চাষির মুখে টপ্পা গাওয়ায় by আবদুশ শাকুর

হেমন্তে ফসল কাটার পর শুকনো খড়ে কৃষক আগুন দেয়। সেই ধোঁয়া ও কুয়াশা মিলে সন্ধের পাড়াগাঁ হয়ে ওঠে রহস্যময়, শুকনো গন্ধে ব্যথিয়ে উঠে মানুষের মন কেমন করে। কার্তিক মাসে হয় কার্তিকের ব্রত


নজরুল গেয়েছেন— ‘হৈমন্তী তেওড়া’:
উত্তরীয় লুটায় আমার—
ধানের খেতে হিমেল হাওয়ায়।
আমার চাওয়া জড়িয়ে আছে
নীল আকাশের সুনীল চাওয়ায় \
ভাঁড়ির শীর্ণা নদীর কূলে
আমার রবি-ফসল দুলে,
নবান্নেরই সুঘ্রাণে মোর
চাষির মুখে টপ্পা গাওয়ায় \
রবীন্দ্রনাথ গেয়েছেন—
আজি এল হেমন্তের দিন
কুহেলীবিলীন, ভূষণবিহীন।
বেলা আর নাই বাকি, সময় হয়েছে নাকি—
দিনশেষে দ্বারে বসে পথপানে চাই।
শরৎ আর শীতের মধ্যস্থ ঋতু হেমন্তের না আছে শীতের কুহেলি, না আছে শরতের ভূষণ। অন্য কথায়, রবীন্দ্রনাথ বললেন হেমন্ত ফুলের ঋতু নয়; আর নজরুল বললেন হেমন্ত ফলের ঋতু। বাংলার প্রকৃতিপ্রেমী এই দুই বড় কবির ফল আর ফুলের গান স্মরণ করাল আমার সংগীতপ্রেমী অগ্রজটিকে, যিনি আমার গোলাপবাগানটিকে ছারখার হয়ে যেতে দেখে সম্ভবত খুশিই হয়েছিলেন এই ভেবে যে, আমার গোলাপ-ব্যাধির নিরাময় হয়েছে।
আসলে রিক্ত হেমন্তে বারোমেসে ফুল গোলাপের বাগানও নেড়া হয়ে যায়। কারণ, গোলাপবর্ষের প্রথম মাস অক্টোবর হলেও বর্ষণ একেবারে শেষ না হয়ে গেলে গোলাপগাছের বাৎসরিক প্রুনিং বা ছাঁটাই শুরু করা যায় না। বর্ষণ শেষ হতে হতে আশ্বিন শেষ হয়ে কার্তিক মাস এসে পড়ে। অতএব প্রকৃতপক্ষে এ দেশে গোলাপ-বছর আরম্ভ হয় হেমন্তের শুরুতেই, মানে অক্টোবরের মাঝামাঝি।
গোলাপের আগত মৌসুমের প্রথম কাজটি হলো বিগত মৌসুমের পুরাতন ডালগুলো কেটে ফেলে দেওয়া, যাতে নতুন গজানো ডাল থেকে সতেজ সুপুষ্ট ফুল পাওয়া যায়। ফলে বাগানের প্রাথমিক দৃশ্যটিতে গাছের কদম-ছাঁটা মাথা ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। তার মানে হেমন্তে জমজমাট গোলাপবাগানকেও হয়ে যেতে হয় নিরাভরণ হেমন্তেরই প্রতীক, একেবারেই মাথা-মুড়ানো।
অভিভাবক ভাইটি বাগান উজাড় দেখেই খুশি। ভাবলেন বুড়বক ভাইটির নেশা টুটেছে। কারণ, তিনি আমার সরকারি নিবাস পুরাতন পরিত্যক্ত বাড়িটির স্বাস্থ্য সম্পর্কে উদ্বিগ্ন। তাঁকে আমি স্মরণ করি পিডব্লিউডির চিফ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে, অভিজ্ঞ বিবেচনায় ছাদের ওপর গোলাপের ২০ ইঞ্চি টব বসানোর লোকেশন ঠিক করে দেওয়ার ব্যাপারে উপদেশ দানের জন্যে।
