কালের পুরাণ- জামায়াত ছাড়ুন, স্বৈরাচার ছাড়ুন by সোহরাব হাসান

অনেকেই বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ঐক্য বা সমঝোতা হতে পারে না। খুবই পারে। ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করেই তারা স্বৈরাচারী এরশাদের পতন ঘটিয়েছিল। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও দুই দলের মধ্যে একটি অলিখিত বোঝাপড়া হয়েছিল; নির্বাচন দিতে হবে।
গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলো। তার পরই এ দুটি দল কেন মুখোমুখি অবস্থানে, একে অপরের মুখ দেখে না। কারণ, ক্ষমতা। প্রধানমন্ত্রীর পদ একটি। দুই নেত্রীর কেউ নিজেকে প্রধানমন্ত্রী পদের বাইরে দেখতে চান না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা ব্যক্তিগত আলাপে ঐক্য ও সমঝোতার কথা বলেন। শান্তির কথা বলেন। সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতেও সৌহার্দ্যের ভাব লক্ষ করা যায়। কিন্তু দলীয় ফোরামে নেত্রীদের ভয়ে বলেন ভিন্ন কথা। সংসদে বিরোধী দলের সদস্যরা যান না, তাই সেখানে বিতর্কেরও সুযোগ নেই। তবে বেতন-ভাতা ও শুল্কমুক্ত গাড়ি তাঁরা ঠিকই নেন।
এই যে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের মধ্যে তীব্র রেষারেষি, মুখ দেখাদেখি বন্ধ, এর মৌলিক কারণ—ক্ষমতা। এক পক্ষ ক্ষমতায় থাকতে চায়। সে কারণে তারা প্রধান যে প্রতিদ্বন্দ্বী, তাকে যেকোনো মূল্যে ঘায়েল করে থাকে। আরেক পক্ষ ক্ষমতায় যেতে চায়। স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতাসীনদের তাঁরা পথের কাঁটা ভাবেন। যেকোনো উপায়ে সরকারকে হটিয়ে দিতে বিরোধী দল মরিয়া। দুই পক্ষই টনকে টন বাক্যবোমা ছুড়ছে এবং প্রায়ই তা শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। শীর্ষস্থানীয় নেতা-নেত্রীদের মুখ থেকে এমন বাক্য নিঃসৃত হচ্ছে, যা শুনে অনেক সময় কানে আঙুল দিতে হয়।
রাজনীতিতে লড়াইটা হবে আদর্শের ভিত্তিতে, নীতি ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে। কিন্তু অধুনা লড়াইয়ের সেসব উপাদান পেছনে ফেলে ব্যক্তিগত কুৎসা, হিংসা ও বিদ্বেষ প্রধান হয়ে উঠেছে। রাজনীতিকদের একটু হিসাব-নিকাশ করে কথা বলতে হয়। আধুনিক প্রযুক্তির যুগে তাঁদের কোনো কথাই আর গোপন রাখা যায় না। আগে মানুষ সংবাদপত্রের পাতায় নেতা-নেত্রীদের বক্তৃতা-বিবৃতি পড়তেন। এখন টেলিভিশনে সরাসরি দেখছেন। সে ক্ষেত্রে নেতা-নেত্রীদের এমন ভাষা ব্যবহার করা উচিত নয়, যাতে ভদ্রলোকদের টেলিভিশন বন্ধ করে দিতে হয়। কিংবা ছোটরা নেতা-নেত্রীদের কথার অর্থ জানতে চাইলে বড়দের বিব্রত হতে হয়। যখন কোনো শিশু জিজ্ঞেস করে, ‘বাবা, তেল মারা কী?’ কিংবা যদি শিশুটি বাবাকে জিজ্ঞেস করে, ‘সরকারের টপ টু বটম চোর’ কথার মানে কী? অথবা ‘কান টানলে মাথা আসে’—মাথাটি কার? জিজ্ঞেস করলে বাবা কী উত্তর দেবেন?
বাংলাদেশে একসময় দুর্ভিক্ষ ছিল। ১৯৭৪ সালে মানুষ না খেয়ে মারা গেছে। এখন কেউ না খেয়ে মারা যায় না। অর্থাৎ মানুষের চাহিদা মেটানোর মতো চাল দেশেই উৎপন্ন হয়। কিন্তু এখন রাজনীতিতে রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে। দেশে খাদ্যঘাটতি থাকলে বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করে সে দুর্ভিক্ষ ঠেকানো যায়। কিন্তু রুচি ও সংস্কৃতির এ দুর্ভিক্ষ কীভাবে ঠেকানো যাবে? নেতা-নেত্রীদের কাছ থেকে নতুন প্রজন্ম কী শিখবে?
