সমকাল :এবার কোন প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য আয়োজিত চতুর্থ সম্মেলন?
মহিউদ্দিন আহমদ :সত্তরের দশকে বিশ্বে স্বল্পোন্নত দেশের সংখ্যা ছিল ২৪টি। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৯টিতে। ৪০ বছরে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে মাত্র তিনটি দেশ এই অনুন্নয়নের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। পক্ষান্তরে এর থেকে অনেক বেশিসংখ্যক দেশ স্বল্পোন্নত সারিতে নেমে গেছে। তাহলে এই দেশগুলোর সরকারের উন্নয়নের পথপরিক্রমা ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুদানের নিট ফলাফল কী দাঁড়াল?
স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মোট জনসংখ্যা এখন ৮৮ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। এদের ৭০ শতাংশের মাথাপিছু গড় আয় দুই ডলারের নিচে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর অন্তত অর্ধেক ২০১৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্যসীমার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসবে_ এটাই ছিল সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্যতম। এ ছাড়া সবাই অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন যে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সব শিশু বিদ্যালয়ে যাবে, বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার ব্যাপারে লিঙ্গ সমতা আসবে, সবাই নিরাপদ পানীয় জল ও স্যানিটেশন সুবিধা পাবে এবং শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসবে। কিন্তু বাস্তবে বেশিরভাগ এলডিসিতেই এই লক্ষ্যগুলো নিকট ভবিষ্যতেও অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
অন্যদিকে দাতা দেশ ও সংস্থাগুলো সাহায্যের নামে তাদের লুণ্ঠন প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। স্বল্পোন্নত দেশগুলো প্রতিবছর ঋণের সুদ হিসেবে ছয়শ' কোটি ডলার শোধ দিতে বাধ্য হয়। বাণিজ্যের ভারসাম্য ধনী দেশগুলোর অনুকূলে। তদুপরি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো দেখা দিয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত। গুটিকয় শিল্পোন্নত দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বিলাসী জীবনযাত্রার জন্য দরিদ্র দেশগুলো নানা রকমের সমস্যা ও দুর্যোগের শিকার হচ্ছে।
প্রতি দশ বছর পর জাতিসংঘ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য বৈশ্বিক সম্মেলন আয়োজন করে বেশ ঘটা করে। ২০০১ সালে ব্রাসেলসে জাতিসংঘের এ বিষয়ে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সম্মেলনে অনেক কিছুর অঙ্গীকার করা হয়েছিল। এর লক্ষ্য ছিল বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য হ্রাস করা। কিন্তু অঙ্গীকারের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। কাজের কাজ তেমন কিছুই হয়নি। দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী সমর্থন মেলেনি। অন্যদিকে অধিকাংশ স্বল্পোন্নত দেশে উন্নয়নের বদলে দেখা গেছে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর দুর্নীতি, লুটপাট, স্বেচ্ছাচারিতা। এ ছাড়াও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে অনেক দেশ জর্জরিত হচ্ছে। কোনো কোনো দেশ গৃহযুদ্ধে বিদীর্ণ হচ্ছে, যেমন_ সিয়েরালিওন, আইভরি কোস্ট, কঙ্গো, ইয়েমেন ইত্যাদি। এই পটভূমিতে আগামী মে মাসের ৯ থেকে ১৩ তারিখ তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য জাতিসংঘের চতুর্থ সম্মেলন।
