সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী জাতীয় সম্মেলন- সাম্প্রদায়িক সহিংসতা রোধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান

সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে গতকাল রোববার অনুষ্ঠিত হলো সাম্প্র্রদায়িকতাবিরোধী জাতীয় সম্মেলন। ১৫ জন বিশিষ্ট নাগরিকের আহ্বানে রাজধানীর মহানগর নাট্যমঞ্চের কাজী বশির আহমেদ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত দিনব্যাপী এ সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতি—গণতন্ত্র,
জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দাবি জানিয়ে বলা হয়, ‘আমাদের জাতীয়তাবাদ উগ্র জাতীয়তাবাদ হবে না, আমাদের গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের পীড়নমূলক শাসন হবে না, আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা ব্যক্তির ধর্ম পালনের অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করে রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে বিযুক্ত রাখবে এবং আমাদের সমাজতন্ত্র অগণতান্ত্রিক হবে না।’
ঘোষণাপত্রে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়, রাষ্ট্র যখন দীর্ঘকাল পর ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সম্পন্ন করার মহৎ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, তখন এই বিচারের প্রক্রিয়া রদ করার দাবিতে মৌলবাদী একটি বিশেষ গোষ্ঠী রাজপথে সহিংস-নৈরাজ্যবাদী তৎপরতা শুরু করেছে।
বেলা ১১টায় জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ সম্মেলন। শুরুতে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীরা গণসংগীত পরিবেশন করেন। এ সময় একে একে কমিউনিস্ট পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ কয়েকটি বামপন্থী রাজনৈতিক দল মিছিল নিয়ে সম্মেলনে যোগ দেয়।
সম্মেলন আহ্বানকারীদের পক্ষে শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামান স্বাগত বক্তব্যে সম্মেলন আয়োজনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘গেল সেপ্টেম্বরে রামুসহ সন্নিহিত এলাকায় বৌদ্ধসম্প্রদায় আক্রান্ত হলে আমরা প্রথমে এটিকে একটি আকস্মিক ঘটনা বলে ভাবতে চেয়েছিলাম। পরে সাতক্ষীরাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় হিন্দুদের এবং রংপুরের তারাগঞ্জে আহমদিয়াদের ওপর সহিংসতা ঘটলে আমাদের মনে হয়, এসবই পরিকল্পিত ঘটনা।’ তিনি বলেন, ‘সরকার ও প্রশাসন এসব ঘটনায় নির্লিপ্ত থাকলেও দেশ ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে আমাদের মনে হয়েছে, মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা প্রয়োজন। কারণ, সাম্প্রদায়িক শক্তি দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে বিনষ্ট করতে সাংগঠনিকভাবে অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই আমাদের মনে হয়েছে, যে আদর্শ ও স্বপ্ন নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, তা বিপন্ন হতে দেওয়া যায় না।’ তিনি দেশের সব শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমরা মানুষের শুভবুদ্ধির ওপর নির্ভর করেই সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী এ সম্মেলনকে সমগ্র দেশে ছড়িয়ে দিতে চাই।’ তিনি পর্যায়ক্রমে বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে এ সম্মেলন করার জন্য জনগণের কাছে আবেদন জানান।
সম্মেলন আহ্বানকারীদের অন্যতম সৈয়দ শামসুল হকের সভাপতিত্বে সাম্প্র্রদায়িকতাবিরোধী জাতীয় সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে ঘোষণাপত্র পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ।
সভাপতির বক্তব্যে সৈয়দ শামসুল হক বাঙালির হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা ধর্মকে ব্যবহার করেছে। এখনো তাদের অনুসারীরা তা-ই করে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসীরা জানি, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার থাকতে পারে না।’ এর আগে সম্মেলন আহ্বানকারী ১৫ বিশিষ্ট নাগরিকের মধ্যে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, কামাল লোহানী, রামেন্দু মজুমদার ও সুলতানা কামাল বক্তব্য দেন। সম্মেলন আহ্বানকারী অন্যরা হচ্ছেন: সালাহউদ্দিন আহমদ, সরদার ফজলুল করিম, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, কাইয়ুম চৌধুরী, হামিদা হোসেন, সেলিনা হোসেন ও মুহম্মদ জাফর ইকবাল।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী বাংলাদেশের জন্মের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের আদি মূল্যবোধগুলোর একটি হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। তিনি বাহাত্তরের সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি জানান।
