স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ, না কেন্দ্রীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ?

এক. 'স্থানীয় সরকার প্রকৌশল' তথা এলজিইডির নাম শুনে অনেকে মনে করেন, এটি স্থানীয় সরকারের অধীন কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম। কিন্তু বাস্তবে এটি স্থানীয় সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠান নয়, এটি কেন্দ্রীয় সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি বিভাগের নাম।


এ কারণে এর নাম স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ না হয়ে 'কেন্দ্রীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ' হওয়াই বাঞ্ছনীয় ছিল বলে অনেকে মনে করেন।
দুই. এ দেশে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, বিভাগ নামে বহু স্তরবিশিষ্ট স্থানীয় ইউনিট রয়েছে। এগুলোর মধ্যে পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ও জেলা পরিষদের নিজস্ব প্রকৌশলব্যবস্থা বিদ্যমান। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড ও বিভাগের কোনো নিজস্ব প্রকৌশলব্যবস্থা নেই। ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড এলাকায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রকৌশলীরা কাজ করে থাকেন। অন্য ইউনিটগুলোয় এলজিইডি কাজ করছে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ১২ কোটি লোক ইউনিয়নে তথা গ্রামীণ এলাকায় বসবাস করছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ প্রধানত গ্রামীণ রাস্তাঘাট উন্নয়নে নিয়োজিত। তবে এ বিভাগ নগর এলাকায় রাস্তাঘাট, ফ্লাইওভার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের কাজও করছে। এ দেশের বহু লেখক-বুদ্ধিজীবী ও আমলার মতে, তৃণমূল জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে যদি কোনো বিভাগ কাজ করে, তাহলে সেটির নাম 'এলজিইডি'। আবার তাঁরা একই মুখে তৃণমূল মানুষের ক্ষমতায়নে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালীকরণের কথাও বলেন। কিন্তু স্থানীয় গণতান্ত্রিক সরকারের দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে এই বিভাগের কারণে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মতামত যে ব্যাপকভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে, অর্থাৎ 'বটম-আপ' পদ্ধতির বিপরীতে 'টপ-ডাউন' পদ্ধতি আরো জোরদার হয়েছে, এটা তারা বুঝতেই চান না। কৌতূহলের বিষয় হলো, এলজিইডির প্রধান রূপকার মরহুম কামরুল ইসলাম সিদ্দিক নিজেই স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠান জেলা বোর্ডের অধীনে চাকরিতে যোগদান করেছিলেন। তবে তিনি জেলা বোর্ডকে শক্তিশালী করার পথে যাননি। বরং এটি থেকে বের হয়ে কিভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন হওয়া যায়, তথা গ্রামীণ স্থানীয় কাজগুলোকে কিভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে নেওয়া যায় সে চেষ্টাই করেছেন। আর এটির উদাহরণ কাজে লাগিয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, গণপূর্ত অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর ইত্যাদিও একই পথে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
তিন. ব্রিটিশ সরকার তার শাসন পরিচালনার স্বার্থে ১৭৭২ সাল থেকে বাংলায় ২৩টি জেলা গঠন করে প্রতিটিতে একজন করে ব্রিটিশ কালেক্টর নিয়োগ করে। সেই থেকে জেলা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক স্তর হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। সে সময় বঙ্গীয় স্বায়ত্তশাসন আইন ১৮৮৫ প্রবর্তনের মাধ্যমে জেলা পর্যায়ে 'জেলা বোর্ড' গঠন করা হয়। জেলা বোর্ডের অধীনে প্রাথমিক শিক্ষা, পল্লী এলাকায় সড়ক ও পুল নির্মাণ, জনস্বাস্থ্য এবং পয়োনিষ্কাশন ইত্যাদি পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। পাকিস্তান