আমরা হত্যার বিচার করব, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেব, কিন্তু হিংসা ছড়াব না। প্রতিহিংসার আগুনে তরুণদের লেলিয়ে দেব না। এক হাতে শান্তির পতাকা, অন্য হাতে বিষের ছুরি নিয়ে ঘুরব না।

২.
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীরা ইদানীং বিএনপির প্রতি উপদেশের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, জামায়াতে ইসলামীকে ছেড়ে আসুন, তাহলে আপনাদের সঙ্গে সংলাপ তথা রাজনৈতিক সমঝোতা সম্ভব। দলের প্রবীণ নেতা আমির হোসেন আমু সম্প্রতি এক সমাবেশে আরেক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, ‘বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের ঐক্য হতে পারে। দল দুটি একসঙ্গে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করে বিজয়ীও হয়েছে। কিন্তু একাত্তরে যারা মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করেছে, মা-বোনদের ইজ্জত নিয়েছে, তাদের সঙ্গে ঐক্য হতে পারে না।’
আওয়ামী লীগের নেতারা খুবই হক কথা বলছেন। প্রশ্ন হলো, বিএনপির সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতার সূত্র কী হবে? আওয়ামী লীগের নেতারা যদি মৌলবাদী জামায়াতে ইসলামীর একাত্তরের ভূমিকা সামনে রেখে কথাগুলো বলে থাকেন, দেশবাসী অকুণ্ঠচিত্তে সমর্থন জানাবে। কিন্তু যদি আগামী নির্বাচনে ভোটের হিসাব-নিকাশ সামনে রেখে বলেন, তা মোটেই কল্কে পাবে না।
আমাদের জাতীয় জীবনে এমন কিছু বিষয় আছে, যাকে কোনোভাবেই নির্বাচনী রাজনীতির ছকে দেখা উচিত নয়। যেমন, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ। সেই অপরাধের সঙ্গে যারাই জড়িত, তাদের বিচার করতে হবে। জামায়াতে ইসলামী এ বিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, বিচার বন্ধে দেশে-বিদেশে নানা তৎপরতা চালাচ্ছে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত বিএনপি কীভাবে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নেয়? কীভাবে তারা জামায়াতের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে নৈতিক সমর্থন জানায়?
একাত্তর ছিল আমাদের অস্তিত্বের লড়াই। যে অপশক্তি আমাদের অস্তিত্ব ধরে টান দেয়, স্বাধীনতা বিপন্ন করে, সেই অপশক্তিকে কী করে আশকারা দেয় স্বাধীনতার পাহারাদার বলে দাবিদার দলটি? মনে রাখা প্রয়োজন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দলীয় বিষয় নয়। এটি সমগ্র জাতির দাবি।

৩.
স্বাধীনতার পর আরও একবার আমাদের কঠিন লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হয়েছিল। সেটি হলো স্বৈরাচারবিরোধী এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই। বাংলাদেশ-উত্তর প্রজন্ম একাত্তর দেখেনি। কিন্তু নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন দেখেছে, অংশ নিয়েছে। দুই দশক ধরে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ যে গণতন্ত্রের সুবিধা ভোগ করছে, তা-ও সম্ভব হয়েছে স্বৈরাচারী শাসকের পতনের কারণে।
একাত্তরে জামায়াতে ইসলামী নামের দলটি স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল, মানবতাকে হত্যা করেছিল। সে কারণে আমরা তাদের ঘৃণা করি। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আজ সেই দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতারা বিচারের সম্মুখীন। জামায়াত যতই ষড়যন্ত্র করুক, বিচার ঠেকাতে পারবে না। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, সংবিধানকে পদদলিত করে যে স্বৈরশাসক দেশ ও জনগণের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিল, আমরা তার বিচার করতে পারিনি। অথচ, তার বিচারের ব্যাপারে দুই দলই অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল। এ কারণেই আজ সাবেক স্বৈরশাসক এরশাদ দেশবাসীকে গণতন্ত্র সম্পর্কে হেদায়েত করার সাহস পাচ্ছেন। তাঁর পতনের দিনটিকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা দিবস পালনের ধৃষ্টতা দেখাচ্ছেন।
এরশাদ এখন দুই দলের সঙ্গেই খেলছেন। তাঁর দলের একাংশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্য গড়তে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করলেও অপরাংশ বিএনপির সঙ্গে জোট বাধতে তৎপর। তাই আগামী নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে এই বলে কড়ার করতে হবে যে আগামী নির্বাচনে তারা কেউ-ই রাজাকার ও স্বৈরাচারের সঙ্গে জোট বাধবে না। তারপর জনগণই ঠিক করবে, তারা কাকে নির্বাচিত করবে।
বিএনপির ভয়, জামায়াতকে ছেড়ে দিলে আওয়ামী লীগ তার সঙ্গে নির্বাচনী ঐক্য করতে পারে। আওয়ামী লীগের শঙ্কা, এরশাদকে ছেড়ে দিলে বিএনপি তাকে কোলে তুলে নেবে। এ অবিশ্বাস থেকেই বিএনপি জামায়াতের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে নৈতিক সমর্থন দিচ্ছে, আর আওয়ামী লীগ সাবেক স্বৈরাচারের সঙ্গ ছাড়ছে না। এরশাদ আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় যাওয়ার খোয়াব দেখলেও তাঁর পায়ের তলায় মাটি নেই। জাতীয় পার্টির অভেদ্য দুর্গ বলে পরিচিত রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তাঁর সমর্থক প্রার্থীর ভরাডুবি হয়েছে।

৪.
