নারী সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও আমাদের রাজনীতি by দিল মনোয়ারা মনু

মানুষের মুক্ত, স্বাধীন জীবনের পূর্বশর্ত তার আত্মপরিচয়। পরিচয়হীন মানুষ আর অস্তিত্বহীন মানুষ বা মানবেতর জীবের মধ্যে মূলত কোনো পার্থক্য থাকে না। পরিচয় মানুষকে নিজের কাজের জন্য যেমন শক্তি ও প্রেরণা জোগায়, তেমনি নিজ কর্মের জন্য নিজের কাছেই জবাবদিহিও মানুষকে পরিচয়ের কারণেই করতে হয়।


পরিচয় জীবনবোধের উন্মেষ ঘটায়, তেমনি নিরন্তর বাড়িয়ে দেয় মনোবল এবং সমাজ ও মানুষের প্রতি দায়বোধ।
অথচ এই পরিচয়ের ক্ষেত্রেই হয়তো অসচেতনতার অন্ধকারে আছে পৃথিবীর অধিকাংশ অধিকারবঞ্চিত নারী। স্বামী বা বাবা সম্পর্কের পুরুষের নামের আড়ালে থেকে যায় তাদের কাজ, পরিচয়। এতে তাদের প্রতিষ্ঠা, মুক্তি আসবে কী করে? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হচ্ছে, কিন্তু সদুত্তর সব সময় সহজে মেলে না। এখনো আমাদের দেশের গ্রামীণ ও সংখ্যালঘু মেয়েরা সামাজিক, পারিবারিক বা অর্থনৈতিকভাবে তথাকথিত শিক্ষিত মেয়েদের চেয়ে নিজের দেশের, সমাজের উন্নয়নের জন্য যতই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখুক না কেন, যত অগ্রসরই হোক না কেন, সমাজ এখনো তাদের সেই স্বীকৃতি বা সম্মান- কোনোটাই দেয় না। তাই শিক্ষা বা চাকরি- কোনো ক্ষেত্রেই আমাদের পিছিয়ে থাকা নারীদের আজও আত্মপরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে, মানবিক অধিকার বিবেচনায় পুরুষের সঙ্গে সমমর্যাদার আসন দিতে সমাজ কুণ্ঠিত, অক্ষম।
১. পত্রিকা মারফত যখন জানতে পারলাম বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার নেত্রকোনা প্রতিনিধি আল্পনা বেগমকে একটি রাজনৈতিক সভার সঠিক নিউজ কভার করার পরও নেত্রকোনার একটি ছাত্রসংগঠনের কর্মী নামধারীদের অশ্লীল কটাক্ষ ও জীবনের হুমকির মোকাবিলা করতে হয়েছে; তখন দুঃখ ও অপমান বোধ করা ছাড়া আর কিছু করতে পারিনি। সবচেয়ে লজ্জা ও দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় থানায় অভিযোগ করতে গেলে সেই অভিযোগ গ্রহণ করা বা এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো তদন্তের ব্যবস্থা করা হয়নি। ফলে সেই নারী সাংবাদিককে প্রাণ ভয়ে নেত্রকোনা ছাড়তে ও পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। খবরে প্রকাশ, এমনো হুমকি দেওয়া হচ্ছে যে আল্পনার মাংস কুকুর দিয়ে খাওয়ানো হবে। যে দেশের সাংবিধানে নারীর অধিকার, মৌলিক অধিকার ও সমমর্যাদা স্বীকৃত, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন সনদে এই অধিকার গুরুত্বসহকারে সংরক্ষণ ও প্রয়োগের বিধান রাখা হয়েছে, এবং যে দেশে নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে সরকার নারী নেতৃত্ব বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে, সেই দেশে ঘটে যাওয়া এই ন্যক্কারজনক ঘটনা কতটা দূর্ভাগ্যজনক ও লজ্জার বিষয় সরকারের জন্য, আমাদের সবার জন্য তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন? জানি না কর্তৃপক্ষ এত লেখালেখির পরও কোনো পদক্ষেপ নেবে কি না।
