ডা. মুনতাসীর মারুফ-'ইন্টারনেট অ্যাডিকশন ডিসঅর্ডার'- অন্তর্জালে আসক্তি

ইন্টারনেট এখন যুগের চাহিদা। শুধু কম্পিউটার থেকেই নয়, মোবাইল থেকেও সহজেই ব্যবহার করা যাচ্ছে ইন্টারনেট। ফলে ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ছে। কাজের পাশাপাশি অকাজে বা বিনা কাজেও নেটে থাকছে মানুষ।একটা সময় ব্যবহারের মাত্রা বাড়তে বাড়তে তা চলে যাচ্ছে আসক্তির পর্যায়ে।
আসক্তরা সাধারণত প্রথমে বুঝতে পারে না অথবা স্বীকার করতে চায় না যে সে আসক্ত। আশপাশের মানুষরা টের পায়। ইন্টারনেট আসক্তির লক্ষণ-উপসর্গগুলো ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। তবে কিছু সাধারণ বিষয় রয়েছে, যা থেকে একজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী যে আসক্তির পর্যায়ে চলে গেছে তা বোঝা যায়।
কী এমন আছে এই অন্তর্জালে? কেন এর মায়াচক্রে মানুষ আটকে থাকছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা? গবেষণা করেছেন আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী ড. ডেভ গ্রিনফিল্ড। তিনি জানাচ্ছেন, অনেক বিষয় ইন্টারনেটকে করে তুলছে এতটা আকর্ষক। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মাল্টিমিডিয়া। মাল্টিমিডিয়া-সংশ্লিষ্ট অসংখ্য বিষয় পাওয়া যাচ্ছে ইন্টারনেটে, যা টেলিভিশন দেখার মতো অনুভূতি সৃষ্টি করছে মনে। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, মানুষ যখনই চাইছে, তখনই ইন্টারনেটে প্রবেশ করতে পারছে। সপ্তাহের সাত দিনই, দিনের ২৪ ঘণ্টা ইন্টারনেট তার দ্বার খুলে রেখেছে। দিন-রাত যেকোনো সময় মানুষ সহজেই প্রবেশ করতে পারছে অন্তর্জালের জগতে। বাস্তব জগতে ইচ্ছামতো কিছু করতে গেলে যেসব বাধা আসে, ভার্চুয়াল জগতে সেই বাধা নেই বললেই চলে। মানুষ ভার্চুয়াল মহাসড়কে উঠে যেখানে মন চায় যেতে পারছে, সেখানে যা করা সম্ভব করতে পারছে বিনা বাধায়। এ ছাড়া তথ্যের অবাধ আদান-প্রদান, নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয়, বিষয়-বৈচিত্র্য তো রয়েছেই।
আসক্ত ব্যক্তি প্রায় প্রতিদিনই ইন্টারনেট ব্যবহার করে। ইন্টারনেটে বসার পর সময়জ্ঞান বলতে কিছু থাকে না তার। হয়তো বসার আগে ভাবল, এই তো পাঁচ মিনিটের জন্য বসছি, মেইলটা চেক করেই সাইন-আউট করব। বসার পর কখন ঘণ্টা পেরিয়ে যায়, খবরই থাকে না।
ইন্টারনেটে এই বাড়াবাড়ি রকমের সময়ক্ষেপণকে আমরা 'আসক্তি' বলব কেন? অ্যাডিকশন বা আসক্তি তো একটি ব্যাধি। ইন্টারনেটের কারণে ব্যক্তির এই পরিবর্তন কি ব্যাধি? আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অনেক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীর মতে, তা-ই। 'আসক্তি' আমরা কখন বলি? যখন মানুষ কোনো কিছুতে, তা ভালো-মন্দ যা-ই হোক, অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ে অর্থাৎ কোনো কিছুর প্রতি 'ডিপেনডেন্স' তৈরি হয়। একই সঙ্গে তৈরি হয় 'টলারেন্স', অর্থাৎ একই সমান তৃপ্তির জন্য ধীরে ধীরে ওই 'কিছু'র পরিমাণ বাড়াতে হয়। এবং সেই 'কিছু'র প্রতি এই ডিপেনডেন্স এবং টলারেন্স তখন মানুষের জীবনের নানা ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলতে থাকে। যেমন- আমরা বলে থাকি মাদকাসক্তির কথা। মাদক নেওয়ার পর ব্যক্তির মনে আনন্দের অনুভূতি হয়। ধীরে ধীরে ব্যক্তি আনন্দের জন্য মাদকের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। একই ঘটনা আমরা দেখতে পাই ইন্টারনেটের ক্ষেত্রেও। ইন্টারনেট-আসক্তদেরও তৈরি হয় টলারেন্স। প্রতিদিন একটু একটু করে বাড়তে থাকে ইন্টারনেটে কাটানো সময়ের পরিমাণ। মানসিকভাবে এর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তারা। 'সাইন-আউট' করার পর থেকে মাথায় একই চিন্তা ঘুরতে থাকে- কখন আবার 'সাইন-ইন' হব, নেটে ঢোকার পর কী করব, কিভাবে করব ইত্যাদি। বেশিক্ষণ অফ-লাইন থাকলে তাদের মধ্যে অস্থিরতা, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, খিটখিটে মেজাজসহ নানা উপসর্গ দেখা দেয়। ইন্টারনেট-আসক্তরা আবার অনলাইন হলেই স্বস্তি বোধ করে।