প্রতিবারই পুরাতন ছাদে টব আর না বাড়ানোর, অর্থাৎ বিল্ডিংটির নিরাপত্তার ঝুঁকি আর না বাড়ানোর, পরামর্শই দেন তিনি। বলেন, বিমের ওপরে আর জায়গা নেই; এত পুরাতন বিল্ডিংয়ের বিমের বাইরে রাখা বিল্ডিং বিভাগের চিফ হয়ে আমি অনুমোদন করতে পারি না। এদিকে আকর্ষণীয় নতুন ভ্যারাইটি পেলে আমি না এনেও পারি না। আবার আনা মানে ছাদের ওপর রাখা, যেহেতু লন-গার্ডেনটিতে আর একটি বুশধারণের জায়গাও নেই—মানে একটি গোলাপগুল্ম ধারণের।
আমার নেশার ব্যাপারটা তিনি বোঝেন, তবু তাঁর পেশার বিষয়টা আমাকে বোঝান এই বলে যে পুরাতন জগন্নাথ হলটির মতো কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেলে দায়িত্বটা তো তাঁর ঘাড়েই বর্তাবে। এবার তাঁকে এনেছিলাম প্রুনিংয়ের আগে পাঁচটি রোজ-বুশ ছাদে ট্রান্সফার করার দরকার হয়েছিল বলে। কারণ, বিদেশ থেকে আনা পাঁচটি বিরল রোজ-স্যাপলিং গ্রাউন্ডে লাগালে অনভ্যস্ত পরিবেশে চারাগাছগুলো অধিক শক্তি পাবে—এবং ছাঁটাই হওয়া অবস্থায় গোলাপগুল্ম স্থানান্তর করা বৃক্ষনিধনেরই নামান্তর।
তো তিনি হেমন্তের শুরুতে এসে শ্মশান-প্রায় বাগানটিকে আমার গোলাপ-রোগের উপশম জ্ঞান করলেন। প্রকারান্তরে ভাই এই ভেবে স্বস্তি পেলেন যে, চিড় ধরা ছাদে ২০ ইঞ্চি টব বাড়ানোর অপরাধমূলক কর্মে মদদ জোগানোর দণ্ডনীয় কাজে জড়ানোর দায় থেকে অতঃপর তিনি মুক্তি পাবেন। আমি তাঁর আশার গুড়ে বালি দিয়ে বললাম, দু-আড়াই মাস পরে এসে আমার গজিয়ে ওঠা নতুন বাগানটি দেখলে তাঁর মন ভরে যাবে। তবে আসবেন ভোর বেলা, কুয়াশা না কাটতে।
ভাই এলেন আড়াই মাস পরে জানুয়ারির শুরুতে। গাড়ি থেকে নেমেই গোলাপের সংবর্ধনায় অভিভূত হয়ে বাগানের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে গেলেন। হাস্যময়ী লাস্যময়ী গোলাপসুন্দরীদের রঙের রায়টের দিকে তাকিয়ে রইলেন তো রইলেনই— একেবারে যাকে বলে নট-নড়ন-চড়ন। ভাবলাম, পুষ্পসন্দর্শনে বুঁদ মানুষটি বাগানের মোহ ত্যাগ করে ঘরে ঢুকতে পারছেন না। অতএব আমিই বেরিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম তাঁর পাশে। আর তখনই তিনি তাঁর একান্ত অপ্রত্যাশিত-কিন্তু-অবিস্মরণীয় উক্তিটি করলেন:
‘এক সে এক সুন্দর ফুল ফুটল বুঝলাম। কিন্তু তার পর?’
জবাবে আমার বিভ্রান্ত উক্তিটি:
‘একে একে ঝরে যাবে, যার যখন আয়ু ফুরাবে।’
‘এটুকুর জন্যেই এত সব? ফল ফললে তো অন্তত খাওয়া যেত। গোলাপের কাণ্ডগুলো তুলে গোলালুর বীজ পুঁতে দাও না কেন—এখনই তো সময়।’
সেই চিরন্তন গোলালু-গোলাপ তরজা: গোলাপ ফোটাব, না গোলালু ফলাব। নাশতা খেয়ে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠার আগে বাগানের ধারে দাঁড়িয়ে মুরব্বির কাছে আমি নির্দিষ্ট নির্দেশই চাইলাম:
‘আপনি কি সিরিয়াসলি বলছেন, গোলাপের বদলে গোলালু— ’
‘হ্যাঁ একটা “নিষ্ফল” চর্চার চেয়ে— ’
‘নিষ্ফুল’ চর্চার মূল্য বেশি—তাই তো?