সমকাল :এপ্রিলে এ ব্যাপারে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভাপতির আমন্ত্রণে আপনি নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে শুনানিতে অংশ নিয়েছিলেন। সে সময় প্রস্তুতকৃত বিশ্ব নাগরিক সমাজের খসড়াটিও আপনার প্রস্তুত করা। এ সম্পর্কে কিছু বলুন।
মহিউদ্দিন আহমদ :১ এপ্রিল জাতিসংঘ সদর দফতরে সাধারণ পরিষদের সভাপতি বিশ্ব নাগরিক সমাজের একটি শুনানি আহ্বান করেন। শুনানিতে অংশ নেন স্বল্পোন্নত দেশগুলোর নাগরিক সমাজের ২০ জন প্রতিনিধি। বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে আমিই সেখানে প্রতিনিধিত্ব করি। সেখানে আমার বক্তব্য ছিল_ পৃথিবী আজ বর্ণাশ্রমে বিভক্ত। কেউ কুলীন, কেউ অচ্ছুত। কেউ উন্নত, কেউ উন্নয়নশীল, আবার কেউ স্বল্পোন্নত। এই বিভাজন মানবসৃষ্ট। উপনিবেশবাদের ফল। এটা মেনে নেওয়া যায় না। আমি দরিদ্র্র কেন এ প্রশ্ন এখানে অবান্তর। বরং প্রশ্নটিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যাক। তোমরা এত ধনী কেন? তোমাদের প্রাচুর্য ও অপচয়মূলক ভোগবাদ বজায় রাখার জন্য পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষকে দরিদ্র থাকতে হয়, দারিদ্র্যের চাষ করতে হয়। এই দারিদ্র্যই সহিংসতার জন্ম দেয়। আবার এই সহিংসতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় অনুন্নত দেশ এবং সেখানে বসবাসকারী মানুষ।
আমি বলি, দারিদ্র্যের লক্ষণগুলো চিহ্নিত করলেই কেবল হবে না, এর মূলে যেতে হবে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের চেয়েও এখন বেশি প্রয়োজন হচ্ছে দারিদ্র্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। আর এ জন্য বিশ্বের সব সংবেদনশীল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বিরাজমান আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও সমীকরণ পাল্টে দিতে হবে। এই পৃথিবীতে স্বল্পোন্নত দেশ বলে কিছু থাকবে না, সবাইকে এই অঙ্গীকার করতে হবে।
এ ছাড়া শুনানিতে বিশ্ব নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন পেশ করা হয়। বৈশ্বিক নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে এটিও আমিই উপস্থাপন করি।
সমকাল :আপনাদের পরবর্তী কার্যক্রম কী?
মহিউদ্দিন আহমদ :আপাতত আমাদের কার্যক্রম আসন্ন জাতিসংঘ ইস্তাম্বুল সম্মেলনকে ঘিরেই পরিচালিত হচ্ছে। আমি বিস্তারিত আকারে নাগরিক সমাজের বৈশ্বিক রিপোর্ট প্রস্তুত করছি। রিপোর্টটি ইস্তাম্বুল সম্মেলনে প্রকাশ করা হবে। জাতিসংঘ সম্মেলনের ঠিক আগে ৭-৮ মে ইস্তাম্বুলে বিশ্ব নাগরিক সমাজের একটি ফোরাম অনুষ্ঠিত হবে। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন এই ফোরামের উদ্বোধন করবেন। ফোরামে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে নাগরিক সমাজের দুই হাজার প্রতিনিধি অংশ নেবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এর আন্তর্জাতিক উদ্যোক্তা সংস্থা হলো এলডিসি ওয়াচ। আমি সংস্থাটির স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য।
সমকাল :এর বাইরে জনমত গঠনে আপনাদের আর কোনো কর্মসূচি রয়েছে কি-না।
মহিউদ্দিন আহমদ :অনেক স্বল্পোন্নত দেশে আমরা জাতীয় কর্মশালার আয়োজন করি। বাংলাদেশে সর্বশেষ কর্মশালাটি অনুষ্ঠিত হয় গত ২৮ ডিসেম্বর সিরডাপ মিলনায়তনে। সেখানে ব্রাসেলস প্রোগ্রাম অব অ্যাকশন এবং সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার পর্যালোচনামূলক একটি প্রতিবেদন আমি উপস্থাপন করি। কর্মশালাটির আয়োজক ছিল সুপ্র। এ ছাড়া এলডিসি ওয়াচের উদ্যোগে তিনটি আঞ্চলিক সম্মেলনও আয়োজন করা হয়। আফ্রিকার জন্য আদ্দিস আবাবায়, এশিয়ার জন্য ব্যাংককে ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য ভানুয়াতুতে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