আমলে ১৯৫৯ সালে মৌলিক গণতন্ত্র আদেশ অনুযায়ী জেলা বোর্ডের নামকরণ করা হয় 'জেলা কাউন্সিল'। জেলা কাউন্সিলের দায়িত্বাবলির মধ্যে ছিল সড়ক, ভবন, হাসপাতাল, ডিসপেনসারি, স্কুল ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য ও পয়োপ্রণালি, নলকূপ, ডাকবাংলো সংরক্ষণ ও জেলার অন্তর্গত স্থানীয় পরিষদগুলো পরিচালনা করা। সে জন্য বলা হয়, পরাধীন আমলে স্থানীয় সরকারের যতটুকু ক্ষমতা ছিল, স্বাধীন দেশে সেটিকে আরো অগ্রসর না করে অর্থাৎ কার্যকর ও শক্তিশালী না করে, বরং আগের ক্ষমতাটুকুও কেড়ে নেওয়া হয়। অবশ্য এর জন্য রাজনীতিবিদরাই প্রধানত দায়ী বলে প্রতীয়মান হয়। তবে বহু আমলা কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা বাস্তবায়নের পক্ষে তাঁদের মেধা ব্যয় করেছেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এ প্রসঙ্গে এলজিইডির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. শহীদুল হাসানের 'তৃণমূল মানুষের প্রকৌশল' শীর্ষক একটি লেখার কিছু অংশ তুলে ধরা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, 'কামরুল ইসলাম সিদ্দিক ১৯৬৬ সালে বুয়েট থেকে পাস করে ১৯৬৭ সালে কুষ্টিয়া জেলা বোর্ডে পূর্ত কর্মসূচি শাখায় সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ... স্বাধীনতার পর খুলনা মিউনিসিপ্যালিটিতে পূর্ত শাখায় যোগদান করেন। ... স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পূর্ত কর্মসূচি সেল গঠিত হলে সেখানে নির্বাহী প্রকৌশলী পদে যোগ দেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অস্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠিত ও দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন, বৃদ্ধি ও বিপণনের প্রসার ঘটাতে হবে। গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে ইত্যাদি। ... তাঁর প্রচেষ্টায়ই ১৯৮২ সালে প্রশাসনিক পুনর্গঠন ও বিকেন্দ্রীকরণকল্পে সরকার পূর্ত কর্মসূচির বিভিন্ন স্তরে কর্মরত লোকবল একক কাঠামোয় আনতে পূর্ত কর্মসূচি উইং সৃষ্টি হয়। কিন্তু অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য না হওয়ায় এর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। তিনি না দমে গিয়ে রাজস্ব খাতে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর নামে একটি স্থায়ী সংস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যান। ১৯৮৪ সালে প্রাথমিক সাফল্য অর্জন করেন এবং রাজস্ব খাতে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল ব্যুরো বা এলজিইবি নামে স্বতন্ত্র সংস্থা প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। পরবর্তী সময়ে এর নাম হয় এলজিইডি। ১৯৯৬ সালের মধ্যে সব জেলায় নিজস্ব অফিস ও বাসভবন কমপ্লেক্স নির্মাণ সম্পন্ন হয় (সমকাল, ১ সেপ্টেম্বর ২০১০)।
কোনো কাজে সফল হতে হলে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে অগ্রসর হতে হয়। কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের লক্ষ্য ছিল- জেলা বোর্ডে কর্মরত প্রকৌশলীদের কেন্দ্রীয় সরকারে নিয়ে যাওয়া, বেকার প্রকৌশলীদের চাকরি দেওয়া এবং তাদের রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্ত করা। সে ক্ষেত্রে তিনি শতভাগ কৃতকার্য হয়েছেন বলা যায়। এর সঙ্গে স্থানীয় সরকার কার্যকর হওয়া, তথা স্থানীয়দের ক্ষমতায়নের কী সম্পর্ক তা সংগত কারণেই বোধগম্য নয়। তিনি গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য নিজের মতো করে বহু প্রকল্প সৃষ্টি করেন এবং সেসব প্রকল্পে বেকার যুবকদের চাকরি প্রদান করেন। কিন্তু সংস্থাপন মন্ত্রণালয় (বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়) ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া সরকারি চাকরির পদ সৃষ্টি করা ও নিয়োগ দেওয়া যায় না। কামরুল ইসলাম সিদ্দিক সেসব নিয়মের কোনো তোয়াক্কা