‘তাই নয় কী?’
‘আমার কাছে তো নয়ই, মনে হয় অনেকের কাছেই নয়। অন্যথায় পুষ্পহীন হওয়ার অপরাধে হেমন্ত এমন উপেক্ষিত হতো না। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও এ ঋতুটিকে নিয়ে মাত্র পাঁচটা গান লিখে থামতেন না। অথচ এই ঋতু ফলে ভরা। অনেক ফলই হেমন্তে পড়ে পাকে, যেমন চালতার ফুল বর্ষায় ফোটে বটে তবে ফল হয়ে পাকে হেমন্তে। বাংলার প্রধান রোপা আমন ধান হেমন্তে পাকে বলে একে ‘হৈমন্তিক’ও বলে। আমাদের জাতীয় সংগীত কী গায়? ‘ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি \/তোমার ধানে-ভরা আঙিনাতে জীবনের দিন কাটে,/ও মা, আমার যে ভাই তারা সবাই, ও মা, তোমার রাখাল তোমার চাষি \’
‘জ্বলজ্বল করছে ওটা কী ফুল?’
‘জ্বলজ্বল করে রোদ গায়ে পড়লেই। তাই তার আসল নাম “পর্টুল্যাকা” আজ বিস্মৃতপ্রায়, ডাকনাম বিদেশে “সান প্লান্ট” আর এ দেশে “অফিস টাইম”— ’
‘অফিস টাইম? তবে তো অফিসের সময় হয়ে গেল, চলি।’
বলেই গাড়িতে উঠে গেলেন। ভাই বোধ হয় প্রসঙ্গটা এড়াতেই চাইলেন। এই ফুল বনাম ফল প্রসঙ্গে অনেকেই এ রকম বিরূপ মনোভাব পোষণ করে, বিশেষত খাদ্যঘাটতির জন্যই বেশি আলোচিত এই ভূমিদরিদ্র দেশটির প্রেক্ষাপটে। আমি গোলাপচর্চা করি শোনামাত্রই জনৈক বাল্যবন্ধু অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলেছিল:
‘না, না, না, গোলাপ কোনোমতেই গণগন্ধী নয় বরং কোনো ফুলই গণতন্ত্রী নয়। জনগণের প্রয়োজন ফুল নয়, ফুড—গোলাপ নয়, গোলালু।’
‘কেন, কেন? গোলাপের মতো অত ভালো একটা ফুলের গন্ধ জনগণের না-হয়ে, ওঁদের হবে শুধু লাউ-কুমড়ো আর টম্যাটো-মুলোর গন্ধ? রবীন্দ্রনাথ বলেছেন:
“মানুষের কাজের দুটো ক্ষেত্র আছে—একটা প্রয়োজনের, আর একটা লীলার। প্রয়োজনের তাগিদ সমস্তই বাইরের থেকে, অভাবের থেকে; লীলার তাগিদ ভিতর থেকে, ভাবের থেকে। বাইরের ফরমাশে এই প্রয়োজনের আসর সরগরম হয়ে ওঠে, ভিতরের ফরমাশে লীলার আসর জমে।” (যাত্রী)।
‘কেন লীলার আসর জমবে কেবল তোমার-আমার আর প্রয়োজনের আসর গরম হবে কেবল ওদের-তাদের? হাদিসেও তো এই দুই ফরমাশের গুরুত্বকেই সমান বলা হয়েছে: যদি দুইটা পয়সা থাকে—একটা দিয়ে খাদ্য কেন, আরেকটা দিয়ে ফুল। তাই মিনিমাম দুটো পয়সা থাকাই জনগণের ন্যূনতম চাহিদার অবিভাজ্য অঙ্ক।’
কর্মিষ্ঠ বন্ধুটির অবশেষে অতিষ্ঠ অনুরোধ:
‘একটা ব্যক্তিগত বিলাসিতার সামগ্রী নিয়ে তর্ক বাড়িয়ে একজন জনসেবকের সামাজিক সময় আর নষ্ট করিস না তো! আরে বাবা যে-গাছের মোট দৌড়ই হলো ফুল পর্যন্ত, তার কোনো গুরুত্বই থাকতে পারে না আমার কাছে।’
