নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে সমঝোতার জন্য চাপ বাড়ছে- দেশী-বিদেশী সব মহলই চায় বড় দুই দলের সংলাপ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ নির্বাচনকালীন সরকার গঠনে সমঝোতায় আসতে বড় দলগুলোর ওপর নানামুখী চাপ বাড়ছে। প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক দেশগুলোর পাশাপাশি দেশের সকল মহলও ‘আগামী নির্বাচন কার অধীনে হবে’ এ নিয়ে বড় দুই দলের মধ্যে সৃষ্ট বিরোধ সংলাপের মাধ্যমে নিষ্পত্তি চাইছে।
কিছুটা ছাড় দিয়ে মাঝামাঝি কোন বিকল্প প্রস্তাবের ভিত্তিতে সমঝোতায় আসতে বড় দুই দলের নেতারাও এখন নমনীয় অবস্থানে। সবাই একমত, দেশের দুই শীর্ষ নেত্রীর মধ্যে ঐকমত্য হলে সঙ্কট নিরসনে একটি ফর্মুলা বের করা কঠিন নয়। নানামুখী চাপে বড় দুই দলই সংলাপে আগ্রহ প্রকাশ করলেও কখন, কী ভাবে এবং কে নেবে সংলাপের উদ্যোগ এ নিয়ে জনমনে সৃষ্ট প্রশ্নের এখনও সদুত্তর মেলেনি।
রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে মুখে বললেও অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতায় যতই দিন যাচ্ছে কোন পক্ষই চাইছে না আবার ফিরে আসুক বহুল আলোচিত-সমালোচিত তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা। সবাই চাইছে সংলাপের ভিত্তিতে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কোন বিকল্প প্রস্তাব উদ্ভাবনের। সংশয়-দ্বিধা কাটিয়ে ক্রমশ সবাই আশাবাদী হয়ে উঠছে সংলাপের মাধ্যমে এ ইস্যুতে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান হবে। সবার অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হবে আগামী জাতীয় নির্বাচন। বড় দুই দলের হাইকমান্ডের পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও মনে করেন, নির্বাচনী সরকার গঠন নিয়ে সমঝোতায় আলোচনা কিংবা সংলাপের কোন বিকল্প নেই। দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে কণ্টকমুক্ত রাখতে চাইলে বড় দুই দলকে এ নিয়ে সংলাপে আসতেই হবে।
নির্বাচনের বাকি আর এক বছর। রাজনৈতিক দলগুলোতে ইতোমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে নির্বাচনী আমেজ। দুই প্রধান নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া নিজ নিজ সমাবেশ থেকে প্রকাশ্য জনগণের ভোট প্রার্থনাও শুরু করেছেন। কিন্তু সব দলের অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচন হবে কি না, এ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলসহ দেশের অধিকাংশ মানুষের শঙ্কা এখনও কাটেনি। সবার কাছে একই প্রশ্ন, দুই দলের মধ্যে সমঝোতা না হলে শেষপর্যন্ত আগামী নির্বাচন হবে তো? সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা না হলে অনিবার্য সংঘাত-সংঘর্ষের আবর্তে আবারও কি দেশের ক্ষমতা যাবে তৃতীয় কোন পক্ষের কাছে? এসব প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে।
কার অধীনে অনুষ্ঠিত হবে আগামী নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ এ ইস্যুটি এখন অনিষ্পন্নই রয়ে গেছে। মূল বিতর্ক ‘তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা’ পুনর্বহাল ইস্যুতে কোন দলই এখন আর কঠোর অবস্থানে নেই। ‘নির্দলীয় আর নির্বাচিত’ এই দুটি বাক্য নিয়েই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এখনও বিপরীত মেরুতে। এ নিয়ে সৃষ্ট বিরোধী অবসান এবং সব দলের অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সমঝোতা বা সংলাপে বড় দুই দল সম্মত হলেও উদ্যোগ নেই কোন মহলে।
