শান্তির বিশ্ব গড়তে ঐক্যবদ্ধ হোন by মুফতি শায়খ আবদুল আজিজ বিন আবদুল্লাহ

হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বিদায় হজের সময় আরাফার ময়দানে উপস্থিত সাহাবিদের উদ্দেশে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ প্রদান করেন। এই ভাষণে তিনি ইসলামের পরিপূর্ণতা ঘোষণা করাসহ জীবন পরিচালনায় ইসলামের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন।


বিদায় হজের ভাষণের অনুকরণে সমবেত হাজিদের উদ্দেশে প্রতি বছর হজের দিন খুতবা দেওয়া হয়। গত ২৫ অক্টোবর বুধবার ২০১২ তারিখে ১৪৩৩ হিজরির হজ উপলক্ষে আরাফার ময়দানে অবস্থিত মসজিদে নামিরা থেকে চলমান বিশ্বের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে হজের খুতবা প্রদান করেন সৌদি আরবের গ্রান্ড মুফতি শায়খ আবদুল আজিজ বিন আবদুল্লাহ। খুতবার গুরুত্বপূর্ণ অংশ পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করা হলো


আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহতায়ালার জন্য। আমি তারই প্রশংসা করছি। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, হজরত মোহাম্মদ (সা.) তার বান্দা ও তার পক্ষ থেকে প্রেরিত পুরুষ (রাসূল)। কামনা করছি, তার প্রতি, তার পরিবার-পরিজন ও তার সাহাবিদের প্রতি কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর পক্ষ থেকে অবারিত রহমত বর্ষিত হোক। এরপর তিনি বলেন,
হে মানবমণ্ডলী!
ইসলাম শান্তির ধর্ম। এখানে সন্ত্রাসের কোনো স্থান নেই। ইসলামে শুধু মানবাধিকার নয়, পশুর অধিকার সম্পর্কেও বলা হয়েছে। ইসলাম সাদা-কালো, ধনী-গরিবের মধ্যে কোনো পার্থক্য করেনি। ঐতিহ্যগতভাবে ধর্মীয় সভ্যতাই উৎকৃষ্ট। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করার কথাও বলা হয়েছে ইসলামে। খুতবায় তিনি কোরআন-হাদিসের মূলনীতির ভিত্তিতে বিশ্ব মুসলিমকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, পরস্পরের ভেদাভেদ ভুলে শান্তির বিশ্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা!
কিয়ামতের দিন কোনো বান্দার পা এক চুলও নড়বে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে এই প্রশ্নের উত্তর না দেয়, তুমি কার উপাসনা করতে? নবী-রাসূলদের আহ্বানে তুমি কীভাবে সাড়া দিয়েছো? প্রশ্নের প্রথম অংশের উত্তর হবে, 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ'র জ্ঞান অর্জন, তার মৌখিক স্বীকৃতি ও কাজে পরিণতির মাধ্যমে। আর প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশের উত্তর হবে, 'মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ' এই সাক্ষ্যের জ্ঞান অর্জন, মৌখিক স্বীকৃতি প্রদান এবং আদর্শ ও আনুগত্যের ক্ষেত্রে তার পূর্ণ বাস্তবায়নের মাধ্যমে। তাওহিদের এই কালেমার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য নেই। অতএব, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও কাছে প্রার্থনা করা যাবে না। বিপদাপদ দূর করার জন্য আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ডাকা যাবে না। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও জন্য পশু জবেহ করা যাবে না, অন্য কারও নামে মান্নত করা যাবে না। ভালোবাসা, ভয় ও আশা নিয়ে মুমিনের অন্তর একমাত্র আল্লাহ অভিমুখী হবে, অন্য কারও অভিমুখী হবে না।