করেননি। বেকার যুবক-যুব মহিলারা (কন্যা দায়গ্রস্ত ব্যক্তিরাসহ) তাঁর মনে করুণার উদ্রেক করতে পারলেই তিনি তাঁদের একটি গতি করেছেন। তাঁর বিধিবহির্ভূত নিয়োগযজ্ঞ পরবর্তীকালে বহু সমস্যার সৃষ্টি করে। প্রকল্প শেষ হওয়ার পর নিয়োগপ্রাপ্তরা উচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। জেলা ও উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের সঙ্গে তাঁদের বেতন-ভাতা নিয়ে দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদ লেগেই আছে। জনৈক বিশেষজ্ঞ এ প্রসঙ্গে বলেন, 'এলজিইডি স্থানীয় সরকারের কাজে না লাগলেও বেকারদের উপকার করেছে।' একটি উপজেলার এলজিইডি অফিস পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে- একজন প্রকৌশলী, একজন সহপ্রকৌশলী, তিনজন উপসহকারী প্রকৌশলী, একজন নকশাকার, একজন সার্ভেয়ার, চারজন ওয়ার্ক অ্যাসিস্ট্যান্ট, একজন কমিউনিটি অর্গানাইজার, একজন অফিস সহকারী, একজন হিসাবরক্ষক, চারজন এমএলএসএস এবং মাস্টাররোলে তিনজন ওয়ার্ক অ্যাসিস্ট্যান্ট, দুজন অফিস সহকারী ও একজন সার্ভেয়ার (তাঁরা তাঁদের চাকরি স্থায়ীকরণের জন্য ইতিমধ্যে মামলা করেছেন)- সব মিলে ২৫ জন কর্মরত রয়েছেন।
চার. সরকারের দিক থেকে অভিযোগ হলো, উপরোক্ত পদাধিকারীদের তাঁদের কাজের বিপরীতে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। সে জন্য তাঁরা একজনের কাজ তিনজনে মিলে সম্পন্ন করেন এবং অবশিষ্ট সময় গল্প-গুজব করে ব্যয় করেন। অথচ ইউনিয়ন পরিষদে রয়েছেন মাত্র একজন সচিব, যাঁকে অন্তত ১০ জন কর্মচারীর সমপরিমাণ কাজ করতে হয়। ইউনিয়ন পরিষদে দেওয়া বরাদ্দের, যেমন- থোক বরাদ্দ, এডিপি, এলজিএসপি, ১ শতাংশ ভূমি হস্তান্তর কর, হাট-বাজার রাজস্ব আয় ইত্যাদি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে এলজিইডির কাছ থেকে প্রাক্কলন (এস্টিমেট) প্রস্তুত ও অনুমোদন নিতে হয়। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, নির্দিষ্ট অঙ্কের পার্সেন্টেজ ছাড়া ওই প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী ও কর্মচারীরা কোনো প্রাক্কলন তৈরি এবং বিল প্রদান করেন না। এলজিইডি স্থানীয় সরকারের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হলেও ঠিকাদারদের সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষা করে চলে। এখানে উল্লেখ না করলেই নয়, এ নিবন্ধের লেখকদের একজন কামরুল ইসলাম সিদ্দিকের মৃত্যুর তিন মাস আগে তাঁর সঙ্গে সরাসরি উল্লিখিত অভিযোগ নিয়ে মতবিনিময় করেছেন। তিনি অবশ্য এলজিইডির পদ্ধতিগত ত্রুটির কথা স্বীকার করেছিলেন।
পাঁচ. স্থানীয়দের উন্নয়নে স্থানীয় সরকার কার্যকর থাকে- এটি গণতান্ত্রিক বিশ্বে একটি স্বীকৃত বিষয়। কিন্তু এ দেশের স্থানীয় সরকারগুলো স্বাধীন ও স্বশাসিত না হওয়ায় এককভাবে স্থানীয় কাজগুলো করার ক্ষমতা রাখে না। ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের নেওয়া বহু প্রকল্প স্থানীয়দের কোনো কাজে আসে না। একই কারণে এলজিইডি কর্তৃক নির্মিত বহু রাস্তা ও ব্রিজ-কালভার্ট পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। সে জন্য দুই ধরনের সরকারব্যবস্থা অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকারব্যবস্থা ও স্থানীয় সরকারব্যবস্থা বাস্তবায়ন করে স্থানীয় কাজগুলো স্থানীয় সরকারের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। তখন স্থানীয় সরকারগুলো তাদের প্রয়োজন অনুসারে জনবল নিয়োগ করবে। সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনে এলজিইডির অপ্রয়োজনীয় কর্মচারীদের স্থানীয় সরকারগুলোয় হস্তাস্তর করা যেতে পারে। এরূপ ব্যবস্থা গৃহীত হলে স্থানীয় সরকারগুলো আর উপহাসের পাত্র হবে না। কেন্দ্রীয় সরকারের মতো এগুলোও আলাদা সরকার হিসেবে গণ্য ও সমাদৃত হবে।
লেখক : চেয়ারম্যান, জানিপপ; বিসিএস শিক্ষা এবং সদস্য, সিডিএলজি

No comments

Powered by Blogger.