হাইব্রিড ধানের চাষ-বীজ-প্রতারণা বন্ধ করতেই হবে by মাহবুব হোসেন

এবারে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের শুধু আমদানিকারকরা বীজের দাম দিয়ে দিলেই কিন্তু সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ কৃষকদের জমির সব ফসল নষ্ট হয়েছে। তাদের ঘরের খাবার কিনে খেতে হবে। বাড়তি ফসল থেকে যে আয় হতো সেটাও মিলবে না।
সার ও সেচের জন্য তাদের প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। এসব ক্ষতিপূরণ কে দেবে? এ কারণে আইনের বিধিবিধান এখন এমনভাবে করতে হবে যাতে শুধু বীজের জন্য নয়, উৎপাদনের ক্ষতিও পুষিয়ে দিতে হবে


গত কয়েকদিনে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতে বোরো ধানের ফলন বিষয়ে দুই ধরনের খবর প্রকাশিত হয়েছে। এক ধরনের সংবাদ শিরোনাম ছিল : 'বোরোর বাম্পার ফলনে কৃষকের মুখে হাসি।' এবারে হাওর এলাকার ফসল আগাম বন্যা কিংবা পাহাড়ি ঢলে ভেসে যায়নি। আরেক ধরনের খবরে বলা হয় : হাইব্রিড ধান 'ঝলক' চাষ করে কৃষকের সর্বনাশ হয়েছে। কয়েকটি এলাকায় হাইব্রিড চাষে ক্ষতিগ্রস্ত চাষিরা নষ্ট ধানে আগুন দিয়েছেন, এমন খবর দেখেছি। ২৫ এপ্রিল সমকালে নোয়াখালী এলাকার খবরে বলা হয় : 'নোয়াখালীর ক্ষতিগ্রস্ত চাষিরা ঝলক বীজ বিপণনকারী একটি কোম্পানিকে এজন্য দায়ী করেন এবং মুনাফাখোর বীজ কোম্পানির সহযোগীদেরও শাস্তি দাবি করেন। নোয়াখালীর সদর উপজেলার একজন কৃষক মুক্তিযোদ্ধা এনায়েত মেম্বারের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয় : 'কৃষি ব্যাংক থেকে এক লাখ ২০ টাকা ঋণ নিয়ে তিন কানি জমিতে ঝলক ধান লাগিয়ে তার পথে বসার উপক্রম হয়েছে। ' নোয়াখালী জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের একজন কর্মকর্তার বক্তব্য উল্লেখ করে সমকালের খবরে বলা হয়, জেলায় ঝলক ধান আবাদ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন ৬ হাজার ৭৯২ জন চাষির তালিকা তৈরি করা হয়েছে। দেশের আরও কয়েকটি এলাকায় এ ধরনের বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। অন্যদিকে, সমকালে মাগুরার জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সূত্র উল্লেখ করে জানানো হয়েছে, জেলায় এবার বোরোর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ ৭০ হাজার টন, কিন্তু অতিরিক্ত এলাকায় চাষ এবং আশাতীত ফলনের কারণে উৎপাদন দুই লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে।
হাইব্রিড প্রযুক্তি বাংলাদেশে আমদানি করা হয়েছে এবং এর লক্ষ্য স্পষ্ট : একই জমিতে ধানের ফলন বাড়ানো। এক সময়ে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট বা ইরির কাছ থেকেও উচ্চফলনশীল ধান বীজ আনা হয়েছে। বাংলাদেশ রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট বা ব্রিতে এ থেকেই বিভিন্ন মৌসুমের উপযোগী নানা জাতের ধান বীজ উদ্ভাবন করা হয়েছে। মাগুরার একটি খবরে দেখেছি, প্রদর্শনী প্লটে ব্রি-২৮ জাতের ধানে প্রতি শতকে ফলন হয়েছে প্রায় এক মণ। এসএল-৮ জাতে প্রতি একরে একশ' মণের বেশি ফলন হবে বলে কৃষকদের আশা। হাইব্রিড ধানের ফলন বেশি পাওয়া গেলেও সমস্যা হচ্ছে, এর বীজ কৃষকরা নিজের জমি থেকে সংগ্রহ করতে পারে না। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মূলত ব্র্যাকই হাইব্রিড ধানের বীজ উৎপাদন করছে। এ বীজের মোট বাজারে ব্র্যাকের হিস্যা প্রায় ৩০ শতাংশ। অন্যদিকে ভুট্টা চাষের জন্য যত হাইব্রিড জাতের বীজ ব্যবহার করা হয় তার ৬০ শতাংশের জোগান দেয় ব্র্যাক। অন্য যেসব কোম্পানি হাইব্রিড ধানের বীজ কৃষকদের কাছে বিক্রি করে তারা মূলত তা আমদানি করে চীন থেকে। বিশ্ব অর্থনীতিতে এক নম্বর স্থান দখলের পথে এগিয়ে চলা এ দেশটি হাইব্রিড ধানের বীজ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের প্রতি বিশেষ মনোযোগ প্রদান করেছে। এ ধরনের অতিফলনশীল জাতের বীজ উৎপাদকদের সরকার থেকে বিশেষ সুবিধা প্রদান করা হয়। বর্তমানে সেখানে অনেক কোম্পানি সক্রিয় রয়েছে এবং তারা বিশ্বের নানা দেশে ভালো ব্যবসা করছে। তাদের সঙ্গে অন্য দেশের প্রতিযোগীদের পক্ষে পেরে ওঠা কঠিন।
