স্রোতস্বিনী ব্র্রহ্মপুত্র মরে যাচ্ছে! by এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান

স্রোতস্বিনী ব্রহ্মপুত্র মরে যাচ্ছে! ঘাটে ঘাটে চর, যেন এক মরুদ্যান। মৃয়মাণ হয়ে পড়েছে ব্রহ্মপুত্রের রূপ-যৌবন আর লাবণ্য। নেই দু’কূল ভাঙা উত্তাল স্রোতের রাশি। এ নদীর পাড়ে দাঁড়ালে এখন শোনা যায় শীর্ণকায় ব্রহ্মপুত্রের দীর্ঘশ্বাস আর গুমরে উঠা কান্নার শব্দ!

শত শত ট্রাক প্রতিদিন দাপিয়ে বেড়ায় ব্রহ্মপুত্রের বুকে। চলে বালি বাণিজ্য। স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, অব্যাহত পলি পড়ে নদীমাতা ব্রহ্মপুত্র মৃতপ্রায় অবস্থায় উপনীত হয়েছে। ৩ বছরের ব্যবধানে স্থানভেদে নদের তলদেশের উচ্চতা প্রায় ৪ থেকে ৬ মিটার বৃদ্ধি পেয়ে এ নদের নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে।
অন্যান্য নদ-নদীর ক্ষেত্রে উৎসমূখে তলদেশের উচ্চতা বৃদ্ধি না ঘটলেও বিস্ময়করভাবে এ নদের উৎসমুখে গড়ে প্রায় ৬ মিটার তলদেশের উচ্চতা বৃদ্ধি নদটির অস্তিত্বকেই হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।

ব্রক্ষপুত্র নদের উৎপত্তি: ব্রহ্মপুত্র নদের উৎপত্তিস্থল হিমালয় পর্বতমালায়। বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারি সংলগ্ন এলাকা দিয়ে এর প্রবেশ। এক সময়ের স্রোতস্বিনী ব্রহ্মপুত্র নদ থেকেই বর্তমানের যমুনা নদীর উৎপত্তি হলেও বর্তমানে নদটি স্রোতবিহীন আর নাব্যতা সংকটে ভুগছে।

উৎসমুখে জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা থেকে শুরু করে নদের পতিতমুখে কিশোরগঞ্জের ভৈরব পর্যন্ত বিস্তৃত প্রায় আড়াইশ কিলোমটিার দৈর্ঘ্যের নদটি বর্তমানে তেজহীন শীর্ণকায়া।

চীনের পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ’র ভাষ্য মতে, ‘ত্রয়োদশ শতাব্দিতে ব্রহ্মপুত্র গঙ্গার ৩ গুণ ছিল। শেরপুর থেকে জামালপুর পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র ছিল ১০ মাইল প্রশস্ত। সেই সময় এ ১০ মাইল পাড়ি দেয়ার জন্য ‘দশকাহন কড়ি’ নির্দিষ্ট ছিল। সে কারণে শেরপুরের নাম হয় ‘দশকাহনিয়া শেরপুর।’

পাউবো’র জরিপ: পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সার্কেল ময়মনসিংহ অফিসের মারফোলজি উপ-বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, ব্রহ্মপুত্রের উৎসমুখ থেকে পতিতমুখ পর্যন্ত বিশাল এলাকার ৩৬ সেকশানে পাউবো জরিপ করেছে।

নদটির বিভিন্ন সেকশানে ৩ বছরের ব্যবধানে সর্বশেষ করা জরিপে এর উৎসমুখে পলিজমে তলদেশের উচ্চতা গড়ে প্রায় ৬ মিটার ও  গভীর অংশে গড়ে প্রায় ৪ মিটার বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিশেষ করে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের উৎসমুখে অভাবনীয় তলদেশ ভরাট হবার বিষয়টি নদটিকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।

একই সূত্রমতে, ২০০৬-২০০৭ সালের পর ২০০৯-২০১০ সালে করা দু’টি জরিপের মধ্যখানের ৩ বছরের ব্যবধানে পলি জমার রেকর্ড অতীতকে ছাড়িয়ে গেছে এবং নাব্যতা হ্রাসের বিষয়টি বেশ দ্রুত হচ্ছে।

ওই জরিপে দেখা গেছে, ২০০৬-২০০৭ সালে ব্রহ্মপুত্রের উৎসমুখে যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের মিলনস্থলে দেওয়ানগঞ্জের কাজলাপাড়া সেকশনের সবচেয়ে গভীর পয়েন্টে তলদেশের উচ্চতা ছিল ১২.৫০ মিটার, সেখানে একই সেকশানে পলি পড়ে তলদেশ ভরাট হয়ে উচ্চতা হয়েছে ১৮.৩০ মিটার।

উৎসমুখের গভীর অংশের তলদেশ ৩ বছরে ভরাট হয়েছে প্রায় ৬ মিটার। একইভাবে ব্রহ্মপুত্র নদের সবচেয়ে গভীর অঞ্চল হিসেবে পরিচিত ময়মনসিংহ শহরের কোলঘেঁষা সাহেব কোয়ার্টার ও বাকৃবি (বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) সংলগ্ন সেকশানে ৩ বছরের ব্যবধানে তলদেশ ভরাট হয়েছে প্রায় ৪ মিটার।

জরিপে আরো উল্লেখ করা হয়, সাহেব কোয়ার্টার সংলগ্ন সেকশানে তলদেশ ২০০৬-২০০৭ সালে যেখানে ৫.২০ মিটার উচ্চ ছিল সেখানে ২০০৯-২০১০ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৯ মিটার। বাকৃবি সেকশানের গভীর অংশে ২০০৬-২০০৭ সালে তলদেশের উচ্চতা ছিল ৫.৬০ মিটার, তা ২০০৯-২০১০ সালে বেড়ে হয়েছে ৯.৫৬ মিটার।

ব্রহ্মপুত্রের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে পাউবো ময়মনসিংহের মারফোলজি উপ-বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মকবুল হোসেন জানান, ‘বিগত একশ বছর যাবত এই নদে প্রচুর পরিমান পলি জমে এর তলদেশের মাটির উচ্চতা বেড়েই চলেছে। ফলে নদের নাব্যতা হ্রাস ও স্রোতহীনতা দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই প্রবণতা আশঙ্কা জনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।’

ব্রহ্মপুত্র নদ খনন: ব্রহ্মপুত্র নদ খননের বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোন কর্মকর্তাই সরাসরি কথা বলতে রাজি হননি। তবে ময়মনসিংহ-৪-সদর আসনের সরকার দলীয় সংসদ সদস্য প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান বলেন, ‘বিআইডব্লিউটিএ’র সহায়তায় ব্রহ্মপুত্র খননের জন্য একটি মধ্যমেয়াদী প্রকল্পের কাজ চলছে। এ লক্ষ্যে দু’ বছরব্যাপী কনসালটেন্টও নিয়োগ করা হয়। খুব শিগগির খনন কাজ শুরু হবে।’

No comments

Powered by Blogger.