সম্প্রীতি-বিভেদ নয়, ঐক্যই সব ধর্মের সারকথা by গওসল আযম

প্রতিটি ধর্মের গোঁড়ার কথা, ধর্ম মানুষের জন্য। ধর্মের জন্য মানুষ নয়। অন্য কথায় মানুষ ধর্মের চেয়ে বড়। মানুষ হত্যা পাপ, অধর্ম, অন্যায় এবং মনুষ্যত্ব বিনাশী। ধর্মে মিথ্যার স্থান নেই। মা, বাবা, গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধা এবং মা-বাবার প্রতি দায়িত্বশীলতা অর্থাৎ তাদের অক্ষমতার সময়েও নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের লাঘব করে তাদের চলার পথ বা বেঁচে থাকার পথ মসৃণ করা।


সর্বোপরি পরোপকারী হওয়াও ধর্মের অন্যতম অনুষঙ্গ।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, প্রতিটি ধর্ম বিশেষ একটি সময়ে এবং নির্দিষ্ট ভৌগোলিক স্থানে আবির্ভূত হয়েছে মানুষের কল্যাণে। সময়ের দীর্ঘ আবর্তনে বা সময়ের ব্যাপ্ত পরিসরে প্রতিটি ধর্মই হারিয়ে ফেলতে থাকে তার অন্তর্নিহিত মাঙ্গলিক শক্তি বা ঔজ্জ্বল্য। ধর্ম হয়ে ওঠে আচারসর্বস্ব। মানুষের ব্যক্তি, গোত্রগত, বর্ণগত বা শ্রেণীস্বার্থ আচার-সর্বস্বতাকে কেন্দ্র করে প্রথমে অত্যন্ত ক্ষীণ তারতম্য দেখা দেয়। পরে তা দর্শনীয় তারতম্যে রূপ নেয়। এই তারতম্যকে ঘিরে সৃষ্টি হয় একই ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে শতেক বিভেদ, যার ক্রমবর্ধনতায় সৃষ্টি হয়। প্রথমে বিশৃঙ্খলা, পরে মারামারি এমনকি যুদ্ধবিগ্রহ। অশান্তির অব্যাহত দাবানলে মানুষ শান্তির জন্য কাতর হয়ে অন্তরের আকুতি ঢেলে প্রার্থনা জানায় শান্তির জন্য। নতুন ধর্মের আবির্ভাব ঘটে। নতুন ধর্মে পূর্ব ধর্মের বা ধর্মগুলোর নির্গলিত সত্য দর্শন মানুষেরই মঙ্গলার্থে নতুন করে বিবৃত হয়। আবহমানকাল হতে চলে আসা এই পদ্ধতির যারা নায়ক বা প্রাণপুরুষ তারা বড়মাপের মানুষ বা মহামানব। তারা নিষ্কলুষ, নিষ্পাপ, হিংসা-দ্বেষবিবর্জিত, পরোপকারী এবং লোভ-লালসার ঊধর্ে্ব। হাজার হাজার বছর ধরে অনেকেই তাদের সম্পর্কে নানা কূট প্রশ্নের অবতারণা করেছেন, করেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন তাদের অজ্ঞতার কারণে অর্থাৎ সার্বিক দিক থেকে ধর্মকে হৃদয়ঙ্গম করতে না পারার কারণে। কূট প্রশ্নে এবং মন্তব্যে মহামানবদের ঔজ্জ্বল্য হ্রাস প্রাপ্ত হয়নি, হবেও না।
প্রারম্ভেই বলা হয়েছে, মূলত সব ধর্মই এক। বাস্তবতার নিরিখেই এক ধর্ম বিলুপ্ত হয়ে অন্য ধর্মকে স্থান দিয়েছে। ধর্মের মৌলিক বিষয়গুলোরও পরিবর্তন ঘটেনি। কলুষিত করার চেষ্টা করেছে কিছু মানুষ। তার জন্য ধর্ম দায়ী নয়। যারা ব্যক্তি, গোষ্ঠী, বর্ণ, জাতীয় এবং ভৌগোলিক স্বার্থে ধর্মকে পঙ্কিলতার আবর্তে নিক্ষেপ করার চেষ্টা করেছেন, তারাই আজ ধিক্কৃত। ধর্মবিশারদরা তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব এবং তথ্যগুলোর চুলচেরা বিশেল্গষণ করছেন আলাদা আলাদাভাবে, যাতে তাদের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব অন্যান্য ধর্মের ওপর চাপানো যায়। অথচ সর্ব ধর্মবিশারদদের বিভিন্ন ধর্মের অভিন্ন দিক নিয়ে ঐকমত্যে পেঁৗছলে ধর্মের অন্তর্নিহিত বাকি সত্যাসত্যিগুলো বের করতে খুব একটা কষ্টকর হবে বলে মনে হয় না।