হুবহু এটাই তো আমার ভাইয়েরও বক্তব্য। যে-বক্তব্য যুদ্ধ বাধিয়ে দেয় গোলাপ আর বেগুনের মধ্যে, গণধ্বনি শোনায়: ‘গোলাপ-না-গোলালু?’ ‘গোলালু-গোলালু!’ ‘হাইব্রিডটি-না-বরবটি?’ ‘বরবটি-বরবটি’!! ‘ফ্লোরিবান্ডা-না-ভেরেন্ডা’ ‘ভেরেন্ডা-ভেরেন্ডা!!!’ এবং ঘটায় আনসিডেড গোলালুর নক-আউট ভিক্টির। এহেন বিপর্যয়ের কারণ, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—‘ফুলের শখ পেটের জ্বালার সঙ্গে জবরদস্তিতে সমকক্ষ নয়’...‘ক্ষুধার সময়ে বকুলের চেয়ে বার্তাকুর দাম বেশি হয়’। (যাত্রী)।
তবে এর বিপরীত দৃষ্টান্তও আছে।
দৃষ্টান্তটি হলো দশ পয়সার মাপ থেকে ডিনারডিশ সাইজের রকমারি ডালিসমৃদ্ধ জমকালো মরশুমি পুষ্প ডালিয়া। নিজের নামটির জন্যেই ঋণী যাঁর কাছে, সেই সোয়েডিশ বটানিস্ট আন্ড্রিয়াজ ডাহ্লই মেক্সিকান বিউটি এই ডালিয়াকে উদ্যানপুষ্পের বদলে লালনপালন করেছিলেন খাদ্যসবজি হিসেবে। কিন্তু ফুলটির বর্ধিষ্ণু বাহারে মজে গিয়ে একপর্যায়ে জনগণ—পুষ্পটিকে দেখেই মন ভরাতে লাগল, তার কন্দ খেয়ে পেট ভরানোর বদলে।
কিন্তু আমি ভয় পাচ্ছি, ডালিয়ার কন্দ খাওয়া যায়—কথাটা চাউর হয়ে গেলে এই লক্ষকোটি অন্নহীনের দেশে বিশাল ডালিয়ার বিপদ না ঘনায়। শাপলা-কচু থেকে টিউলিপ-ডালিয়া পর্যন্ত—বেশির ভাগ কন্দই সুখাদ্য। রূপের আকর, বিশ্বের এক নম্বর হবিপ্লান্ট গোলাপের এবং দুনম্বর ক্রিসেনথিমামের পরে তিন নম্বর হবিপ্লান্ট পুষ্পরাজ ডালিয়ার বিপরীত প্রান্তে প্রতিভা-রিক্ত ফুলগুলোর ট্র্যাজিডিটাও দেখুন। আমাদের ঘরের চালের লাউ-কুমড়ো ফুল, অঙ্গনের কচুঘেঁচু ফুল, প্রাঙ্গণের শর্ষেফুলের মতো মাঝারি মেধাবীরা মানুষের খাদ্যই রয়ে গেল আবহমান কাল থেকে। মন জয় করে খেকোদের পেট থেকে নিজের মুক্তিটুকু অর্জন করে নিতে পারল না আজও। জানি না, হাভাতের দেশে না-জন্মে কোনো অন্নপূর্ণা দেশে জন্মালে পারত কি না। সম্ভবত পারত না।
ন্যাস্টার্শিয়ামের কথাই ধরুন না। এর রংচঙে ফুলগুলি আপনার বাতায়ন-বাক্স, বাগানবেড আলোকিত করে ফেলে। তবু জাতের সংখ্যা সীমিত এবং চাষের পদ্ধতি সহজ বলে ফুলটি হবিপ্লান্ট হতে পারে না। যেহেতু সে উদ্যানপালকের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে না, তাই তার ডিভোশনও পায় না। আসলে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়ে আত্মনিবেদন আদায় করে নিতে না পারা পর্যন্ত কোনো ক্রিয়াই হবি হবার মর্যাদা পায় না—যে-কারণে সে মর্যাদাটা পায় মাউন্টেনট্রেকিং, সি-সার্ফিং ইত্যাদি। তিন-তাস খেলা, লুডু খেলা পায় না—পায় কনট্র্যাক্ট-ব্রিজ খেলা, দাবা খেলা প্রভৃতি।