অন্য যেকোনো আসক্তির মতোই ইন্টারনেট-আসক্তিও মানুষের বাস্তব জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। প্রথম যে সমস্যাটি দেখা দেয়, তা হচ্ছে স্বামী-স্ত্রী, প্রিয়জন, মা-বাবা বা বাস্তবের বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি। যেহেতু আসক্তরা দিনের বেশির ভাগ সময় একাকী ঘরের কোণে কাটায়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায় ওয়েবে, তারা প্রিয়জনদের সময় দেয় কম। এ নিয়ে ঝগড়া, বিতণ্ডা; আসক্ত ব্যক্তি তার ইন্টারনেটে কাটানো সময় ও কৃত কাজের ব্যাপারে মিথ্যা বলা শুরু করে, এ নিয়ে দেখা দেয় পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের সংকট। অনেক রাত জেগে নেট-সার্ফিং ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। অনিদ্রা জন্ম দেয় আরো নানা শারীরিক-মানসিক উপসর্গের। আগে যেসব কাজ করতে ভালো লাগত, সেসব কাজে ব্যক্তি আর উৎসাহ পায় না।
ইন্টারনেট অনেকেই ব্যবহার করেন। সবাই আসক্ত নন, সবাই আসক্ত হন না। কারো কারো ক্ষেত্রে নেট তাদের কাজেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইন্টারনেট-আসক্তিকে নির্দিষ্ট সময়ের ফ্রেমে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। দৈনিক 'এত' ঘণ্টার বেশি অনলাইন থাকলে তা আসক্তি-এ রকমটা বলা যাবে না। অধিকাংশ গবেষকই একমত যে দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা থেকে পলায়নমুখী মানসিকতাই আসক্তির জন্ম দেয়। সেই সমস্যা হতে পারে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, পেশাগত বা শিক্ষাগত। আসক্তি অবশ্য ওই সমস্যার কোনো সমাধান নয়। কিন্তু তার পরও মানুষ সেখানে আশ্রয় খোঁজে। অনেকে অন্য আসক্তি, যেমন মাদকাসক্তি থেকে মুক্ত হতে গিয়ে ইন্টারনেটে আসক্ত হয়ে পড়ে। বয়ঃসন্ধির কিশোর-কিশোরী এমনকি শিশুদেরও এই আসক্তির ঝুঁকি রয়েছে। যারা মা-বাবার তত্ত্বাবধান ছাড়া অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার করার সুযোগ পায়, তাদের আসক্তির ঝুঁকি বেশি।
আসক্তির প্রকৃতি যদি গুরুতর না হয়, তাহলে নিজে নিজেই এ থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। অনেক ক্ষেত্রে আপনা-আপনি এ আসক্তি চলে যায়। কিছু ক্ষেত্রে সক্রিয় প্রচেষ্টার প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে আপনি যে আসক্ত- এ ব্যাপারটি আপনাকে অনুধাবন করতে হবে। যদি কেউ হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন যে তিনি আসক্ত, তবে চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রধান বাধাটি পার করে ফেললেন। এরপর দেখুন, এই আসক্তির ফলে আপনি জীবনে কী হারাচ্ছেন বা মিস করছেন। ভার্চুয়াল জগৎ থেকে বেরিয়ে আসুন, বন্ধু খুঁজুন বাস্তবে। পরিবার ও বাস্তবের বন্ধুদের সহায়তা এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি। বাস্তবে আপনার বন্ধুসংখ্যা যত বাড়বে, তত ভার্চুয়াল জগতের বন্ধুত্বের প্রয়োজন পড়বে কম।