হে মুসলিম বিশ্বের শাসক ও নেতৃবর্গ!
আপনাদের দায়িত্ব অনেক। পৃথিবীর বুকে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহ আপনাদের ক্ষমতা দিয়েছেন। সুতরাং আল্লাহর বিধান অনুযায়ী শাসন পরিচালনা করুন। যেন আপনারা জনগণকে নিয়ে নিরাপদে বসবাস করতে পারেন। জনগণের প্রতি আপনারা দয়াশীল হবেন। জনগণকে কল্যাণের পথে পরিচালিত করুন। বিপদগামী পথ থেকে তাদের হেফাজতে রাখুন। জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখুন, শত্রুর ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে তাদের সতর্ক করুন।
আপনাদের গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো যেন মুসলিম উম্মাহর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করে। উম্মাহর জীবনে সমৃদ্ধি আনার পথে কাজ করে। উম্মাহকে তার আকিদার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত রাখে। উম্মাহকে একতাবদ্ধ রাখতে আপনারা সচেষ্ট হোন। যাবতীয় বিপদাপদের হাত থেকে উম্মাহকে রক্ষা করুন। আপনাদের গৃহীত সিদ্ধান্ত যেন মুসলমান ও মানবতার কল্যাণে হয় সে সম্পর্কে সতর্ক থাকবেন।
সন্তানের বাবা-মায়েরা!
আপনাদের সন্তানদের ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়ন করুন। আপনাদের কাছে দেওয়া আমানত রক্ষা করুন। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'মানুষের জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে গাফিলতি করবে না। যার ওপর যে দায়িত্ব এসেছে আল্লাহ প্রত্যেককে তার সে দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। এমনকি পরিবারের কর্তাব্যক্তিকে তার অধীনদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হবে।' আপনারা যারা বাবা হয়েছেন, তারা সন্তান প্রতিপালনে নজর দিন। তাদের সামনে নিজেকে উত্তম আদর্শ হিসেবে পেশ করুন। তাদের অন্তরে সঠিক আকিদা প্রোথিত করুন। তাদের মনে ইমানের বীজ বপন করুন। পাপের কাজ থেকে তাদের দূরে রাখুন। তাদের ইবাদত-বন্দেগি করার ও ইসলামী আচার-আচরণ মেনে চলার নির্দেশ দিন।
সম্মানিত আলেম সমাজ!
জনসাধারণের মাঝে কোরআন-হাদিসের সঠিক জ্ঞান পেঁৗছে দেওয়ার বিশাল দায়িত্ব আপনাদের ওপর ন্যস্ত। তাই সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন। ইসলামের সৌন্দর্য তাদের সামনে তুলে ধরুন। অশালীন সব কাজ থেকে মুসলিম সমাজকে বারণ করুন। শত্রুর ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তাদের সতর্ক করুন। সাধারণ মুসলমানদের সঙ্গে আলেমদের সম্পর্ক হলো অনুকরণ ও অনুসরণের। মুসলমানরা আলেমদের সম্মান করবে, শ্রদ্ধা করবে। তবে তারা আলেমদের এমন মনে করবে না যে, আলেমরা বিধান বানানোর অধিকার রাখেন, নিজের পক্ষ থেকে হালাল-হারাম ঘোষণার অধিকার রাখেন। এ কথাও মনে করবে না যে, আলেম সমাজ মানবীয় দুর্বলতার ঊধর্ে্ব।
মুসলিম সমাজ!