এবার খাস করে হেমন্তের কথায় ফেরা যাক। সারা হেমন্তে ধান কাটার পরে মাঠ হয়ে যায় শূন্য আর গোলা হয়ে যায় পূর্ণ। চলে নবান্নের পিঠে। শুকনো খড় ও জমির আর্বজনায় চাষি আগুন দেয়। সেই ধোঁয়া ও কুয়াশা মিলে সন্ধের পাড়াগাঁ হয়ে ওঠে রহস্যময়, শুকনো গন্ধে ব্যথিয়ে উঠে মানুষের মন কেমন করে। কার্তিক মাসে হয় কার্তিকের ব্রত। ‘শেষ আশ্বিনের ভাত রেঁধে প্রথম কার্তিকে খাও, আর যেই বর চাও সেই বর পাও।’
সেই প্রাচীনকাল থেকে পোকার উৎপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য হেমন্তে এ দেশে ঘরের বাইরে উঠোনে একটা হারিকেন রাতভর জ্বেলে রাখাই রীতি। সেই আলোর আকর্ষণে পোকারা এসে জড়ো হয় আকাশপ্রদীপের চারদিকে আর মানুষ থাকে শান্তিতে। বৌদ্ধরা আকাশপ্রদীপ তোলেন সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগ এবং চুল কেটে আকাশে ছড়িয়ে দেওয়ার স্মৃতি মনে করে। চট্টগ্রামের বৌদ্ধ গ্রামে এই দৃশ্য এখনো দেখা যায়।
কার্তিক হলো রিক্ততার মাস। ধান আসা পর্যন্তই এই রিক্ততা। কারণ, চাষিদের তখন বিক্রি করার মতো কোনো ফসল থাকে না। সে জন্যেই সৃষ্টি হয় কার্তিক মাসের ‘রাট’ প্রবাদটির। সে এক অঘোষিত দুঃখের দিন। শরৎ ও হেমন্তের মাঝামাঝি সময়টাতে চাষিদের দিন কাটে নিঃশব্দ নীরব কষ্টের সঙ্গে। এরই মধ্যে চতুর্দিকে সৌরভ ছুটিয়ে ফুটে ওঠে হেমন্তের প্রধান পুষ্প সপ্তপর্ণী বা ছাতিম ফুল। অনেকগুলো জোড়া দেওয়া খোলা ছাতির মতো দেখতে বলেই হয়তো গাছটির নাম ছাতিম। এমন দূরবাহী প্রবল সৌরভের ঐশ্বর্য, এমন প্রখর বলিষ্ঠ আত্মঘোষণার সামর্থ্য খুব কম তরুরই আছে। হেমন্তের রিক্ততা আর শীতের শূন্যতার মাঝখানে প্রবল প্রাণের প্রতীক হয়ে ওঠে এই ছাতিম।
রমনা ও হাইকোর্ট এলাকায়, ডিআইটির সামনে, ঢাকা কোর্টে, কার্জন হল প্রাঙ্গণে বেশ কয়েকটি বড় বড় সপ্তপর্ণী আছে। এর সরল উন্নত কাণ্ড কিছুদূর ওপরে উঠে হঠাৎ শাখা-প্রশাখার একটি চাঁদোয়ার মতো স্তর সৃষ্টি করে, আবার এক লাফে একে ছাড়িয়ে অনেক দূর উঠে আরেকটি চাঁদোয়া সৃষ্টি করে, এমনি করে ঘন পাতার কয়েকটি স্তর সৃষ্টি হয়। এই ছত্রধারীর তরুতল ধ্যানের প্রশস্ত স্থান। ছাতিম পবিত্রতারও প্রতীক।
ভুবনডাঙ্গার শূন্য মাঠের মধ্যখানে এই ছাতিম বৃক্ষতলে বসে ধ্যান করে শান্তি পেয়ে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সেখানে ১৮৬৩ সলের ৩১ মার্চ সিংহপরিবারের কাছ থেকে এখানে কুড়ি বিঘা জমি পাঁচ টাকায় পাট্টা নিলেন এবং ‘শান্তিনিকেতন’ নামে একটি গৃহ প্রস্তুত করালেন, ও মাঝেমধ্যে এখানে এসে নির্জনবাস করতে আরম্ভ করলেন—যেখানে ১৯২১ সালের ২২ ডিসেম্বর ‘বিশ্বভারতী’র উদ্বোধন করলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিশ্বভারতীর স্নাতকোত্তর প্রমাণপত্রের প্রতীকস্বরূপ প্রাচীন সেই সপ্তপর্ণী বৃক্ষটির পত্র দেওয়া হতো।