কামাল লোহানী তাঁদের ১৫ জনের পক্ষ থেকে ডাকা এ সম্মেলনকে দেশের সব মানুষের সম্মেলন আখ্যা দিয়ে বলেন, হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যে ঐতিহ্য, তা পুনরুদ্ধার করতে হবে।
সুলতানা কামাল বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে ধর্মচিহ্নিত যে নাগরিকত্ব আমরা প্রত্যাখ্যান করেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে পরাজিত শক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা হয়েছে।’ তিনি ধর্ম ও রাষ্ট্রকে আলাদা রাখার আহ্বান জানান।
রামেন্দু মজুমদার বলেন, সাম্প্রদায়িকতা অনেক গভীরে প্রোথিত হয়ে গেছে। তিনি এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে বেগবান করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।
প্রথম অধিবেশনের দ্বিতীয় পর্বে ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আলোচনা। এই পর্বে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ পুরোপুরিভাবে বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে না যেতে পারাকে নিজেদের ব্যর্থতা বলে স্বীকার করে নিয়ে বলেন, ‘তার পরও আমরা যুদ্ধাপরাধের বিচার করার পাশাপাশি একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছি।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম বিলুপ্ত এবং ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে বলেন, সংবিধানে ষোলোতম সংশোধন যদি আনতেই হয়, তাহলে এই দুটি কাজ করুন।
তথ্যমন্ত্রী ও বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, জামায়াতকে না ছাড়লে বিএনপি ও খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে বিতাড়নের আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সহসভাপতি মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধীর দল বলা হলে বিএনপিকে কেন যুদ্ধাপরাধীদের দল বলা হবে না? আসুন আমরা সাহস করে সত্য কথাটা বলি।’
লেখক-সাংবাদিক আবুল মোমেন সভা-সমাবেশের চেয়ে বছরের একটি দিনকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি দিবস হিসেবে পালন অনেক বেশি কার্যকর হবে বলে মত প্রকাশ করে বলেন, অসাম্প্রদায়িকতার বোধটিকে মানুষের অন্তরে রোপণ করতে হবে।
সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন কামাল লোহানী। এ অধিবেশনের আলোচনাপর্বে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো এবং আগামী নির্বাচন থেকে যতটা সম্ভব ফায়দা লোটার জন্য সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটানো হচ্ছে।
গণঐক্যের নেতা পঙ্কজ ভট্টাচার্য রামুর বৌদ্ধপল্লিতে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা তদন্তে পাওয়া তথ্য জানিয়ে বলেন, এই ঘটনায় জামায়াত ও তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় রোহিঙ্গারা অংশ নেয়। এতে ১০০ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে এবং এ নিয়ে দুবাইয়ে একটি বৈঠকও করা হয়।
সম্মেলনে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী মঞ্চের সভাপতি অজয় রায়, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) আহ্বায়ক খালেকুজ্জামান, ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান মল্লিক, বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের সভাপতি মোজাফফর হোসেন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, গণতন্ত্রী পার্টির শহিদুল ইসলাম, কমিউনিস্ট কেন্দ্রের অসিত বরণ রায়, অধ্যাপক এ এন রাশেদা, সম্মিলিত ইসলামী জোটের জিয়াউল হাসান, বৌদ্ধসম্প্র্রদায়ের জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, আহমদিয়া মুসলিম জামায়াতের আবদুল আউয়াল খান চৌধুরী প্রমুখ বক্তব্য দেন।
সবশেষে ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

No comments

Powered by Blogger.