সঠিক ও নির্মল উৎস থেকে জ্ঞান গ্রহণ করবে। আমলওয়ালা আলেমদের শ্রদ্ধা করবে। বিকৃত চিন্তাধারা এবং সন্দেহাপন্ন ও চটকদার স্লোগানদারি সব পথ ও মত থেকে দূরে থাকবে; যদিও বাহ্যিকভাবে এসব স্লোগানদারিরা পরহেজগারি প্রকাশ করে থাকে। সবকিছুর আগে নিজের ধর্ম রক্ষার জন্য কাজ করবে, তারপর স্বদেশের হেফাজত করবে।
সম্মানিত ব্যবসায়ীবৃন্দ!
হালাল রুজির অন্বেষণ করা শরিয়তে প্রশংসিত কাজ। সুতরাং আল্লাহর জন্য নিষ্ঠাবান হয়ে কাজ করুন। যাবতীয় জালিয়াতি ও প্রতারণা থেকে বেঁচে থাকুন। সকল প্রকার হারাম লেনদেন পরিহার করে সম্পদকে পবিত্র রাখুন। কারণ এসবের বিস্তারের মাধ্যমে স্বভাব-চরিত্র নষ্ট হয়ে যায়। হারাম সম্পদকে পরিশোধনের মাধ্যমে হালাল বলে ঘোষণা দেওয়ার যেসব খবর আজকাল আমরা শুনতে পাচ্ছি, তা থেকে সাবধান! সাবধান!
হে সাংবাদিক সমাজ!
আপনাদের বলা হয় জাতির বিবেক। অতএব, আল্লাহকে ভয় করুন। বিশ্বস্ততার সঙ্গে সংবাদ পরিবেশন করুন। সঠিক তথ্য তুলে ধরুন। বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকুন। আপনাদের মিডিয়াকে কল্যাণকর পথে পরিচালিত করুন। গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়ে ইসলামবিদ্বেষী লেখা ও ইসলামী চিন্তাধারাবিরোধী প্রোগ্রাম সম্প্রচার করা থেকে বিরত থাকুন। আপনাদের মিডিয়া যেন হয় মুসলিম উম্মাহর পক্ষের শক্তি, ইসলামের পক্ষ হয়ে যাবতীয় অনাচারমূলক কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদকারী।
প্রিয় বিশ্ব নেতৃবৃন্দ!
আসুন সবাই মিলে পাঁচটি মৌলিক অধিকার রক্ষা করি। যে পাঁচটি অধিকার রক্ষার ব্যাপারে সব আসমানি ধর্ম একমত। সেগুলো হলো, ধর্ম রক্ষার অধিকার, সম্পদ রক্ষার অধিকার, ইজ্জত রক্ষার অধিকার, জীবন রক্ষার অধিকার ও বিবেক-বুদ্ধি রক্ষার অধিকার। আসুন আমরা এ অধিকারগুলো নিশ্চিত করি। জুলুম-অত্যাচারকে প্রতিরোধ করি। উন্নত আদর্শ ও উত্তম চরিত্রের ওপর গুরুত্ব আরোপ করি। পরিবারগুলোকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করি। ডিক্টেটরশিপের মাধ্যমে, গণবিধ্বংসী অস্ত্র দিয়ে নিরাপত্তা টিকিয়ে রাখা যায় না। দেশ দখল ও পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্ত দিয়ে নিরাপত্তা অটুট রাখা সম্ভব নয়। অবরোধ, অনাহার, অধিকার হরণের ফলাফল কখনোই কল্যাণকর নয়। এগুলোর ফলে শত্রুতা আরও তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। সমস্যা জটিল আকার ধারণ করে। মনে রাখবেন, আল্লাহর চিরায়ত নিয়ম হলো_ 'অত্যাচার' সভ্যতা ধ্বংসের এবং জাতিগুলোর পতনের মূল কারণ। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'নিশ্চয় আল্লাহ অত্যাচারীকে সুযোগ দিতে থাকেন। কিন্তু যখন তাকে পাকড়াও করেন তখন তাকে রক্ষা করার আর কেউ থাকে না।' আজ গোটা বিশ্ব জুলুম-অত্যাচার ও যুদ্ধবিগ্রহে চরমভাবে নিষ্পেষিত। আসুন আমরা সবাই মিলে এসব আতঙ্ক থেকে বিশ্ববাসীকে নিরাপদে রাখি। এসব ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে তাদের মুক্ত করি।

আরব নিউজ থেকে ভাষান্তর
মুফতি এনায়েতুল্লাহ
 

No comments

Powered by Blogger.