ছাতিমের বীথি অপরূপ হয়। তবে এর মূল তত ঝড়সহ নয়, শিমুলের চেয়ে দৃঢ় হলেও। জীবনানন্দ দাশের হৈমন্তী উচ্চারণ অবশ্যই স্মৃতিধার্য:
যদি আমি ঝরে যাই একদিন কার্তিকের নীল কুয়াশায়:
যখন ঝরিছে ধান বাংলার ক্ষেতে ক্ষেতে ম্লান চোখ বুজে,
যখন চড়াই পাখি কাঁঠালীচাঁপার নীড়ে ঠোঁট আছে গুঁজে,
যখন হলুদ পাতা মিশিতেছে খয়েরী পাতায়...
হেমন্তের দুই প্রধান ফুলের শোভা উপভোগ করার সুযোগ হয় না আমাদের। এরা নিশিপুষ্প। ভোরের আলো ফোটার আগেই ঝরে পড়ে গাছতলায়। একটি ধারমার বা পীতপাটলা, অন্যটি আকাশনীম বা হিমঝুরি। গাছে ফোটা তাজা ফুল দেখতে হলে ঢাকাবাসীদের রাতেই যেতে হবে রমনায়। ভোরে অসংখ্য বাসিফুল দেখা যায় গাছতলায়। ধারমার (Stereospermum personatum) বা পীতপাটলার মাত্র দুটো গাছ দেখা যায় রমনা নার্সারিতে। পত্রমোচী এবং লম্বাটে একহারা গড়নের এই বৃক্ষের ঢাকায় অনুপস্থিতির কারণ আমাদের অজানা। অথচ এটি বাংলাদেশ এবং মধ্য ও দক্ষিণ ভারতের প্রজাতি। হেমন্তের মাঝামাঝি সময়ে এই ফুল ফোটে। ফুল খাটো, ঘণ্টাকার, সুগন্ধি, দলনলের গোড়া লাল, পাপড়ি হলুদ, তাতে লাল রঙের দাগ।

বাংলার প্রধান ভোজ্য ধান-চাল আর প্রধান চর্ব্য পান সবই প্রধানত হেমন্তেরই দান। অথচ এই হেমন্ত ঋতুটিই উপেক্ষিত, শুধু এর চটকদার ফুলের বাহার নেই বলে। এক ছাতিমের বাহারই তো যথেষ্ট। ছাতিমের মতো দিকে দিকে এত দূরদূর পর্যন্ত আগমনী সৌরভ ছড়িয়ে আত্মপ্রকাশ করে তেমন দ্বিতীয় কোনো ফুল আছে কি এ দেশে? এ ছাড়া প্রায় বারোমেসে রূপসী বকফুল আর অগ্নিশিখা বা উলটচন্ডাল তো সবচেয়ে বেশি ফোটে এই পুষ্পরিক্ত হেমন্তেই। হেমন্তে ফোটা ফুল বিলাতি ঝাউয়ের রূপ তেমন চোখে পড়ে না তার অগ্রগণ্য রূপসী তরুটির কারণে—যে-তরুর শাখান্তের গুচ্ছ-গুচ্ছ চিরহরিৎ ফলক-নির্ঝর এবং দীর্ঘশ্বাসের মতো রহস্যময় স্বনন কেমন যেন হতাশ-উদাস-করা।
এসব বাদে এক পানের বাহারেই কেল্লা ফতে হতে পারে হেমন্তের, যেহেতু বছরের সেরা পানের ফসল এ ঋতুরই দান। সাধারণত বছরে পানের তিনটি ফলন হয় এবং আহরণের মাস কার্তিক, ফাল্গুন ও আষাঢ়। পানসেবীদের বিচারে কার্তিকের পান শ্রেষ্ঠতম এবং আষাঢ়ের পান নিকৃষ্টতম। পান হলো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের একপ্রকার গুল্মজাতীয় গাছের পাতা। নিঃশ্বাস সুরভিত করা এবং ঠোঁট লাল করার জন্য এ দেশের মানুষ আবহমানকাল থেকেই পান খায়।