হাইব্রিড বীজ আমদানি ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকারের নীতিমালা রয়েছে এবং তা যথেষ্ট কৃষকবান্ধবই বলা চলে। কিন্তু বাংলাদেশের অনেক ভালো আইনের মতোই এ ক্ষেত্রেও সমস্যা একই_ প্রয়োগ যথাযথভাবে হয় না। আইনে বলা হয়েছে, আমদানি করা বীজ সরাসরি কৃষকদের কাছে বিক্রি করা যাবে না। বীজ আমদানি করার পর তা পরীক্ষা করে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সনদপত্র নিতে হবে। তারপরই কেবল তা কৃষকদের কাছে বিক্রি করা যাবে। কিন্তু অনেক কোম্পানি সেটা না মেনে বেশি মুনাফার জন্য সরাসরি তা বাজারে বিক্রি করে দেয়। এবারে যেসব এলাকায় কৃষকের ক্ষতি হয়েছে সেখানে এ ধরনের সমস্যা হয়েছে বলেই মনে হয়। বীজ আমদানিকারকদের উচিত হবে, প্রথমে কৃষকদের আস্থা অর্জন করা। এজন্য ভালো বীজ দিতে হবে। ফলন ভালো পেলে কৃষক অবশ্যই তাদের কাছে পরের বছরের বীজের জন্য যাবে। যারা কেবল একবারের জন্য বীজের বাজার চায়, তারা সে পথে চলতে চায় না। তারা সস্তা বীজ আনে এবং কোনোরকম পরীক্ষা ছাড়াই বিক্রি করে দেয়।
আমাদের দেশে সহজাত যেসব ধানের চাষ হয় সেগুলোর সহ্য ক্ষমতা থাকে বেশি। পোকামাকড়ের আক্রমণ তারা প্রতিরোধ করতে পারে। রোগবালাই দমনের ক্ষমতাও থাকে বেশি। হাইব্রিডে এসব থাকে না। যেসব আমদানি করা বীজ নিয়ে কৃষকরা বিপদে পড়েছেন সেগুলো চাষের আগে যদি পরীক্ষা করা হতো তাহলে এসব সমস্যা অবশ্যই ধরা পড়ত।
এবারে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের শুধু আমদানিকারকরা বীজের দাম দিয়ে দিলেই কিন্তু সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ কৃষকদের জমির সব ফসল নষ্ট হয়েছে। তাদের ঘরের খাবার কিনে খেতে হবে। বাড়তি ফসল থেকে যে আয় হতো সেটাও মিলবে না। সার ও সেচের জন্য তাদের প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। এসব ক্ষতিপূরণ কে দেবে? এ কারণে আইনের বিধিবিধান এখন এমনভাবে করতে হবে যাতে শুধু বীজের জন্য নয়, উৎপাদনের ক্ষতিও পুষিয়ে দিতে হবে। অন্যথায় বেসরকারি খাতের আমদানিকারকদের দ্বারা কৃষকদের প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যাবে। দেশে বর্তমানে কয়েকটি কোম্পানি হাইব্রিড জাতের ধানবীজ আমদানি করছে। এদের একটি অংশ বীজ প্রকল্পে পরীক্ষা করার পর বাজারে বিক্রির জন্য দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ সরাসরি কৃষকদের কাছে বিক্রি করছে। ব্র্যাক দেশেই এ ধরনের বীজ উৎপাদন করছে। কিন্তু ঝলক ধানের মতো দু'চারটি কোম্পানির কারণে বদনাম হচ্ছে সব কোম্পানির। ফলে কৃষকরা এ ধরনের ধানের চাষে উৎসাহ হারিয়ে ফেলতে পারেন।
আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হাইব্রিড চাষের প্রয়োজন রয়েছে। সাধারণত হাইব্রিড ধানের বীজ থেকে প্রতি বিঘা জমিতে ২৪ থেকে ২৭ মণ ধান পাওয়া যায়। অন্যদিকে প্রচলিত ইরি জাত থেকে পাওয়া যায় বিঘায় ২০ মণ। দেখা যায়, যেহেতু হাইব্রিড বীজের দাম বেশি এবং অন্যান্য উপকরণও কিছুটা বাড়তি লাগে, তাই এ ধরনের জমিতে কৃষকরা বিশেষ যত্ন নেন। এর ফল পাওয়া যায় ফলনে_ উৎপাদন যা হওয়ার কথা, মেলে আরেকটু বেশি।
