আরও সাতটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন by মোশতাক আহমেদ

আরও সাতটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হলো। বিদ্যমান ৬৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশই শর্ত পূরণ না করেই চলছে। এগুলোর নিষ্পত্তি না করে গতকাল রোববার রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পেল।
নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উদ্যোক্তাদের মধ্যে আছেন সাংসদ, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, সিটি করপোরেশনের মেয়রসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও ঘনিষ্ঠজন।
তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অনুমোদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) পূর্ণাঙ্গ বৈঠকের সুপারিশ অনুসরণ করা হয়নি। কমিশন সরেজমিন পরিদর্শন করে এবং নির্দিষ্ট ছয়টি শর্ত পর্যালোচনা করে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের সুপারিশ করেছিল। এর মধ্যে ছয়টির অনুমোদন দিয়েছে সরকার। ইউজিসি রাজশাহীতে চারটি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের সুপারিশ করলেও সব কটি বাদ দেওয়া হয়েছে চূড়ান্ত তালিকা থেকে। আর ইউজিসির সুপারিশের বাইরে নতুন তালিকায় যুক্ত হয়েছে সিরাজগঞ্জের খাজা ইউনূস আলী বিশ্ববিদ্যালয়।
বর্তমান সরকারের আমলে এর আগে দুই দফায় আরও নয়টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়। তখনো দলীয় বিবেচনার অভিযোগ উঠেছিল। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ও দলীয় বিবেচনায় বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেওয়া হয়। এমনকি জোট সরকারের শেষ কর্মদিবসেও একটি বেসরকারি সংস্থাকে ঢাকায় এবং একজন মন্ত্রীকে চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
জানতে চাইলে শিক্ষাসচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই নতুন সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তবে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন দেওয়ার বিষয়টি এড়িয়ে যান তিনি।
ইউজিসি সূত্র জানায়, নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য শতাধিক আবেদন জমা পড়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রায় ১০০টি প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সরেজমিন প্রতিবেদন তৈরি করেছে ইউজিসি। মাস খানেক আগে ইউজিসির পূর্ণাঙ্গ কমিশন সভায় একটি তালিকা তৈরি করে মতামতের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করা হয়। কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রধানমন্ত্রী এ সময় ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা চূড়ান্ত করার পরামর্শ দেন। সেই অনুযায়ী ইউজিসি ১০টি তালিকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। এগুলোর মধ্যে রাজশাহীর চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম একযোগে বাদ পড়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন ইউজিসির নীতিনির্ধারকেরা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এর আগের দফায় রাজশাহীতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ছাত্রলীগের সাবেক কয়েকজন নেতা এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা জড়িত আছেন।
সূত্রমতে, রাজশাহীতে আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন যাতে না হয়, সে জন্য একটি মহল বিশেষভাবে সক্রিয় ছিল। ওই মহলটি সেখানে একচেটিয়া শিক্ষার্থী ভর্তি করতে চায়। এ জন্যই বাদ পড়েছে ওই অঞ্চলের চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম।
শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাজশাহীতে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের অবৈধ পাঁচটি শাখা এবং অন্যান্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপক্ষে ১০টি অবৈধ শাখা চলছে। কেউ বা আইনের আশ্রয় নিয়ে, কেউ বা প্রভাব খাটিয়ে এসব অবৈধ শাখায় শিক্ষার্থী ভর্তি করছে। উচ্চশিক্ষা নিয়ে এ নৈরাজ্যের মধ্যে গত মার্চে অনুমোদন পাওয়া একমাত্র বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টি এককভাবে শিক্ষার্থী আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে।
নতুন বিশ্ববিদ্যালয় পেলেন যাঁরা: অনুমোদন পাওয়া ঢাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয় হলো সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটি। প্রথমে মধ্য বাড্ডায় এর অবস্থান বলা হলেও পরে কারওয়ান বাজারের ঠিকানা দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির আবেদনকারী হিসেবে নাম আছে ট্রাস্টি বোর্ডের পরিচালক সায়মা আফরোজের। তবে এর সঙ্গে আছেন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান সাংসদ নজরুল ইসলাম ওরফে বাবু। মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত একটি সংসদীয় কমিটির সভাপতি প্রথমে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান ছিলেন। পরে তিনি চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরে গিয়ে বোর্ডের সদস্য হিসেবে রয়েছেন।
সদ্য অনুমোদন পাওয়া ফেনী ইউনিভার্সিটি ফেনীর ট্রাঙ্করোডের বারাহিপুরে অবস্থিত। এর বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান আবদুস সাত্তার নামের এক ব্যক্তি। তবে এর পেছনে আছেন বিগত মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একজন সহকারী একান্ত সচিব এবং সাবেক একজন রাষ্ট্রদূত। দুজনই বর্তমান সরকারের ঘনিষ্ঠ।
এ ছাড়া নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি খুলনার সোনাডাঙ্গার ১১৮ মজিদ সরণিতে অবস্থিত। এর বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন খুলনার মেয়র ও খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি তালুকদার আবদুল খালেক। তবে এর মূল উদ্যোক্তা খুলনায় দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের অবৈধ শাখা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত।
পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রামের দক্ষিণ খুলশী এলাকার নিকুঞ্জ হাউজিং সোসাইটিতে অবস্থিত। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের ভাইস চেয়ারম্যান হলেন আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এনামুল হক শামীম। এর চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন জহির আহম্মেদ।
ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কুমিল্লা বিশ্বরোডের পদুয়ার বাজারে অবস্থিত। এর বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান হলেন এ এম মোজাহারুল ইসলাম। এর সঙ্গে প্রবাসী কয়েকজন বাংলাদেশি জড়িত। নেপথ্যে সরকারের কয়েকজন কর্মকর্তা জড়িত আছেন।
খাজা ইউনূস আলী বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত সিরাজগঞ্জ জেলার এনায়েত শরীফ থানার এনায়েতপুর গ্রামে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদনকারী হলেন এম এম আমজাদ হোসেন। এ দরবার শরিফের মুরিদ হলেন সরকারের প্রভাবশালী কয়েকজন রাজনীতিবিদ ও আমলা।
ঢাকার মিরপুরের ১২৫/১ দারুস সালামে অবস্থিত বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেসের বোর্ড অব ট্রাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান এ কে আজাদ খান।
নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে দুটি ঢাকায় ও পাঁচটি ঢাকার বাইরে অবস্থিত। এ সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত ছিল, ঢাকায় নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন না দেওয়া। শিক্ষাবিদেরাও বলে আসছিলেন, ঢাকায় কোনোভাবেই আর নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া ঠিক হবে না। তাঁদের যুক্তি ছিল, এমনিতেই ঢাকায় অবস্থিত ৪৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ঢালাওভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া ঠিক নয়। আর ঢাকার ক্ষেত্রে এক একর নিষ্কণ্টক জমি না থাকলে কোনোভাবেই অনুমোদন দেওয়া উচিত নয়। তবে ঢাকার বাইরে শিক্ষানুরাগীরা চাইলে অনুমোদন দেওয়া যেতে পারে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানিয়েছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০-এর আলোকে সাময়িকভাবে সাত বছরের জন্য নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সাময়িক অনুমোদন পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শর্ত পূরণ করে স্থায়ী সনদ নিতে হবে।
দেশে বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৩টি। নতুন সাতটি যোগ হওয়ায় এ সংখ্যা দাঁড়াল ৭০। ১০ থেকে ১২টি বিশ্ববিদ্যালয় ভালো বা মোটামুটি ভালো হলেও বাকিগুলোর বিরুদ্ধে সনদ-বাণিজ্য, লেখাপড়ার মান বজায় না রাখাসহ বিভিন্ন অভিযোগ আছে। তা ছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসি এসব বিশ্ববিদ্যালয় সুষ্ঠুভাবে দেখভাল করতে পারছে না।
ইউজিসির সদস্য আতফুল হাই শিবলী বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার মান দেখভাল করার জন্য অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল গঠনের বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এ ছাড়া উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠন করা এখন সময়ের দাবি।
এর আগের নয়টিও দলীয় বিবেচনায়: এর আগে গত ১৩ মার্চ আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর ১৬ অক্টোবর ইউজিসির পরিদর্শন প্রতিবেদনের আগে শর্তসাপেক্ষে অনুমোদন পায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় সব কটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনেই হয় রাজনৈতিক ব্যক্তি, না হয় ব্যবসায়ীক গোষ্ঠী জড়িত।
মার্চে অনুমোদন পাওয়া আট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটির মালিক বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর, রাজশাহী বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা হিসেবে হাফিজুর রহমান খানের নাম থাকলেও এর সঙ্গে রয়েছেন ছাত্রলীগের কয়েকজন সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা বা তাঁদের স্বজন। সিলেটের গোলাপগঞ্জের নর্থইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান গোলাপগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ইকবাল আহমেদ চৌধুরী। চুয়াডাঙ্গার ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটির মূল উদ্যোক্তা ওই এলাকার সরকারদলীয় সাংসদ সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার। কিশোরগঞ্জের ঈশা খাঁ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সঙ্গে আছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য দুর্গাদাস ভট্টাচার্য এবং শরীয়তপুরের জেড এইচ সিকদার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটির মালিক আওয়ামী ঘরানার ব্যবসায়ী জয়নুল হক সিকদার। এ ছাড়া বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজির পেছনে আছে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। নারায়ণগঞ্জের হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয়টি করেছে ইউনানী ঔষধালয় হামদর্দ।
আইনে দুর্বলতা, সুপারিশ মানা হয় না: সংশোধিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে যে কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনের জন্য আবেদন করতে পারেন। শিক্ষাবিদেরা বলছেন, এটা আইনের দুর্বলতা। তবে আবেদনের পর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের যাচাই-বাছাইয়ের পরই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইউজিসির সুপারিশ মানা হয় না।

No comments

Powered by Blogger.