চার বছর পর শেখ হাসিনার সামনেও বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, তিনি কোন পথে যাবেন? সাবেক স্বৈরাচারের সঙ্গে ফের জোট বাধবেন? দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাজাকার ও স্বৈরাচারকে ছাড়তে হবে।
জাতীয় সংসদের সদ্য সমাপ্ত অধিবেশনে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ধর্মীয় রাজনীতি একটি বড় সমস্যা। তাঁর কথার সঙ্গে আমরা শতভাগ সহমত পোষণ করছি। কেবল বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজুড়েই ধর্মীয় রাজনীতি বড় সমস্যা। শেখ হাসিনা যদি সত্যি সত্যি ধর্মীয় রাজনীতিকে বিপদ মনে করেন, তাহলে তাঁর উচিত হবে এই রাজনীতির বাইরের সব মানুষকে সেই আহ্বানে যুক্ত করা। আওয়ামী লীগের বাইরেও মুক্তবুদ্ধি ও চেতনার বহু মানুষ আছে। তাঁদের সঙ্গে নিয়েই অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে এগিয়ে নিতে হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগের মধ্যে একলা চলো নীতিই প্রবল। বিপদে পড়লে দলের নেতারা ঐক্যের উদাত্ত আহ্বান জানান, বিপদ কেটে গেলে কাউকে চেনেন না, পাত্তা দেন না।
ইদানীং আওয়ামী লীগের মধ্যে আরেকটি বিপজ্জনক প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। পরিত্যক্ত নেতারা নড়াচড়া শুরু করেছেন। ঢাকা শহরেও বিভিন্ন বিতর্কিত নেতার নামে ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টার শোভা পাচ্ছে। কেউ নিজেকে ঢাকা সিটি করপোরেশনের ভবিষ্যৎ মেয়র বলে দাবি করছেন। নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমান সাংবাদিকদের গুষ্টিসুদ্ধ শেষ করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। শেখ হাসিনা কি পারবেন, এই হুমকিদাতা, চাঁদাবাজ, কমিশনবাজদের বাদ দিয়ে সৎ ও ত্যাগী নেতা-কর্মীদের বেছে নিতে?
যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় আওয়ামী লীগ জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছে। সবাইকে একত্র হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। তাদের এই আহ্বান ন্যায়সংগত। কিন্তু যেসব দল, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়েছে, পরবর্তীকালে তারাই যে রাজপথে আওয়ামী লীগারদের হাতে লাঞ্ছিত হবে না, তারই নিশ্চয়তা কী? ১৮ ডিসেম্বরে শান্তিপূর্ণ হরতাল পালন করায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বামপন্থী দলগুলোকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু এই বামপন্থীরা যখন তেল-গ্যাস রক্ষার দাবিতে আন্দোলন করে, তখন তাঁর এই অহিংস পুলিশই সহিংস হয়ে ওঠে।
মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চি একবার লিখেছিলেন, ক্ষমতার লোভ নয়, মানুষকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে ভয়। ক্ষমতা যারা ভোগ করে, তারা তা হারানোর ভয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, আর যারা ক্ষমতা ব্যবহারের শিকার হয়, তারা দুর্নীতির আশ্রয় নেয় ক্ষমতার মার থেকে নিজেদের বাঁচাতে।
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল একবার আয়নায় নিজেদের মুখটি দেখে নিতে পারে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.