বাংলাদেশে চাষের জমির পরিমাণ প্রতিনিয়ত কমছে। অন্যদিকে বাড়ছে লোকসংখ্যা। এ অবস্থায় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অতিফলনশীল জাতের ধান, গম, ভুট্টা ও বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। এভাবে ফলন বাড়ানো গেলে আগামী অন্তত এক দশক বর্ধিত জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্যের জোগান নিয়ে আমাদের তেমন উদ্বিগ্ন হতে হবে না। বর্তমানে বোরো মৌসুমে মোট জমির প্রায় ১৫ শতাংশে হাইব্রিড জাতের চাষ হয়। এটা ৬০ শতাংশ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সমস্যা দুটি : এক. বীজের জন্য ব্যয় পড়ে বেশি। সাধারণত দেশি প্রচলিত জাতের ক্ষেত্রে চাষাবাদের ব্যয়ের ২ শতাংশের মতো বীজের পেছনে ব্যয় হয়। কিন্তু হাইব্রিডের ক্ষেত্রে ব্যয় হয় ৬ শতাংশ। দুই. বিদ্যমান ব্রি জাতের তুলনায় হাইব্রিড ধানের ভাতের মান কিছুটা খারাপ। ব্রি-২৮ জাতের চাষ হয় ব্যাপক এবং তার ভাত শুধু দরিদ্র নয় মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীরও পছন্দ। তাছাড়া ব্রি জাতের পান্তা সুস্বাদু। কিন্তু হাইব্রিড জাতের চালের ভাত গরম থাকতে থাকতে খেয়ে ফেলতে হয়। অন্যথায় ভাত কিছুটা নরম হয়ে যায়। বাংলাদেশে পান্তা ভাতের চলন যে ব্যাপক তার অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। পান্তা ভাত আগের রাতের ভাত থেকেই পানি ঢেলে পাওয়া যায়। সকাল হতে না হতেই তা খেয়ে কৃষক ও মজুররা কাজে চলে যেতে পারেন। অন্যথায় তাকে সকালে নাশতা তৈরি না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। হাইব্রিড ধানের এ ধরনের সমস্যার জন্যই বাজারে ব্রি-২৮ জাতের ধান বিক্রি করে যেখানে প্রতি ৪০ কেজিতে ৯০০ টাকার মতো পাওয়া যায়, হাইব্রিডে পাওয়া যায় ৮০০ টাকা। হাইব্রিড জাতের চাষ শুরুর সময়ে অল্প পরিমাণ জমিতে তা ফলত। ফলে ব্যবসায়ীরা ব্রি জাতের সঙ্গে তা মিশিয়ে বাজারে বিক্রি করত এবং ক্রেতারা ধরতে পারত না। কিন্তু এখন চাষ বাড়ছে। ফলে ব্যবসায়ীরা আর ভালো-মন্দ মিশিয়ে তা বিক্রি করতে পারেন না।
হাইব্রিড বীজের জন্য কৃষককে ৬ শতাংশ বেশি ব্যয় করতে হয়। আবার বাজারে বিক্রি করে দাম মেলে ১০ শতাংশ কম। অন্যদিকে উৎপাদন বেশি হয় ২০ শতাংশ। অর্থাৎ বাড়তি লাভ ৪ শতাংশ। কিন্তু এতে পান্তা ভাত মেলে না। এমন চিত্র হাইব্রিড জাতের চাষ ব্যাপক এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট উৎসাহ সৃষ্টি করে না। এখন সময় এসেছে ধানের ফলন বাড়ানোর পাশাপাশি মান নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করে তার সুফল কৃষকদের কাছে পেঁৗছে দেওয়ার জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের। এখন দেখা যায়, স্বল্প আয়তনের জমি যাদের তারা হাইব্রিড জাতের প্রতি বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। কিন্তু বাজারে যারা বাড়তি ধান বিক্রি করে তাদের আগ্রহ কম। এ অবস্থার পরিবর্তন কাম্য।
দেশে এখন হাইব্রিড জাতের সবজি ও ফলের চাষও হচ্ছে। এ নিয়ে তেমন সমস্যার কথা শোনা যায় না। বাজারে অনেক বড় মুলা আসছে। কোনো কোনোটা তো এক কেজি ওজনেও হয়ে থাকে। বাজারে অঢেল তরমুজ দেখা যায় বড় আকারের। কুমড়া ও লাউচাষিরাও হাইব্রিড বীজ ব্যবহার করেন। এ ক্ষেত্রেও চূড়ান্ত বিচারে অর্থনীতির বিষয়টি আসবে। কারণ মুলার আকার বেশি বড় হলে তার ক্রেতা পাওয়া সহজ হবে না। তরমুজ বেশি বড় হলে একদিনে খেয়ে শেষ করা যায় না। এ ধরনের আরও কিছু সমস্যা রয়েছে, যার সমাধান রয়েছে বিজ্ঞানীদের হাতে।
হাইব্রিড জাতের ধানের চাষ যখন বাড়ানোর জন্য কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে তখন 'বীজ-প্রতারণা' কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ সমস্যার সমাধান করতে হবে জরুরি ভিত্তিতে এবং এ ক্ষেত্রে মূল বিবেচনায় রাখতে হবে কৃষকের স্বার্থ।

ড. মাহবুব হোসেন : কৃষি বিশেষজ্ঞ এবং প্রধান নির্বাহী, ব্র্যাক

No comments

Powered by Blogger.