পানকেই বলা যায় নারীর প্রাচীনতম লিপস্টিক। অবশ্য পানের বর্ধিত আনন্দের দিকটি হলো এর মৃদুমন্দ মাদকতা। পান দিয়ে যেমন স্বাগতম জানানো হয় অতিথিকে, তেমনি তাঁর প্রস্থানের সময়ও ইঙ্গিত করা হয়। একসময় উৎসব, পূজা ও পুণ্যাহে পান ছিল অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রাচীন অভিজাত জনগোষ্ঠীর মাঝে পান তৈরি এবং তা সুন্দরভাবে পানদানিতে সাজানো লোকজ শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি পেত। বাংলাদেশের বহু লোক-ছড়া ও প্রবাদ-প্রবচনে পান-সুপারির কথা আছে।
ফলের ঋতু হেমন্তের দুটি বিশিষ্ট ফল কামরাঙা, চালতা আর শ্রেষ্ঠ উৎসব নবান্নের কথা বলেই শেষ করব অকিঞ্চিৎকর এই হৈমন্তী নিবেদন। কামরাঙা দারুণ সুশ্রী তরু। কান্ড নাতিদীর্ঘ, শাখায়িত এবং দীর্ঘ ছত্রাকৃতি, কচিপাতা তামাটে লাল এবং এ জন্য নতুন পাতাভরা কামরাঙা গাছ রক্তিম। এই গাছ কোনো সময়ই একেবারে নিষ্পত্র হয় না বলে সবুজ ও তামাটে পাতার মিশ্রণে কামরাঙা গাছ সারা বছরই দেখতে রূপসী। বৈশাখ-শ্রাবণে প্রস্ফুটন। লালচে রঙের ফুলের প্রাচুর্য না থাকলেও বিক্ষিপ্ত মঞ্জরি সৌন্দর্যে নতুন ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে। কামরাঙার ফল ডিম্বাকৃতি, মাংসল, পাঁচ শিরাবিশিষ্ট। কাঁচা ফল সবুজ, পাকা ফল হালকা হলুদ। ফল পাকার সময় হেমন্তকাল।
আর চালতা? বিষ্ণু দে বলেন—‘আকাশ নীলের তারাখচা পথে বৃষ্টি পড়ে চালতা ফুলে ফলের বাগান মদির করে’।
চালতা হলো কুসুমেরই রূপান্তরিত ফল। আসলে চালতা ফলই নয়, সবটাই ফুল। এই ফুল ফোটে বর্ষায়। বর্ষাজাত চালতা ফল ফুলের গর্ভে অবস্থান করে। এই ফুল ও ফল অভিন্ন। চালতা ফুলের পাপড়িগুলোই সবুজ হয়ে যায়, তারপর মোটা হয়ে বাড়তে থাকে এবং ফলের আকার নেয়। বাঙালির কাছে চালতা ফুলের চেয়ে ফলই অধিক প্রিয়। পাতার প্রখর ঘন সবুজ রঙের পাশে ফুল হয় বড় বড়। ফুলের বৃতির রং সবুজ ও মাংসল। বর্ষার এই বৃতিই হেমন্তে ফলে রূপান্তরিত হয়ে পাকে।
চালতার অনেক গুণ। ইলিশের অম্বল ছাড়াও চালতা-ডাল অমৃত। এ ফলের ভেষজ গুণ বহুবিধ। জ্বর-কাশি থেকে মূর্ছা রোগের ধন্বন্তরি এই চালতা। এ ছাড়া শুক্রাল্পতায়, স্তনাল্পতায়, কেশাল্পতায়, ও যাবতীয় দৌর্বল্যে চালতা হিতকারী। মচকে যাওয়া ব্যথায়, থমকে যাওয়া ফোঁড়ায় এবং খাদ্যের বিষক্রিয়ার চিকৎসায় বিশেষ উপকারী এই হৈমন্তী ফলটি। ভাবী জীবনকে সম্ভবনাময় করে দিতে পারে বলেই কি এর কবিরাজি নাম ‘ভব্য’?