এ জন্য বিশ্বের নাগরিক সমাজকে সোচ্চার হওয়া এবং এ ব্যাপারে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য উপস্থাপন ও জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সামনে সমস্যা সমাধানের দিকনির্দেশনা তুলে ধরা অথবা কখনও কখনও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে এই লক্ষ্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে সংশ্লিষ্ট সরকার এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ওপর চাপ প্রয়োগ করা আন্তর্জাতিক নাগরিক সমাজের কাজ।
সমকাল :অনুন্নত দেশের অনুন্নয়নের বৃত্ত ভাঙার ব্যাপারে নাগরিক সমাজের ভূমিকা ব্যাখ্যা করুন।
মহিউদ্দিন আহমদ :জনগণকেন্দ্রিক উন্নয়নের জন্য বিস্তৃত মালিকানা ও দায়দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেওয়ার মানসিকতা গড়ে তোলার জন্য নাগরিক সমাজ ও বেসরকারি স্টেকহোল্ডারদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। মানবাধিকারের প্রতি যথার্থ স্বীকৃতির মাধ্যমে এটা হতে পারে। বিশেষভাবে সমাজের যেসব অংশের অধিকার ধারাবাহিকভাবে খর্ব করা হয়েছে_ সেই নারী, আদিবাসী মানুষ, শিশু ও সংখ্যালঘুদের অধিকারকের পূর্ণ স্বীকৃতি দিতে হবে। উন্নয়ননীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এদের পূর্ণ অংশগ্রহণের দাবিকে জোরের সঙ্গে তুলে ধরার দায়িত্ব নাগরিক সমাজের।
তবে অনুন্নত দেশগুলোর সরকারকেও এ ব্যাপারে নাগরিক সমাজের ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে বলে স্বীকার করতে হবে। সমানভাবে জাতিসংঘ ও অন্যান্য বহুপক্ষীয় সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও নাগরিক সমাজের এ ব্যাপারে আরও কার্যকরভাবে অংশগ্রহণের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। শুধু পর্যবেক্ষ হিসেবে নাগরিক সমাজের টোকেন অংশগ্রহণ দিয়ে অর্থবহ ফল লাভ সম্ভব হবে না। এখানে বহুপক্ষীয় সংস্থা বা আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে নাগরিক সমাজের সম্পর্ক হতে হবে পারস্পরিক দায়িত্ব ও সম্মানের।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মানবের ভবিষ্যৎকে বিপদগ্রস্তকারী দারিদ্র্য দূরীকরণের ব্যাপারে অবশ্যই একটি ঐকমত্যে পেঁৗছাতে হবে। দারিদ্র্য দূরীকরণ অবশ্যই আমাদের সময়ের সবচেয়ে জরুরি কাজ। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সব স্টেকহোল্ডারের অংশগ্রহণ থাকলে এলডিসি প্রোগ্রাম অব অ্যাকশন অর্জনযোগ্য। স্বল্পোন্নত দেশগুলো নিজেরা এই বিশাল কাজ সম্পন্ন করতে পারবে না। এ জন্য তাদের একটা পরিপূরক বৈশ্বিক পরিবেশ দরকার। উত্তরের শিল্পোন্নত দেশগুলোকেই সেই পরিবেশ করে দিতে হবে।
অনুন্নত দেশগুলোয় নিজ নিজ দেশে নাগরিকদের জীবন-জীবিকার সঙ্গে সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সব নাগরিকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তাদের গণতান্ত্রিক ও ন্যায্য শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
এভাবেই স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে তাদের অনুন্নয়নের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে পুরনো তকমা ঝেড়ে ফেলতে হবে এবং এই লক্ষ্যার্জনের জন্য মেকানিজম ও সুস্পষ্ট ভিশন থাকতে হবে তাদের।
সমকাল :উন্নত দেশগুলো অনুন্নত দেশগুলোর প্রতি যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে?