তত্ত্বাবধায়ক নয়, ‘নির্দলীয় নাকি নির্বাচিত’ কেমন হবে নির্বাচনকালীন অন্তবর্তী সরকার এ বিতর্কেই আটকে আছে দেশের সামগ্রিক রাজনীতি। চলছে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ। মূল ইস্যু ‘তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা’ থেকে সরে এসে ‘নির্দলীয় আর নির্বাচিত’ এই দুটি বাক্য নিয়ে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সৃষ্ট বিরোধের নিষ্পত্তি ঘটাতে হঠাৎ করেই তৎপর হয়ে উঠেছে প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক দেশগুলো। বসে নেই দেশের বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে প্রভাবশালী মহল। সবাই চাইছে কিছুটা ছাড় দিয়ে মাঝামাঝি কোন বিকল্প প্রস্তাবের ভিত্তিতে দু’পক্ষকেই নির্বাচনকালীন সরকার গঠনে সমঝোতায় আনতে। এ নিয়ে সব দিক থেকে চাপ অনুভব করেই সংলাপের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠছে বড় দলগুলো।
আওয়ামী লীগ সব সময়ই বলে আসছে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা প্রণয়নে সংসদে কিংবা বাইরে যে কোন স্থানে তারা বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপে বসতে রাজি। তবে সর্বোচ্চ আদালত থেকে বাতিলকৃত এবং সংবিধান থেকে বাদ দেয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে তারা কোন আলোচনায় বসবে না। এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রীই অন্তবর্তীকালীন সরকারে বিরোধী দলকে অংশীদারিত্বের প্রস্তাব পর্যন্ত দিয়েছেন। এদিকে বিরোধী দল প্রথম দিকে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা নিয়ে অনড় থাকলেও নানামুখী চাপে তারা এখন অনেকটাই নমনীয়। বিএনপি বলছে, তারা যে কোন সময় সংলাপে বসতে রাজি, তবে তা হতে হবে নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে। দলীয় কোন সরকারের অধীনে তারা এখনও নির্বাচনে অংশ নিতে নারাজ।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সমঝোতার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, সমঝোতার সব পথ এখনও বন্ধ হয়ে যায়নি। এখনও সময় আছে। আমরা আশাবাদী সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা হবে। স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য এম তরিকুল ইসলামও সমঝোতার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, এখনও সময় আছে। সরকারের শেষ ৬ মাসে হয়ত একটা কিছু হবে।
প্রবীণ রাজনীতিক ও পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, আমরা এখনও আশাবাদী। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থার রূপরেখা প্রণয়নে সকলের সঙ্গে সমঝোতা হবে। আমরা সংসদে কিংবা বাইরে যে কোন স্থানে এ নিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপে বসতে প্রস্তুত। তাই বিরোধী দলের উচিত রাজপথে সংঘাত-সহিংসতার পথ পরিহার করে এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসা। আমরা আশা করব বিরোধী দল আসন্ন সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে তাদের কোন বিকল্প প্রস্তাব থাকলে তা তুলে ধরা। আমরা আলোচনা করেই সব ঠিক করব।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ‘নির্দলীয় নাকি দলীয়’ এই দুটি বাক্য নিয়ে সৃষ্ট রাজনৈতিক বিরোধের নিষ্পত্তির উপায় বের করতে তৎপর হয়ে উঠেছে দেশী-বিদেশী নানা মহল। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বিশ্বের ক্ষমতাশীল দেশের পাশাপাশি দাতাগোষ্ঠীসহ সকল মহলই চাইছেন সরকার ও বিরোধী দল এ নিয়ে একটি সমঝোতায় উপনীত হোক। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালে দেশে কোন্ ধরনের সরকার থাকবে অর্থাৎ কোন্ ধরনের সরকারের অধীনে ওই নির্বাচন হবে তা বড় দুই দল সংলাপে বসে ঠিক করুক। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফ্যাক্টর বলে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারতসহ অন্য কয়েকটি দেশের কূটনীতিক ও দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরাও দেশের গণতান্ত্রিক ধারাকে অব্যাহত ও স্থিতিশীলতা রক্ষার স্বার্থে বড় দুই দলেরই নীতিনির্ধারক মহলে এ নিয়ে ধারাবাহিক বৈঠক চালিয়ে যাচ্ছেন।