তবে অনেকের ক্ষেত্রে শুধু নিজস্ব প্রচেষ্টায় এ আসক্তি থেকে মুক্তি লাভ কঠিন। তাদের জন্য বিশেষজ্ঞ সহায়তার প্রয়োজন। কাউন্সেলিং, সাইকোথেরাপি, সাপোর্ট গ্রুপ, এমনকি নির্দিষ্ট আসক্তি চিকিৎসার বিশেষ প্রোগ্রাম দরকার হতে পারে। সমস্যার গুরুত্ব অনুধাবন করে আমেরিকার ওয়াশিংটনে সিয়াটলের কাছে 'হেভেনসফিল্ড রিট্রিট সেন্টার' ইন্টারনেট-আসক্তদের চিকিৎসার জন্য এ বছরের আগস্ট থেকে বিশেষ আবাসিক চিকিৎসা-পদ্ধতি শুরু করেছে। এটি সম্ভবত ইন্টারনেট-আসক্তদের জন্য প্রথম কোনো বিশেষায়িত আবাসিক চিকিৎসাব্যবস্থা।
যদিও কোনো প্রমাণ নেই, তবু ধারণা করা হয়, যখন থেকে ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু, তখন থেকেই ইন্টারনেট-আসক্তিজনিত সমস্যারও সূচনা। তবে এটি আলোচনায় আসে ১৯৯৫ সালে, 'নিউ ইয়র্ক টাইমসে' এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর। ওই প্রতিবেদনে অন্যান্য আসক্তি যেমন- মাদক, জুয়া প্রভৃতির সঙ্গে ইন্টারনেট-আসক্তির তুলনা করা হয়। সেখানে কিছু স্ব-ঘোষিত ইন্টারনেট-আসক্তের বক্তব্যও ছাপা হয়। নিক নামের এক ব্যক্তির উক্তি প্রণিধানযোগ্য, 'আমি বাকি দুনিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না; কিন্তু আমার কম্পিউটার, আমার ভার্চুয়াল জগৎ আমার হাতের মুঠোয়।'
২০০৮ সালে 'আমেরিকান জার্নাল অব সাইকিয়াট্রি'তে প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জেরাল্ড জে ব্লক যুক্তি উপস্থাপনসহ ইন্টারনেট-আসক্তিকে ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক্যাল ম্যানুয়ালের (ডিএসএম) পঞ্চম সংস্করণে 'ইন্টারনেট অ্যাডিকশন ডিসঅর্ডার' নামে গুরুত্ব সহকারে আলাদা 'ডিসঅর্ডার' বা 'ব্যাধি' হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান।
তবে এর বিরুদ্ধ মতও রয়েছে। ইন্টারনেটে মাত্রাতিরিক্ত সময়ক্ষেপণকে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ আলাদা 'ব্যাধি'র মর্যাদা দিতে অনিচ্ছুক। অনেক মনোরোগ বিশেষজ্ঞের মতে, ইন্টারনেট-আসক্তি চিকিৎসাবিজ্ঞানের 'রোগ নির্ণয়'-সংক্রান্ত সর্বজনীন অভিধানে স্থান পাওয়ার মতো স্বতন্ত্র কোনো ব্যাধি নয়; বরং অন্য কোনো রোগের একটি উপসর্গ। যেমন_বিষণ্নতা, উদ্বেগজনিত রোগ, ইমপালস-কন্ট্রোল ডিসঅর্ডার প্রভৃতি রোগের একটি উপসর্গ হতে পারে এই ইন্টারনেট-আসক্তি।
স্বতন্ত্র কোনো ব্যাধি হিসেবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের 'বাইবেলে' এর নাম অন্তর্ভুক্ত হোক বা না হোক, ইন্টারনেট-আসক্তি যে গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তা মানতে আপত্তি নেই কারো। আমাদের দেশেও ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ছে। বাড়ছে ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটের জনপ্রিয়তা। জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ব্লগিং। চ্যাটিংয়ের জন্য এখন আর কম্পিউটারের সামনে বসতে হচ্ছে না, মিগ৩৩-এর মতো সাইট মোবাইলে সহজে ও কম খরচে চ্যাটিংয়ের সুযোগ করে দিচ্ছে। অফিসে কাজের সময় কেউ কেউ ফেসবুক বা ম্যাসেঞ্জার অনলাইনে থাকছেন সর্বক্ষণ, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীরা লেকচার ক্লাসে বসে মোবাইল ফোনে লগ-ইন করছে চ্যাটিং সাইটে। শিক্ষক শিক্ষকের মতো পড়িয়ে যাচ্ছেন, শিক্ষার্থী তখন ক্লাসে বসেও ঘুরে বেড়াচ্ছে অন্য জগতে। এই মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার বাড়াচ্ছে আসক্তির ঝুঁকি। সাবধান হতে হবে এখনই।
লেখক : সহকারী রেজিস্ট্রার, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা

No comments

Powered by Blogger.