মহিউদ্দিন আহমদ :মধ্যম পর্যায়ের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য উন্নত দেশগুলো অনুন্নত দেশগুলোর জন্য তাদের গড় জাতীয় আয়ের দশমিক ৭ শতাংশ ব্যয় করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং জাতিসংঘ তথা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উন্নত দেশগুলোর এই অঙ্গীকারের ওপর আস্থা স্থাপন করেছিল। কিন্তু প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায়, তারা তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করেনি। উন্নত দেশগুলো তাদের বৈদেশিক নীতি ও নিরাপত্তানীতির সঙ্গে এসব সাহায্যকে যুক্ত করে দিয়ে এখানে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি করেছে। এভাবে এসব সাহায্যকে প্রকারান্তরে শর্তযুক্ত করে ফেলা হয়েছে। তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ, বাণিজ্য সুবিধা অর্জন ও কৌশলগত স্বার্থ এ ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য বিষয় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সেখানে এগুলো অনেক ক্ষেত্রেই আর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী উন্নয়ন সাহায্য গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি।
এখন সাহায্যের নতুন উৎসের কথা বিভিন্নভাবে বলা হচ্ছে। দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা ও ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতা এগুলোর মধ্যে অন্যতম। দক্ষিণের অনেক দেশ বিশেষ করে জায়মান অর্থনীতিগুলো এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। কিন্তু এটাকে দেখিয়ে ওইসিডি দেশগুলো অনুন্নত দেশগুলোর প্রতি তাদের দেওয়া অঙ্গীকারকে বিস্মৃত হতে পারে না। উন্নত দেশগুলোর অনুন্নত দেশগুলোকে প্রদত্ত সাহায্যের পরিমাণ ইতিমধ্যেই হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে অনুন্নত দেশগুলো খাদ্য ও জ্বালানিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির চাপের মধ্যে পড়ে এখন হাঁসফাঁস করছে। এসব দেশের অনেকগুলোর অর্থনীতির জন্য অতি প্রয়োজনীয় অনাবাসী নাগরিকদের অর্জিত আয়ও হ্রাস পেয়েছে বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট ও মধ্যপ্রাচ্যে চরম অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে। এ অবস্থায় ওইসিডি দেশগুলোর স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য প্রতিশ্রুত সাহায্য শর্তহীনভাবে প্রদান তাদের টেকসই উন্নয়ন ও দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য অতীব প্রয়োজন।
সমকাল :এবার ইস্তাম্বুল সম্মেলন থেকে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর উন্নতির জন্য নাগরিক সমাজের প্রত্যাশা কী?
মহিউদ্দিন আহমদ :বৈশ্বিক নাগরিক সমাজ চায় উন্নয়ননীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে লক্ষণীয় পরিবর্তন। এর অর্থ হলো আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ে যে অসম অংশীদারিত্ব ও অসম পাওয়ার রিলেশনস রয়েছে তার পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক উন্নয়ননীতিকে সংশোধন করা। নাগরিক সমাজ চায় স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য ন্যায্য বাণিজ্য, দেনা হ্রাস ও বাতিলকরণ; স্বল্পোন্নত দেশের জন্য দেওয়া সাহায্যকে প্রকৃত অর্থেই শর্তহীন করা; সব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসন নিশ্চিত করা।
সমকাল :স্বল্পোন্নত দেশগুলোর দারিদ্র্য দূরীকরণ ও উন্নয়নের ব্যাপারে নাগরিক সমাজের ভূমিকা বৃদ্ধি করা বলতে আপনারা কী বোঝাতে চান?
মহিউদ্দিন আহমদ :বৈশ্বিক নাগরিক সমাজ জাতিসংঘের কর্মসূচিতে কেবল পর্যবেক্ষকের মর্যাদা নিয়ে উল্লেখযোগ্য ও অর্থবহ অবদান রাখতে পারে না বলে আমরা মনে করি। জাতিসংঘ ব্যবস্থা ও কার্যপ্রণালিতে বৈশ্বিক নাগরিক সমাজ পূর্ণ মর্যাদা নিয়ে অংশগ্রহণ করতে চায়। এই লক্ষ্য অর্জিত হলে, নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলো ইস্তাম্বুল প্রোগ্রাম অব অ্যাকশনের বাস্তবায়ন, মনিটরিং ও রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে কার্যকরভাবে ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে।
 

No comments

Powered by Blogger.