বেশ কিছু সমাজবিদ, অর্থনীতিবিদ এবং মানবতাবাদীকর্মী এবং নাস্তিক এই মর্মে মন্তব্য প্রদান করে যে, আর্থিক বিভেদই মানুষের মধ্যে অনৈক্যের মূল কারণ। তাদের এ ধারণার গুরুত্ব অস্বীকার না করে এ কথা বলা যায় যে, আর্থিক বিভেদই মানুষের বিভেদের একমাত্র কারণ নয়। বিভেদের অনেক কারণ আছে। তবে সবচেয়ে বড় কারণ ধর্ম। ধর্মের অপব্যাখ্যাকারীরা ধর্মকে স্বার্থ চরিতার্থ করার কাজে লাগাতে গিয়ে নিজেদের ধিক্কৃত করেছে এবং ধর্মকে করেছে বিভেদের হাতিয়ার। এর প্রশমন অত্যন্ত অত্যাবশ্যকীয়।
ইসলাম ধর্মে পরধর্মীয়দের প্রতি বিদ্রূপ, লাঞ্ছনা এবং হত্যা চাপিয়ে দেওয়ার বিধান আছে বলে অন্তত আমার মতো ক্ষুদ্র জ্ঞানসম্পন্ন মানুষের জানা নেই। এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রেও নারী, শিশু, বৃদ্ধ এবং অন্য ধর্মের পুরোহিতদের হত্যার বিধান নেই। বিশ্বব্যাপী লাদেনরা মনুষ্য হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ইসলামের ঔজ্জ্বল্যকে কালিমালিপ্ত করতে গিয়ে তারা আজ ইসলামের অনুসারীদের কাছেও পরিত্যাজ্য।
শতাব্দী প্রাচীন বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীরা আড়াই হাজার বছর পূর্বের বেশ কিছু বুদ্ধ মূর্তি, যা সম্রাট অশোকের সময়ে নির্মিত তা সংরক্ষণের পাশাপাশি মুসলমানদের সম্প্রীতির সঙ্গে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের রামুতে এবং অন্যান্য জায়গায় বসবাস করে আসছে। অতি সম্প্রতি এ দেশের ক্ষমতালোভী কিছু মানুষের ধর্মীয় অপব্যাখ্যায় প্রকৃত শিক্ষা হতে দূরে থাকা কিছু কুলাঙ্গার ধর্মের অন্তর্নিহিত সত্য অনুধাবন করতে না পারার কারণে দলীয় চাঁইদের নির্দেশে দলীয় লেবাসে বৌদ্ধ বসতি এবং মন্দিরে আক্রমণ চালিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। আড়াই হাজার বছর পূর্বের বুদ্ধ মূর্তি এবং আরও অমূল্য নিদর্শন ভেঙে চুরমার করেছে। তারা তালেবান এবং আল কায়দাদের সহযোগী। তারাই আফগানিস্তানে সংরক্ষিত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বুদ্ধ মূর্তিগুলো পৃথিবীর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে ভেঙে ফেলেছে। বাংলাদেশে তাদের দোসরদের খুঁজে বের করে এক্ষুণি শাস্তি দেওয়ার সময়। প্রয়োজনে কঠোর আইন প্রণয়ন করে শাস্তির আওতায় আনতে না পারলে গোলাম আযমরা আবার অন্ধকারের বিবর থেকে বেরিয়ে এসে বাংলার শতাব্দী প্রাচীন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনাশের চেষ্টা করবে। কাজেই রামুর ব্যাপারে বিচার বিভাগীয় তদন্তের যে দাবি, সরকার সে দাবি মেনে নিয়েই বিচার বিভাগীয় তদন্তের ব্যবস্থা করে স্বচ্ছতার দাবিদার হতে পারে। কারণ, আওয়ামী লীগের অনেক দোষ-ত্রুটি সত্ত্বেও সাম্প্রদায়িকতার দোষে দুষ্ট নয়। তবে আওয়ামী লীগের ভেতরেও আওয়ামী লীগের আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে সম্পদ লোভী কিছু মানুষ সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় নিতে পারে। রামুর ঘটনায় আওয়ামী লীগের লোকজন জড়িত থাকলে তাদেরও শাস্তির আওতায় আনা অত্যন্ত জরুরি। এটা করতে পারলে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হবে। বাহবা দেবে মানুষ।

গওসল আযম : সাবেক মহাসচিব
আইবিবি এবং কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.