‘নির্দলীয় আর নির্বাচিত’ এই দুই বাক্য নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ অবসানে মাত্র কিছুদিন আগে একটি সহজ পন্থার কথা জানিয়েছেন দেশের প্রবীণ আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক। সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাতকারে এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সংসদের কোন একটি আসনশূন্য করে সেখানে উপনির্বাচনের মাধ্যমে নির্দলীয় ব্যক্তিকে নির্বাচিত করে আনা সম্ভব। সংবিধান সংশোধন ছাড়াও নির্দলীয় ব্যক্তিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রীও করা সম্ভব। তাই আমি মনে করি, বর্তমান সঙ্কট সমাধানের বিকল্প হচ্ছে নির্দলীয় কোন ব্যক্তিকে কোন একটা আসন থেকে নির্বাচিত করে তাঁকেই ছোট মন্ত্রিসভা গঠনের ভার দেয়া যায়। এটা সংসদীয় রাজনীতির ঐতিহ্যগত রীতিনীতির সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ। তবে এ ক্ষেত্রে দু’পক্ষেরই সদিচ্ছার প্রয়োজন।
কিন্তু দেশী-বিদেশী মহলের নানা তৎপরতা সত্ত্বেও বড় দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতার কোন লক্ষণ এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। বরং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের মধ্যে দূরত্ব ক্রমশ বাড়ছে। বাড়ছে অবিশ্বাস, সন্দেহ। দু’পক্ষের এমন মুখোমুখি অবস্থানের কারণে জনমনেও সৃষ্টি হয়েছে হতাশা। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও প্রতিদিন সঙ্কটের কথা বলছেন। বর্তমানে দু’পক্ষের মধ্যে যে অবস্থা তা দ্বন্দ্ব কমার নয়, বরং সঙ্কট বাড়ার লক্ষণ বলেই মনে হচ্ছে। তবে সব মহলেরই আশাবাদ, দেশে এমন এক ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে তখন দুই নেত্রীর গণতন্ত্রের স্বার্থে সমঝোতার দিকে বাধ্য হবেন। সমঝোতা হবে কিন্তু এজন্য অনেক কষ্ট করতে হবে।
পর্যবেক্ষকদের মতে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মুখোমুখি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। তবে রাজনীতির কৌশলের খেলায় এ ইস্যুতে রাজনীতির আকাশে যে কালো মেঘ জমেছিল এতদিন, তা কাটতে শুরু করেছে। প্রধান দুই দলেরই কঠোর অবস্থান থেকে সরে আসায় নির্বাচনকালীন অন্তবর্তী সরকার নিয়ে আলোকরেখা দেখা দিয়েছে। এখন বড় দুই দলের শীর্ষ নেতাদের পাশাপাশি শরিক দলের নেতারাও সমঝোতার ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে উঠছেন।
সূত্রমতে, বড় দুই দলের নীতিনির্ধারক নেতাদের মধ্যে ব্যক্তি আলাপচারিতার পর বলতে শুরু করেছেন যে, নির্বাচনীকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে কিছু একটা হবে, হতেই হবে। বিশেষ করে কূটনীতিকদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় উভয় দলের নেতাদের মনোভাবও এখন ইতিবাচক। ইতোমধ্যে জাতিসংঘের একটি প্রতিনিধি দল, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, দেশটির দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সরকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ পশ্চিমা দেশগুলোর একাধিক কূটনীতিক বাংলাদেশে সফর করে সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক সঙ্কট দূর করার তাগিদ দিয়েছেন। ওই সব দেশের কূটনীতিকরা বলছেন, সব দলের অংশগ্রহণে বাংলাদেশে আগামীতে তারা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে চায়।
জানা গেছে, কূটনীতিক ও দেশের সুশীল সমাজের এমন মনোভাবকে ‘চাপ’ হিসেবে দেখেই দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে এমন ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, শেষপর্যন্ত বড় দুই দলই সংলাপে বসবে এবং আলোচনার মাধ্যমেই সৃষ্ট সঙ্কটের অবসান হবে। কারণ উভয় দলের নেতাদের বদ্ধমূল ধারণা, সংঘাতময় পরিস্থিতির সুযোগে দেশের গণতন্ত্র বিনষ্ট হতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.