লোহার সেতু by মোঃ মোতাহের হোসেন

বলা হয়, ইউরোপের সভ্যতার নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল পাথর দিয়ে। আর জাপানে শুরু হয় কাঠ দিয়ে। যা মোটেও দীর্ঘস্থায়ী নয় এবং সবসময় ঝুঁকিপূর্ণ থাকে। পরবর্তীকালে লোহা ও ইস্পাতের আবিষ্কার এবং ব্যবহার শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জাপান ব্যাপকভাবে এর ব্যবহার শুরু করে।


বলা যায়, জাপানে লোহাকেন্দ্রিক এক সভ্যতা গড়ে ওঠে। সাগর-নদী-পাহাড় শাসন করা, টর্নেডো-সাইক্লোন-ভূমিকম্পের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া, জাহাজ তৈরি করে দেশ ও বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্য স্থাপন এবং আমেরিকা আক্রমণের শক্তি অর্জন করা, মেশিন ও কলকারখানা স্থাপনসহ দৈনন্দিন জীবনেও জাপানিরা লোহাকে যথাযথভাবে কাজে লাগায়। লোহা সম্পর্কে জাপানিদের বক্তব্য হচ্ছে, ঞযব ভধনৎরপ ড়ভ ড়ঁৎ ফধরষু ষরভব. আসলেই তাই, জাপান দেশ এবং জাপানিদের জীবন লোহা ছাড়া ভাবা যায় না। ভারত থেকে আমদানিকৃত লোহা জাপানকে পৃথিবীর অন্যতম ধনী ও শক্তিশালী দেশ হিসেবে গড়ে তোলার পেছনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে, যা জাপানের জনগণ নিদ্বর্িধায় স্বীকার করে। দেশটি আয়তনে খুব বড় দেশ না হলেও এ দেশে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি লোহার ব্যবহার হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। ওসাকাতে সমুদ্রের মধ্যে এক এয়ারপোর্ট বানাতেই ৩৫০ মিলিয়ন টন লোহার ব্যবহার হয়। এ রকম প্রজেক্ট জাপানে শত শত। বহু তালাবিশিষ্ট সব বিল্ডিংই লোহার। শুধু জাপানে নয়, উন্নত সব দেশেই লোহা ও ইস্পাতের ব্যবহার এবং অর্থনীতিতে এর প্রভাব অপরিসীম। যেমন আমেরিকার বর্তমান আর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে ওঠার জন্য বাইরে থেকে লোহা আমদানি না করে নিজের দেশের লোহা ব্যবহারের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। ওদিকে তেল ও গ্যাসের দাম কমে যাওয়ার কারণে রাশিয়া লোহার ও ইস্পাতের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। বেশ কয়েক বছর আগে চীনের প্রেসিডেন্ট জাপানে এসে অনুরোধ করেছিলেন, জাপান যেন চীনে একটা ইস্পাত কারখানা গড়ে দেয়।
আমাদের দেশে যেভাবে প্রাকৃতিক পরিবর্তন ঘটছে তাতে লোহার ব্রিজই বেশি কার্যকর হবে। উদাহরণ দেওয়া যাক। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরপরই (১৯৭৩-৭৪) মানিকগঞ্জের পরে ধলেশ্বরী নদীর ওপর (জানামতে) তখনকার দিনে প্রায় ৪ কোটি টাকা খরচ করে তরার ঘাট ব্রিজ করা হয়। এখন নদীর যে অবস্থা তাতে সেখানে এত বড় ব্রিজ তখন প্রয়োজন থাকলেও এখন নেই। আর এই ব্রিজ যদি কংক্রিটের না হয়ে লোহার হতো, তাহলে এখন এই ব্রিজ ছোট করে বাকি লোহা সরিয়ে অন্য কাজে লাগানো যেত। যেহেতু সোনা, রূপা, তামার মতো লোহা ও ধাতু পদার্থ। কাজেই এটাকে খুলে, ভেঙে, গলিয়ে প্রয়োজনমতো অন্য কিছু নির্মাণ করা যায়। এসব বিবেচনা করে বাংলাদেশে যে কোনো নির্মাণ কাজে কংক্রিটের পরিবর্তে অধিক পরিমাণ লোহা ও ইস্পাতের ব্যবহারের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া যায় কিনা দেশের নীতিনির্ধারণে যারা আছেন, তারা বিষয়টা ভেবে দেখতে পারেন। এটা ঠিক যে, পদক্ষেপ নেওয়ার পরই তখন প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে ওঠে। ইতিমধ্যে জাহাজ নির্মাণে বাংলাদেশ অনেক অগ্রগতি অর্জন করেছে। বলাবাহুল্য, এই লোহার জাহাজ ও কামান নির্মাণের অগ্রগতি দিয়েই একদিন ইউরোপের কিছু দেশ নতুন দেশ আবিষ্কারের নেশায় মেতে উঠেছিল। কলোনি গড়ে তুলে শাসন ও শোষণ করেছিল।
পৃথিবীর সব দেশেই খাল, বিল বা নদ-নদীর ওপর দিয়ে রেলগাড়ি চলার যে শত শত ব্রিজ আছে এর প্রায় অধিকাংশই কংক্রিটের পিলারের ওপর লোহার ব্রিজ। কংক্রিটের পিলার বলতে লোহার রডের মধ্যে সিমেন্ট, বালু, পাথর ভরে দেওয়া। বাংলাদেশের মতো দুই-চারটি রড খাড়া করে দেওয়া নয়। বড় কোনো ব্রিজের ওপর দিয়ে যদি রেললাইন নেওয়া হয় সেক্ষেত্রে রেলগাড়ির ঝাঁকুনি সহ্য করার জন্য লোহার ব্রিজই বেশি কার্যকর। যমুনা সেতুর মতো ফাটল ধরলেও পাকশী ব্রিজে ফাটল ধরার সুযোগই নেই। এ ছাড়া লোহার ও ইস্পাতের ব্যবহারে ইট, পাথর, রড, বালি, সিমেন্ট এত কিছুর দরকার পড়ে না। মেরামত ও পরিচর্যা করা সহজ। খরচ কম পড়ে এবং সর্বোপরি সময় কম লাগে। এসব বিবেচনা করে বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে লোহাভিত্তিক অবকাঠামো গড়ে উঠুক এবং মাওয়া সেতু লোহা ও ইস্পাতের তৈরি (সাসপেনশন) সেতু হোক। পাশাপাশি বাংলাদেশের মধুমতি, কুমার, চন্দনা, বারাসিয়া নদীর মতো নদীগুলোতে আগামীতে যেসব সেতু নির্মাণ করা হবে সেসব সেতুও যেন লোহার হয় এবং চওড়া বেশি করা হয়।
hm.motahar @yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.