নবান্নের উল্লেখ ছাড়া হেমন্তের কথা শেষ হয় না। আবহমান বাংলার শস্যভিত্তিক বড় মাপের একটি লোক-উৎসব হলো নবান্ন। এ উৎসব প্রচলনের প্রধান কারণ অধিক শস্য, অধিক সন্তান ও অধিক পশুসম্পদ কামনা। প্রধান শস্য সংগ্রহকে কেন্দ্র করে অগ্রহায়ণ মাসের শেষে হেমন্ত ঋতুতেই এ উৎসব পালিত হতো। একসময় বহুল প্রতীক্ষিত এ উৎসবটিকে ঘিরে পিঠা-পায়েসের আদান-প্রদান আর দলে দলে আত্মীয়স্বজনের আগমন-নিষ্ক্রমণে পল্লির প্রতিটি গৃহের পরিবেশ হয়ে উঠত মধুময়।
যুগ বদলায়। প্রধানত উচ্চফলনশীল বীজ আর সেচ-প্রযুক্তির সাহায্যে নিবিড় রোপা আমন ফসল স্থানে স্থানে প্রায় সাংবৎসরিক হয়ে যাওয়ার কারণে অঘ্রান মাসের বিশেষ ফসলি উৎসবটির তাৎপর্য স্বভাবতই কমে আসে। ধীরে ধীরে ফিকে হতে হতে নবান্ন উৎসব এখন শুধুই স্মৃতি। শ্রুতিতে আর পাঠে থাকে শুধু জীবনানন্দ দাশ :

হেমন্ত
আজ রাতে মনে হয়
সব কর্মক্লান্তি অবশেষে কোনো এক অর্থ শুষে গেছে।
আমাদের সব পাপ—যদি জীব কোনো পাপ করে থাকে পরস্পর
কিংবা দূর নক্ষত্রের গুল্ম, গ্যাস, জীবাণুর কাছে—
গিয়েছে ক্ষয়িত হয়ে।
বৃত্ত যেন শুদ্ধতায় নিরুত্তর কেন্দ্রে ফিরে এল
এই শান্ত অঘ্রানের রাতে।
... ... ...
বাংলার শস্যহীন ক্ষেতের শিয়রে
মৃত, বড়ো, গোল চাঁদ;
গভীর অঘ্রাণ এসে দাঁড়ায়েছে।
অনন্য যোদ্ধার মতো এসেছে সে কত বার
দিনের ওপারে সন্ধ্যা— ঋতুর ভিতরে প্লাবী হেমন্তকে
দৃষ্ট প্রত্যঙ্গের মতো এই স্ফীত পৃথিবীতে
ছুরির ফলার মতো টেনে নিয়ে।
বেবিলন থেকে বিলম্বিত এস্্প্লানেডে
বিদীর্ণ চীনের থেকে এই শীর্ণ এককড়িপুরে
মানুষের অরুন্তুদ চেষ্টার ভিতরে।
শ্রবণেও থাকে কদাচিৎ কোনো সমকালীন সুকবির শুদ্ধ উচ্চারণে, যেমন কৃষ্ণ ধরের ‘হেমন্তেই কথা বলার সময়’ কবিতার মৃদু ভাষণে :
... ... ...
সব হেমন্তেই নবান্নের উৎসব হয় না
এ কথাটাও মনে রাখতে হয়

জমাট বাঁধা কথাগুচ্ছ দরজার বাইরে অপেক্ষায় থাকে
কথাচ্ছলে যা বলা হয়েছে
তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখছে নিজেদের
যারা ছিল নীরব শ্রোতা এবার তারা কথা বলবে
হেমন্তেই কথা বলার সময়।
[সৃষ্টির একুশ শতক, উৎসব সংখ্যা, ১৪১৯, কলকাতা]

No comments

Powered by Blogger.