২. সাংবাদিক রুনি-সাগর হত্যা মামলা নিয়ে যে টালবাহানা ও লুকোচুরি খেলা দীর্ঘদিন ধরে দেখছি, তাতে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না চরম লজ্জা ও ন্যক্কারজনক এই ঘটনাটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্তাব্যক্তির সদয় দৃষ্টির যোগ্য বলে বিবেচিত হবে। শোনা যায়, সাংবাদিক সাগরকে ধারালো ছুরির ২৩টি আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে, আর রুনির পেট এমনভাবে ছিন্নভিন্ন করা হয়েছে যে নাড়ি-ভুড়ি বের হয়ে আসে। শুধু হত্যা করার উদ্দেশ্যে করা হলে একটি-দুটি আঘাতেই তা ঘটানো যেত। কিন্তু কতখানি ক্রোধ, ক্ষোভ ও বিদ্বেষ থাকলে এ ধরনের নির্মমতার আশ্রয় নেওয়া হয়, তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এতদিনেও এই নির্মম ঘটনার রহস্য কেন উন্মোচিত হলো না? কারা ঘটনাটিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে? এটি ডাকাতির ঘটনা হলে ডাকাতরা সোনাদানা, টাকা-পয়সা না নিয়ে শুধু ল্যাপটপ ও সাগর-রুনির মোবাইল কেন নিয়ে গেল? আমরা জানি, এই সাংবাদিক দম্পতি অনেক স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে অনুসন্ধানী রিপোর্ট করেছে, তাদের মৃত্যুর নেপথ্যে কি ওসব স্পর্শকাতর বিষয়ে যাদের স্বার্থ জড়িত তাদের কোনো হাত ছিল? যাঁরা তদন্ত করছেন, তাঁরা কি এ সত্যটি অনুধাবন করার চেষ্টা করেছেন বা করছেন? যে দেশে দক্ষ নারী সাংবাদিক মাত্র হাতেগোনা, সে দেশে তাঁদের জীবনের নিরাপত্তা দিতে না পারাটা কতটা দুর্ভাগ্যের; সেই কথা অনুধাবন করে রাষ্ট্র, সমাজ কবে তাদের নিরাপত্তা ও সঠিক কাজের পরিবেশ তৈরি করে দেবে? কবে সমাজটা পুরোপুরি নারীবান্ধব হবে? দীর্ঘদিনের নারী আন্দোলন ও উন্নয়ন সংগঠনগুলো তৃণমূল পর্যন্ত ধারাবাহিক সচেতনতামূলক নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে এ অন্ধকার কাটানোর চেষ্টা করছে। কবে তারা সফলতার মুখ দেখবে? ভুলটা কোথায়, এগিয়ে যাওয়ার সঠিক পথ কোনটি?
৩. কেন এখনো মহিলা পরিষদের সভায় হিল ওমেন্স ফেডারেশনের চঞ্চলা চাকমাকে দাবি জানাতে হয় সংসদের সংরিক্ষত আসনে আদিবাসী নারীদের জন্য ছয়টি আসন বরাদ্দ দেওয়া হোক এবং এই নারী সংসদ সদস্যরা যেন সংসদে অলঙ্কার হয়ে না থাকেন। তাঁদের মতামত দেওয়ার অধিকার ও ক্ষমতা দেওয়া হোক। তিনি জোর গলায় বলেছিলেন, ভাষা ও সংস্কৃতি যাদের আলাদা, তারাই আদিবাসী, এই সত্য কথা শুনতে হবে এবং অনুধাবন করতে হবে। তাঁকে এখনো দাবি করতে হয়, নারীদের জন্য নিরাপত্তা আইন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন করা হোক।
প্রতিটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এবং জিডিপিতে তাদের অবদান পুরুষদের চেয়ে কম নয়। কাজেই এ দাবি কি খুব অযৌক্তিক যে আইন, বাজেট ও নীতি হবে প্রকৃতই নারীবান্ধব? সেই আইন ও বাজেট চাই। রাজনীতি, সংস্কৃতি ও নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এবং সামাজিক বৈষম্য নিরসনের জন্য সর্বক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর সঠিক পরিকল্পনা ও তার যথাযথ প্রয়োগ দরকার। সময় এসেছে এখন নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন বাড়ানো এবং সেসব আসনে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করার। এর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন ও নির্বাচনী এলাকা পুনর্নির্ধারণ খুবই জরুরি। ওই একই সভায় প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের নাজমা আরা বেগম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, আদিবাসী ও প্রতিবন্ধী নারীরা সব রকম সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাঁর দুঃখ ও ক্ষোভ জাতীয় সংসদের ৫০টি আসনে কোনো প্রতিবন্ধী নারী নেই। সংসদে প্রতিবন্ধীদের কথা কেউ বলেন না। নারীদের তো প্রশ্নই ওঠে না। সংসদে অন্তত দুটি আসন প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য বরাদ্দের দাবি তাঁদের।
সময় এসেছে এখন পথ খোঁজার। যে ক্ষমতা ও দাপটের রাজনীতি চলছে দেশে, তা দিয়ে আমরা খুব বেশি দূর এগোতে পারব কি?
লেখক : সাংবাদিক ও নারী অধিকার কর্মী

No comments

Powered by Blogger.