হাতিরঝিল প্রকল্প- খেজুর, পামে বিবর্ণ প্রকল্প by ইফতেখার মাহমুদ

ঝিলের দুই পাড়জুড়ে থাকবে হিজল, কৃষ্ণচূড়া, জারুল, শিমুল, দেবদারু আর পলাশের ছায়াবীথি। ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলাবে পাতার রং। বড় গাছের নিচে থাকবে দেশি ফুলের গাছ আর লতাগুল্ম। তাতে একেক ঋতুতে একেক জাতের ফুল ফুটবে।


ঝিলের পানিতে ফুটবে পদ্ম ও শাপলা। শীতকালে অতিথি পাখিদের সমাগম হবে ঝিলে। ধূসর শহর ঢাকার ঠিক মাঝখানে ১১ কিলোমিটারব্যাপী সবুজের এমন সমারোহের স্বপ্নকল্প ছিল পরিকল্পনায়।
কিন্তু হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকায় গেলে এই পরিকল্পনার দেখা মিলবে না। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সড়ক দিয়ে প্রকল্প এলাকায় ঢুকতেই ধূসর আর তামাটে বর্ণের মরমর গাছের সারি চোখে পড়বে। বয়স্ক বড় বড় পাম, আর খেজুরগাছ অন্য জায়গা থেকে তুলে এনে এখানে লাগানো হয়েছে। ঝিলের পাড় আর বেইলি সেতুতে রোপণ করা হয়েছে বিদেশি ঝাউগাছ আর ক্রিসমাস ট্রি। স্থানীয় আবহাওয়ায় টিকতে না পেরে এর অনেকগুলোই মরতে শুরু করেছে।
হাতিরঝিল প্রকল্পের নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মূল পরিকল্পনা পাশ কাটিয়ে বিদেশি প্রজাতির ও স্থানীয় পরিবেশের সঙ্গে মানানসই নয়—এমন জাতের গাছ রোপণ করা হয়েছে। পরিকল্পনায় চারাগাছ লাগানোর কথা ছিল, যাতে এখানকার মাটিতে বড় হয়ে গাছগুলো পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চারা লাগালে গাছগুলো একই সঙ্গে বেড়ে উঠত এবং আকার প্রায় সমান হলে দৃষ্টিনন্দন হতো। আর চারা থেকে বেড়ে উঠলে স্বাভাবিকভাবে গাছগুলো পরিবেশের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে এবং গাছের বাহ্যিক গড়ন ও স্বাস্থ্য ভালো হয়। কিন্তু শিকড় ও গোড়ায় মাটিহীন এ বড় বড় খেজুরগাছের যে কটি বা বেঁচে যাবে, তাদের অয়ুষ্কাল বেশি দিন হবে না।
হাতিরঝিল প্রকল্পে বৃক্ষায়ণের মাধ্যমে সৌন্দর্যবর্ধনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তিনটি প্রতিষ্ঠানকে। এগুলো হলো—ব্র্যাক নার্সারি, গার্ডেনিয়া নার্সারি ও এনার্জিপ্যাক অ্যাগ্রো লিমিটেড। এর মধ্যে প্রথম দুটি প্রতিষ্ঠান ঝিলের ঢাল ও পাড়ে দেশি গাছ ও লতাগুল্ম লাগিয়েছে। তাদের অনেক গাছে ফুলও ফুটতে শুরু করেছে।
কিন্তু এনার্জিপ্যাক অ্যাগ্রো লিমিটেড পরিকল্পনার বাইরে পাম, খেজুরের মতো গাছ লাগিয়েছে। ওই গাছগুলো মূল ছায়াবীথি তৈরির জন্য নির্ধারিত জায়গায় থাকায় সেগুলোই বেশি চোখে পড়ছে। আর বিবর্ণ এসব গাছের জন্য প্রকল্প পরিকল্পনায় রাখা সেই স্বপ্নিল দৃশ্যকল্প তৈরি হওয়ার সুযোগ থাকছে না। তারা ঝাউ ও ক্রিসমাস ট্রিও রোপণ করেছে এখানে।
পাম (মানিক মিয়া এভিনিউতে এ পামের বীথি আছে) গাছ সাধারণত ছায়াযুক্ত আর্দ্র পরিবেশে ভালো জন্মে। কিন্তু এ রকম একটি সূর্যতাপ উন্মুক্ত জায়গার জন্য এ গাছকে কেন বেছে নেওয়া হলো, সে প্রশ্ন তুলেছেন প্রকৃতিবিদেরা।
যোগাযোগ করা হলে এনার্জিপ্যাক অ্যাগ্রো লিমিটেডের এই প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা সাইদুর রহমান বলেন, ‘প্রকল্পের ১১ কিলোমিটার এলাকার ৪০ শতাংশ অংশে গাছ লাগানোর দায়িত্ব পেয়েছি আমরা। শিমুল, জারুল, কৃষ্ণচূড়াসহ দেশি গাছ লাগাতে বলা হয়েছে। তবে আমরা প্রকল্পের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য প্রায় ৭০০টি পরিণত ঝাউ, পাম ও খেজুরগাছ লাগিয়েছি। প্রকল্প পরিচালক এর অনুমতি দিয়েছেন।’ এর বাইরে তাঁরা ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় দেড় লাখ গাছ লাগিয়েছেন বলে দাবি করেন তিনি।
হাতিরঝিল প্রকল্পের অন্যতম অংশীদার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) বেগুনবাড়ী খালসহ হাতিরঝিল এলাকার সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালককে খালের পাড় থেকে বিদেশি প্রজাতির গাছ সরিয়ে ফেলতে বলেছে। গত ১০ অক্টোবর এলজিইডি থেকে প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু সাইদ মো. মাসুদকে দেওয়া ওই চিঠিতে মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশি গাছ লাগানোর জন্য বলা হয়েছে।
প্রকল্পের অন্যতম পরিকল্পনাকারী ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ও স্থাপত্যবিষয়ক পরামর্শক সংস্থার (ভিত্তি) পক্ষ থেকেও বিদেশি প্রজাতির গাছ লাগানোর ব্যাপারে আপত্তি জানানো হয়েছে।
প্রকল্পটির অন্যতম পরিকল্পনাকারী বুয়েটের অধ্যাপক মুজিবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, হাতিরঝিল প্রকল্পে সব দেশি প্রজাতির গাছ লাগাতে বলা হয়েছিল। খেজুর, পাম, ঝাউ ও ক্রিসমাস ট্রি এখানকার পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না। ফলে দ্রুত ওই গাছগুলো সরিয়ে দেশি জাতের গাছ লাগাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক আবু সাইদ মো. মাসুদ প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, বেগুনবাড়ী বস্তিতে আগুন লাগায় অনেক গাছ মরে গেছে। আর শীতকালে গাছের পাতা এমনিতেই বিবর্ণ ও ধূসর থাকে। বর্ষা এলে ওই গাছগুলো আবারও সবুজ হয়ে উঠবে।
খেজুর ও পামগাছ লাগানোর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পরিচালক বলেন, ‘বেগুনবাড়ী এলাকায় প্রকল্পের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খেজুর ও পামগাছ বেশ উপযোগী। তাই আমি এই গাছগুলো লাগাতে বলেছি।’ তবে যেসব গাছ মারা যাচ্ছে সেগুলোর জায়গায় আবারও গাছ রোপণ করা হবে বলে জানান তিনি।

No comments

Powered by Blogger.